পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরণের ক্রান্তিকাল চলছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পুরো অঞ্চলে এক প্রকার অনাস্থা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করলেও শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক গণতান্ত্রিক ভাবধারা লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। সেখানে পার্লামেন্টের বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকে সাধারণ মানুষকেও রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে। সরকারি বাহিনীগুলো বিরোধি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমাতে বা নির্বাচিত ক্ষমতাসীনদের গদি রক্ষা করতে পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার দায়ে বিরোধিদলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়নি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে গোতাবায়ার কার্যালয়ের সামনে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদী সমাবেশ সেখানে জমায়েত হওয়ার সুযোগ না পেলে, যে কোনো সমাবেশ এবং এর সম্ভাব্য সংগঠকদের আগেই মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে জেলে ভরে দিলে হয়তো ক্ষমতাসীন সরকারের ২৬ জন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার মত বাধ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। একইভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিকে ব্যাপক জনপ্রিয় ও ক্ষমতাসীন তেহেরিকে ইনসাফ পার্টির নেতা ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে যে সব দলের নেতারা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিদেশি এস্টাবলিস্টমেন্টের সাথে যোগাযোগ করে রিজিম চেঞ্জের ফর্মুলা বাস্তবায়ণের উদ্যোগ নিচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সে সম্পর্কে আগেই জাতির সামনে তথ্য হাজির করেছিলেন। যদিও এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে সব তথ্য নিয়ে কন্ট্রোভার্সি দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, রিজিম চেঞ্জে’র সা¤্রাজ্যবাদী খেলার সব তথ্য খোলাসা করা আপাতত সম্ভব নয়। প্রায় একই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় যে রাজনৈতিক পালাবদল সংঘটিত হল তা দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের ছেদ টানলেও দেশগুলোর রাজনৈতিক আবহে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিজয় নিশ্চিত হতে দেখা গেছে। বিশেষত পাকিস্তানের মত দেশে রাতারাতি একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে পার্লামেন্টে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে গণেশ উল্টে দেয়া একটি নতুন বাস্তবতা হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। তবে মধ্যরাতে আদালত বসিয়ে পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকারের রুলিংকে অবৈধ ঘোষণার মাধ্যমে ইমরান খানকে পদত্যাগ করে সরে যেতে বাধ্য করার পেছনে সেনাবাহিনীসহ বিদেশি শক্তির নেপথ্য প্রভাবের বিষয়টি এখনো জল্পনার তুঙ্গে রয়েছে। এভাবে সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান সবচেয়ে শক্তিশালী একক ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর পেশোয়ারে ইমরান খানের জনসভাটি পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক জনসভা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের কাছে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে বলেই প্রতিয়মান হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে নানা পক্ষে বিতর্ক হতেই পারে। রিজিম চেঞ্জের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেপথ্য ভ’মিকার দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। আগেই বলেছি, এ নিয়ে ধোঁয়াসা দূর করা আপাতত সম্ভব নয়। তবে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের আগ্রাসি মধ্যপ্রাচ্য নীতির কট্টর সমালোচক ও বিরোধী ইমরান খান মার্কিনী ও পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হওয়া স্বাভাবিক। তিনি ইরাক যুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। মার্কিনীদের ওয়ার অন টেররিজমে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের বিপক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের মাটিকে চার শতাধিক ড্রোন হামলা করে হাজার হাজার পাকিস্তানী তালেবান সন্দেহভাজনকে হত্যার বিরুদ্ধে ইমরান খান সোচ্চার ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাকিস্তান সীমান্তে আর কোনো ড্রোন হামলা বা সামরিক হস্তেক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। পক্ষান্তরে ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনের তরফ থেকে পাকিস্তানে মার্কিন বিমানঘাঁটি করার প্রস্তাবকে ইমরান খান ‘অ্যাবসোলিউটলি নট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সীমান্তে ভারতীয় হুমকি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করার পাশাপাশি ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সরাসরি পশ্চিমা বিরোধি অবস্থান নিশ্চিত করা এবং চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার সাম্প্রতিক তৎপরতা তার রিজিম চেঞ্জের নেপথ্যে পশ্চিমাদের গোপণ ইন্ধন থাকলে তাতে বিষ্ময়ের কিছু নেই। আমাদের আলোচ্য বিষয় আসলে তা নয়। আমাদের বিবেচ্য হচ্ছে, পাকিস্তান -শ্রীলঙ্কার মত দেশে সরকার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কর্তৃত্ববাদী এস্টাবলিশমেন্টের নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের বিপ্রতীপ অবস্থান সম্পর্কে। এখানে জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন আগের চেয়ে স্পষ্ট ও স্বত:স্ফুর্ত হয়ে উঠেছে। এর মানে হচ্ছে, ভারতের বাইরে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা আগেরে চেয়ে অবারিত ও বিকশিত রূপ লাভ করতে শুরু করেছে। প্রবাসি কর্মীদের রেমিটেন্স এবং গার্মেন্ট রফতানির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনো চরম হতাশাজনক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর বৈদেশিক ঋণের ফলশ্রুতি নিয়ে কেউ কেউ ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মত অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কখনোই শ্রীলঙ্কা হবে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতার বাইরে, সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের কাছাকাছি অবস্থানে উত্তীর্ণ হোক, এটা এ সময়ে এ দেশের অনেক নাগরিকের সাধারণ প্রত্যাশা। যেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে নেমে আসতে পারবে। এ দেশের মানুষ এখন স্বপ্ন দেখে, এমন দিন কবে আসবে যখন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে মিথ্যা মামলা, পুলিশি আগ্রাসন বা একচেটিয়া প্রপাগান্ডার সম্মুখীন হতে হবে না?
