Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতকে আর কত দেবো?

| প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ ও পশ্চিমবঙ্গের হিলিকে যুক্ত করে নতুন একটি মহাসড়ক নিমাণের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উপ-আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ (মেঘালয়) থেকে হিলিকে (পশ্চিমবঙ্গ) সংযুক্তকারী একটি নতুন হাইওয়ে নির্মাণকল্পে একটি বিশদ প্রকল্প প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়কে তার অংশগ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের প্রস্তাবিত নতুন মহাসড়কটি নির্মিত হলে তা বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যবর্তী চিকেন-নেক নামে পরিচিত স্বল্পপরিসর ও দুর্গম সড়কের পরিবর্তে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সরাসরি ও সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে গণ্য হবে। চিকেন-নেকের বিকল্প সড়ক নির্মাণের গরজ ভারত অনেক দিন ধরে অনুভব করে আসছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নির্মিত সেই সড়কই হতে পারে বিকল্প সড়ক। ভারতের একান্ত স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে মহাসড়ক নির্মাণে বাংলাদেশের রাজি হওয়ার কথা নয়। তাই ভারত উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছে এবং অবশেষে সেই মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাবটি দিয়েছে। পত্রিকান্তরে সরকারি সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, তিন-চার বছর আগে দিল্লিতে বাংলাদেশের এক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিককে ভারতের পক্ষ থেকে এ মহাসড়ক নির্মাণের কথা জানাানো হয়। তবে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বিষয়টি সামনে আনা হয়নি। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় মহেন্দ্রগঞ্জ ও হিলির মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের জন্য ভারত বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করে। আর এবার প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় সুনির্দিষ্টিভাবে মহাসড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ আদৌ এ ধরনের প্রকল্পে সম্মত কিনা জানা যায়নি। অথচ, প্রকল্প প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতীয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যে প্রস্তাব দিয়েছে বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা কোনো পাল্টা বা ভারতীয় প্রস্তাবের সমতা নির্ণায়ক প্রস্তাব নয়। ভারত-মিয়ানমারÑথাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় মহাসড়ক নির্মাণ-প্রস্তাবেরও আগে ভারতের জায়গায় বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিদেশীয় মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। যে কোনো কারণেই হোক, সেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাবটির আর অগ্রগতি হয়নি। কাজেই, ভারত মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে যুক্ত হতে বাংলাদেশ যে আগ্রহ দেখিয়েছে তা অপ্রত্যাশিত ও অযৌক্তিক নয়।

