Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রেস কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রেস কাউন্সিলের রায় বা আদেশ অমান্য করলে কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদসংস্থার প্রকাশনা সর্বোচ্চ তিন দিন বন্ধ অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করে প্রেস কাউন্সিল আইন (সংশোধন)-এর খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে প্রেস কাউন্সিল। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সাংবাদিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা প্রকাশনা বন্ধের এই প্রস্তাবে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। তারা এর পরিবর্তে অন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একটি দৈনিককে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: মমতাজ উদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, আইন কমিশনের সুপারিশ বাতিল করা হয়েছে। রায় অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সামান্য সাজার ব্যবস্থা থাকবে। সেটা হয়তো ৫ লাখ টাকার মতো জরিমানা অথবা এক থেকে তিন দিন পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখা। তিনি আরো জানিয়েছেন, সাংবাদিক বা সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেয়ার পর কেউ যদি সরাসরি এসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে তাকে আর কোনো প্রসিডিংয়ের আওতায় অনা হবে না। প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ও ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন আহমদ দৈনিকটিকে জানিয়েছেন, প্রেস কাউন্সিলের সভায় পত্রিকা বা সংবাদসংস্থার প্রকাশনা বন্ধ রাখার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যউপদেষ্টা ও ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী মনে করেন, শাস্তির ব্যবস্থা কি পত্রিকা একদিন থেকে তিন দিন বন্ধ থাকবে নাকি অন্য কিছু হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও মনে করেন, পত্রিকা বা সংবাদসংস্থার প্রকাশনা বন্ধ কোনো শাস্তি হতে পারে না। অন্য কোনো শাস্তি দেয়া যেতে পারে।
দেশে গণমাধ্যমের প্রকৃত অবস্থা কি তা বোধকরি লিখে বা বলে বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারি ভাষ্যে বা সংশ্লিষ্টরা যা-ই বলুন না কেন, কার্যত দেশের গণমাধ্যম এখন ধারালো করাতের নিচে অবস্থান করছে। সাংবিধানিকভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা বলা হলেও বর্তমান সময়ে এত ধরনের আইন রয়েছে যার ফলে একটু এদিক-ওদিক হলেই মিডিয়ার আর উপায় নেই। এখনো বাংলাদেশে বহু গণমাধ্যম যেমনি বন্ধ রয়েছে তেমনি গণমাধ্যমের বহু কর্মীও আটক রয়েছেন। নানা নিবর্তনমূলক আইনে মিডিয়াকর্মীদের নিগ্রহ-নির্যাতনের মাত্রা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক রিপোর্টে একটি ইংরেজি দৈনিকে দেশে সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্র্মীদের নির্যাতন-নিগ্রহের বিশদ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন ও শালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ২৪৪ জন সাংবাদিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা হয়রানি, নিগৃহীত ও হুমকিপ্রাপ্ত হয়েছেন। উল্লেখিত সময়ে অন্তত ৬১ জন সাংবাদিক সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা অনুরূপ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। এ সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে অন্তত ২৩৩টি মামলা হয়েছে। এছাড়াও খবর প্রকাশের ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অসদাচরণ তো রয়েছেই। আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও বাংলাদেশের সাংবাদিকতার দৈন্যদশার নানা বিবরণ হরহামেশাই প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্টদূত যথার্থই বলেছেন, গণতন্ত্র সেখানেই বিকশিত হবে যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীন। এদিকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল। বাস্তবত এ কথা ঠিক যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। আর গণতন্ত্র ছাড়া সংবাদপত্র বা মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই। এ বাস্তবতায় প্রেস কাউন্সিল পত্রিকা বন্ধের যে ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাচ্ছে তা প্রকৃত বিবেচনায় হয়তো বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবেই বিবেচিত হতে বাধ্য। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে হালকা বা সহজভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সংবাদপত্র বা মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে অনেকেরই আহত হওয়ার যে আশঙ্কা রয়েছে তা থেকে সবাইকে নিবৃত্ত রাখা এবং সংবাদ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিশেষ করে ফৌজদারি বিধান থেকে অর্থাৎ কথায় কথায় সাংবাদিকদের গ্রেফতার বা পত্রিকা যাতে বন্ধ করা না হয় সে বিবেচনা থেকেই প্রেস কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সেই প্রেস কাউন্সিলই পত্রিকা বা সংবাদসংস্থা বন্ধ রাখার অনুবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। একে মূলত মত প্রকাশের ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে অনেকেই পত্রিকা বা সংবাদসংস্থা বন্ধ রাখার বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টাও প্রকারান্তরে প্রকাশনা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এখন অবস্থা এমন যে, মনে হচ্ছে পত্রিকা প্রকাশ করাটাই এক মহা দোষের কাজ। এই প্রবণতা বা বাস্তবতা কোনো বিবেচনাতেই এটি সুস্থ দেশ বা জাতি গঠনে সহায়ক নয়।
প্রকাশনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি সভায় আলোচিত হয়নি বলে প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ও ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন আহমদ পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে বিষয়টি আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত হিসেবে উঠে এসেছে। এটিও অনভিপ্রেত। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন প্রেস কাউন্সিলের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমান উদ্যোগ হয়তো আরো বিতর্ক সৃষ্টি করবে। বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে আমরা মনে করি, মিডিয়ার সাথে যুক্ত মালিক পরিষদ, সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়নের ফেডারেশন এবং সাধারণ ও শ্রমিক সংগঠনসমূহের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হওয়া জরুরি। আমরা সেই সাথে পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই। মত রুদ্ধ নয় বরং প্রকাশের অনুবর্তী সিদ্ধান্ত প্রেস কাউন্সিল গ্রহণ করবে- এটাই দেশবাসী কামনা করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রেস কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন
আরও পড়ুন