পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্বাধীন সংবাদপত্র ও গণমুখী সাংবাদিকতা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত। গত একদশকে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেমন নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি স্বাধীন সংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানাভাবে সংকুচিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে দেশের সাংবাদিক সমাজকে একটি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। যদিও আইনের অপব্যবহার না করতে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সাংবাদিক সমাজের কাছে প্রতিশ্রæতি দেয়া হলেও তা অব্যহত রয়েছে। দেশের বেশ কয়েকজন পেশাদার ও সিনিয়র সাংবাদিককে বিনা অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক করে মাসের পর মাস কারান্তরীণ রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার এখন অনেকটাই স্পষ্ট। সরকারের নির্দেশে যেকোনো সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। দেশ-বিদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিবাদ হলেও বাস্তবে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবার প্রেস কাউন্সিলের আইন পরিবর্তন করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায়ের বিধান করতে যাচ্ছে সরকার। প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাবেক বিচাপতি নিজামূল হক নাসিম আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে আশাবাদের কথা বললেও প্রেসকাউন্সিলের সাংবাদিক প্রতিনিধি সদস্যদের কেউই এই আইনের সংশোধন সমর্থন করছেন না। এমনকি প্রেসকাউন্সিলের সদস্য হিসেবে ১৯৭৪ সালের আইনের সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে তাদের সাথে কোনো আলোচনাও হয়নি বলে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকবৃন্দ জানিয়েছেন।
বিচারপতি নিজামূল হক নাসিম দেশের সংবাদপত্র শিল্পের সাথে জড়িত কেউ নন। তিনি ২০২১ সালে প্রেসকাউন্সিলে নিয়োগ পেয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিক, প্রেসকাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্পাদক ও জেষ্ঠ্য সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সাইফুল আলম, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, উৎপল কুমার সরকার এবং মুস্তাফিজ শফির মত সাংবাদিকরা সাংবাদিক হিসেবে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় হৃদ্ধ। দেশের সাংবাদিকতার মানবৃদ্ধি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সিনিয়র সাংবাদিকদের আকাক্সক্ষা ও অভিজ্ঞতা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের প্রেসকাউন্সিল আইন পরিবর্তন করে আপত্তিকর সাংবাদিকতার জন্য ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান করার ক্ষেত্রে যে সংশোধনী আনা হচ্ছে, তাতে প্রেসকাউন্সিলের সাংবাদিক ও সম্পাদক সদস্যদের স্পষ্ট মতামত ও ভূমিকা গ্রহণ অপরিহার্য হলেও তা নেয়া হয়নি। প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতাবৃদ্ধির নামে কথিত সংশোধনীর প্রক্রিয়া প্রায় ৬ বছর আগে শুরু হলেও প্রেসকাউন্সিলের নবগঠিত কমিটির সদস্যদের অন্ধকারে রেখেই এখন তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটা নতুন করে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আরেকটি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সাংবাদিক মহল মনে করছেন। আগের আইনে কোনো সংবাদের ক্ষেত্রে আপত্তি থাকলে প্রেস কাউন্সিলের তিরস্কার করার বিধান ছিল। এখন একেবারে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে সংশোধনী করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলধারার কোনো সংবাদপত্রই দায়িত্বহীন বা হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। তারপরও প্রেস কাউন্সিলের নতুন সংশোধনী করার অর্থ হচ্ছে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করা, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াস। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সাম্প্রতিক সময়ে প্রবর্তিত আইন গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র শিল্প এখন এক কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। সরকারি বিজ্ঞাপণ নিয়ন্ত্রণ, বিজ্ঞাপনের বিল আটকে রাখা, কাগজসহ মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্ট পণ্যে আমদানি শুল্কবৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে সংবাদপত্র শিল্প চরম অর্থনৈতিক সংকটে পতিত। অনেক সংবাদপত্র সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমন এক পরিস্থিতিতে প্রেসকাউন্সিলের নতুন আইন সংবাদপত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠবে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা এবং মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে মূলত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী ও গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিদেরই মূল ভূমিকা পালন করার কথা। প্রেসকাউন্সিল আইনের কথিত সংশোধনীর ক্ষেত্রে বড় ধরণের ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং সাংবাদিক-সম্পাদক সদস্যদের মতামত ও অবস্থানে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে বিতর্কিত আইন পাস করিয়ে নেয়ার যে তৎপরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যমের এই দুর্দিনে নতুন আইন করে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের উপর জরিমানার খড়গ চাপিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত আরেকটি আইন করা সংবাদপত্রের স্বাধীনভাবে চলার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠবে বলে আমরা মনে করি। সংগত কারণেই এই আইন নিয়ে বিএফইউজে, ডিইউজেসহ দেশের সাংবাদিকমহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আইনটি এখন মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদনে অপেক্ষায় রয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। সেখান থেকে সংসদে পাশ হয়ে তা আইনে পরিনত হতে পারে। প্রেসকাউন্সিলকে আরো কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হলে এর আইনে নিবর্তনমূলক সংশোধনীর প্রয়োজন নেই। সাংবাদিক ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের আইন সংশোধন প্রেসকাউন্সিলের কাজ হতে পারে না। আইন সংশোধন করতে হলে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও তাদের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। দেশে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করার পাশাপাশি মানোন্নয়নে প্রেসকাউন্সিল যথাযথ ভূমিকা পালন করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।