বৃটেনের দ্য ইকোনমিস্ট গ্রæপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিরীখে বিশ্বের দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার মূল্যায়ন প্রকাশ করে আসছে। ইকোনমিস্টের মূল্যায়নে চার ধরণের শাসনব্যবস্থা হচ্ছে, পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রæটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড রিজিম এবং স্বৈরশাসন। প্রথম বছরের মূল্যায়নে বাংলাদেশকে ত্রæটিপূর্ণ গণতন্ত্রের কাতারে ফেলা হলেও ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ হাইব্রিড রিজিমের তালিকা থেকে বের হতে পারছেনা। নির্বাচন প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, ফাংশনিং অব গর্ভনমেন্ট সরকার পরিচালনা প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সিভিল লিবার্টিজ বা নাগরিক অধিকার, এই পাঁচটি মানদন্ড সামনে রেখে গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের মূল্যায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে ৭৫তম অবস্থানে ছিল। বিশ্বের পূর্ণ গণতন্ত্রের দেশগুলোর তালিকায় নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, বৃটেন, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার নাম থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স, ইসরাইল, ভারত, মালয়েশিয়া , দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশগুলো ত্রæটিপূর্ণ গণতন্ত্রের তালিকায় স্থান পেয়েছে। হাইব্রিড রিজিমে ৩৫টি দেশের তালিকায় ৫.৯৯ নাম্বার নিয়ে প্রথমেই বাংলাদেশের নাম থাকলেও এই তালিকার শেষ ১০টির মধ্যে স্থান পেয়েছে পাকিস্তান, তুরস্ক, নেপাল, বলিভিয়া, নাইজেরিয়ার মত দেশগুলো। এর মধ্যে ৪.৩১ নাম্বার পেয়ে ১০৪তম অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে আগামিতে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ দেখা দিতে পারে। বহুত্ববাদি ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়েও অনেক পিছিয়ে থাকলেও ইআইইউ’র গত বছরের ইনডেক্সে তার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে কিনা তা নিয়ে বিরোধিপক্ষের সংশয়ের যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট হাইব্রিড রিজিম সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছে, তা হল- নির্বাচনে অনেক অনিয়ম হয়, যা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বাঁধা সৃষ্টি করে, বিরোধিদল ও বিরোধি প্রার্থীদের উপর সরকারের চাপ সাধারণ ঘটনা, দুর্নীতির মারাত্মক বিস্তৃতি ও দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল সুশীল সমাজ, নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে চাপের মুখে রাখা হয়। এসব মানদন্ডের নিরীখে বাংলাদেশের অবস্থান যথার্থভাবে হাইব্রিড রিজিম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ অবস্থান স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছাকাছি। জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার নজির বিশ্বের আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন নতুন নির্বতনমূলক আইন করে সরকারের সমালোচনাকারিদের গ্রেফতার করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখার এমন দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র স্বৈরাতান্ত্রিক দেশগুলোতেই দেখা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ অন্যতম ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করছে। প্রথমত, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় হাজার কিলোমিটার দূরের পাকিস্তানের সাথে মিলিত হওয়া, পূর্ণ গণতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দাবি সামনে রেখে মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে সেই পাকিস্তানের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবময় ইতিহাস শুধুই বাংলাদেশের। এরপর স্বাধীনতার একদশক না পেরোতেই সামরিক স্বৈরাচারের বুটের তলায় পিষ্ট গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে এ দেশের মানুষ ৯ বছর রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রাম করে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। সেই দেশটা হাইব্রিড রিজিমের মুখোশের নিচে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পরিনতি জনগণ মেনে নিবে না। পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনা করে আমাদের শাসকশ্রেণী গর্বিত ঢংয়ে বলতে পারেন, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান হবে না। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জনগণ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করতে পারে। পার্লামেন্ট থেকে রাজপথে নেমে এসে চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে। জাপানের জনগণ বছরে দু’তিনবার প্রধানমন্ত্রী বদল করলেও সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা হয়না, উন্নয়নের কোনো হেরফের হয়না। কথিত জাতীয়তাবাদের নামে, দেশপ্রেমের নামে, ধর্মরক্ষার নামে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করার যে প্রবণতা কর্তৃত্ববাদী শাসনে দেখা যায়, মূলত সেই প্রপাগান্ডাই হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও উন্নয়নের আসল প্রতিবন্ধক। ভিনদেশী এস্টাবলিস্টমেন্টের কুশীলবরা এভাবেই দেশের ভেতর ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদকে চরম বৈরীতায় পরিনত করে বিভাজনের মাধ্যমে দেশকে দুর্বল ও পদানত করার সুযোগ লাভ করে থাকে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ এমন আলাদা আলাদা বিভাজন ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক এন্টাগনিজমের শিকার। ইমরান খানই প্রথম পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও ডিপ স্টেটের সামনে দাঁড়িয়ে আপসহীন ‘নো’ বলার সাহস দেখিয়েছেন। যে কারণে যে প্রক্রিয়ায় ১৯৫২ সালে ইরানে মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আবারো রেজাশাহ পাহলভির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল, যে কারণে মিশরে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে হটিয়ে আবারো সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যে কারণে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন ও গণতন্ত্রের প্রতি কমিটেড থাকার কারণে পাকিস্তানে ইমরান খানের রিজিম চেঞ্জ’র পরিকল্পনা হতেই পারে।
তাদের কাছে উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের জুতসই বিকল্প হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্বপ্ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত দেশে বশংবদ শাসক সৃষ্টি করা খুব সহজ। বশংবদ শাসকরা একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করলেও তথাকথিত গণতন্ত্রের সোল এজেন্টদের তেমন কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তাদের কথা না শুনলেই জনগণের একটি অংশের পক্ষ নিয়ে নতুন খেলা শুরু হয়ে যায়। শৃলঙ্কায় অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট, পাকিস্তানে রিজিম চেঞ্জ, মানবাধিকারের নামে বাংলাদেশের র্যাব-পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যের কুশীলব অনেকটা অভিন্ন। এখানে আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক খেলাই মূখ্য। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিশেষ গোষ্ঠিকে ক্ষমতায় রাখা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতা হারানোকে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার মধ্য দিয়ে একটি উত্তুঙ্গ পরিবেশ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে অতীত ও বর্তমানের বাস্তবতা থেকে ধরে নেয়া যায়, বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার ঐতিহ্য একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান রচনা করতে সক্ষম। এ জন্য প্রথমেই একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য ও রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় চীনের ডেব্ট ট্র্যাপ অথবা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া কিংবা সউদি আরব কারো কাছেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা মানবাধিকার বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওরা শুধু ক্ষমতার টোপ হিসেবে এসবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার শুধু বাংলাদেশের জনগণের কাছেই সবচেয়ে কাঙ্খিত ও গুরুত্ববহ। যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে, যে জনগোষ্ঠি লড়াই করে স্বাধীনতা ও অধিকার আদায় করে নেয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত সেই জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই ফলপ্রসূ হবে না। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতি সব রাজনৈতিক দল ও জনসমাজকে অভিন্ন স্থায়ী অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার রিকনসিলিয়েশন খুবই জরুরি বিষয়। শ্রীলঙ্কার বাস্তবতা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষা নিতে হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় অনেক বড় অর্থনীতিও ধসে পড়ার নজির সাম্প্রতিক সময়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের প্রায় আশি শতাংশের ক্রেতা। আরেকটি ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে ইস্যু করে নিষেধাজ্ঞার পরিধি যদি গার্মেন্ট রফতানি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়? এ কারণেই আগামী নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন নিশ্চিত করা ছাড়া চীন-মার্কিন ভূরাজনৈতিক রশিটানাটানির গ্যাড়াকল থেকে মুক্তির বিকল্প কোনো পথ আপাতত আমাদের সামনে নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।