আমরা অত্যন্ত মনোবেদনার সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে বাংলাদেশের মানুষের যা প্রত্যাশিত ছিল, তার কিছুমাত্র পূরণ হয়নি। কেউ কেউ অবশ্য কুশিয়ারার পানিবণ্টনকে এই সফরের একটা অর্জন বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া আর কোনো অর্জন আছে কি? নিরপেক্ষ-নির্মোহভাবে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের প্রাপ্তির ঘরে শূন্য। অথচ, বাংলাদেশ ভারতকে কী না দিয়েছে! উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে বাংলাদেশ সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, যাতে ভারতের ঐক্য-অখণ্ডতা সুরক্ষিত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশ তাকে ট্রানজিট দিয়েছে। বন্দর, নৌপথ, স্থলপথ ও রেলপথ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে ভারত পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য জ্বালানি ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে, ট্রায়াল রানের নামে প্রায় বিনা মাসুলে। ভারতের পণ্যের জন্য বাংলাদেশ তার বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বৈধ বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় পণ্য তো আসছেই, অবৈধ বা চোরাপথেও আসছে। বাংলাদেশÑভারত বাণিজ্য-অসমতা ব্যাপক। ঘাটতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে। অসমতা কিছুটা হলেও দূর হতো যদি বাংলাদেশের পণ্য সহজে ভারতে প্রবেশাধিকার পেতো। এক্ষেত্রে রয়েছে শুল্ক-অশুল্ক বাধা এবং এন্টিডাম্পিং শুল্ক। ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের একটা অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক বৈধ-অবৈধভাবে এখানে কাজ করে প্রতিবছর বিপুল অংকের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে স্বদেশে। এতকিছু পেয়েও ভারত সন্তুষ্ট নয়। একের পর এক তার চাওয়ার তালিকা বাড়ছে। অথচ, এপর্যন্ত উল্লেখ করার মতো কোনো কিছুই সে বাংলাদেশকে দেয়নি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানির মামলা অনেক দিনের। তার কোনো সুরাহা হয়নি। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত। তিস্তার পানি চুক্তি, যার ওপর প্রায় তিন কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে, বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এবারও পুরানো আশ্বাস নবায়িত হয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিএসএফ’র গুলি ও হানা তাদের দিনরাতের আরাম-ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সীমান্তে শূন্য মৃত্যুর আশ্বাস এবারও দেয়া হয়েছে। তার একদিন-দু’দিনের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে ভারতের বড় ট্রেড-পার্টনার বললেও ট্রেডে ন্যায়সঙ্গত অংশীদারিত্ব বাংলাদেশ পায়নি। এভাবে একেকটা বিষয় ধরে আলোচনা করলে বুঝা যাবে, বাংলাদেশ কীভাবে বঞ্চিত-উপেক্ষিত হয়েছে ও হচ্ছে। কানেক্টিভিটির কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকেন ভারতীয় নেতারা। তাদের মূল লক্ষ্য দ্বিপাক্ষিক কানেক্টিভিটি। বহুপাক্ষিক কানেক্টিভিটিতে ভারত আগ্রহী নয়। যদি হতো, তাহলে অনেক আগেই বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে নেপাল-ভুটানের কানেক্টিভিটি সম্পন্ন হতো।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, ভারত বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে মহাসড়ক নির্মাণ করে মহেন্দ্রগঞ্জ ও হিলির মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা একান্তই ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এতে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই। বাংলাদেশে যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা এই প্রস্তাবের পাল্টা নয়। এটা নতুন প্রস্তাব। ভারতের প্রস্তাব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি বা বলা হয়নি। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, প্রস্তাবিত মহাসড়ক দেশকে দুই অংশে বিভক্ত করবে। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়েও শংকা সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি অনুপুংখ বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। অতীতে অনেক ক্ষেত্রে এই বিচার-বিশ্লেষণ হয়নি। ভারত চাইবামাত্র সবকিছু পেয়ে গেছে। বাংলাদেশ তার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে দরকষাকষি করতে পারেনি বলে বঞ্চনা তার ভাগ্য লিখনে পরিণত হয়েছে। অতি ভারতপ্রীতি কিংবা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এর জন্য দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। এ নীতির পরিবর্তন আশু কাম্য। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৎ প্রতিবেশীসুলভ ও সার্বভৌম সমতার নীতি অনুসৃত হলে বাংলাদেশকে এতটা বঞ্চনার শিকার হতে হতো না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে, নিজেকে নিঃস্ব করে আমরা ভারতকে আর কত দেবো?

 



 

Show all comments
  • Mohin Khan ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১৯ এএম says : 0
    বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী যে ভারত সপরে গেছে এটাইতো বাংলাদেশের জন্য বিশাল অর্জন! আমরা ধন্যহয়েছি বাঙ্গালি জাতি হিসেবে, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই ভারত সফর করে আমাদেরকে ধন্য করার জন্য আর একটা বিষয় সামনের নির্বাচনে ক্ষমতায় বসাইয়া দিবে সেই নিশ্চয়তা দিলে আমরা জাতি হিসেবে পুরোপুরি কৃতার্থ হবো
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ নাজমুল হক ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১৯ এএম says : 0
    মধ্যে রাতের ভোটের অবৈধ আওয়ামী সরকার শুধু ভারতকে দিয়েই যাবে, তিস্তা সহ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। জনগণের ম্যান্ডেট বিহীন এই সরকার ভারতে গেছে সমর্থন আদায় করতে। কিন্তু ভারতসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব যদি বাংলাদেশের জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায় তবে বিএনপি জনগণের অধিকার প্রশ্নে আর কোনো আপোষ করবেনা ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • AR Anis UR ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:২২ এএম says : 0
    ভোগে নয়,ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।তাই অামরা ভোগের জন্য কোনোকিছু নিই না,অামরা নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করি
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন