পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষের মানবিক গুণাবলী ও বিবেকবোধ কি কর্পোরেট মিডিয়ার জালে বন্দী হয়ে পড়েছে? তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। বিশ্বের উপর পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদি ব্যবস্থার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে এসব মিডিয়া তাদের ঘোষিত সাধারণ নীতিমালাসমুহকেও প্রায়শ: লঙ্ঘন করে চলেছে। বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের মতলবি তৎপরতার অভিযোগও রয়েছে ফেইজবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর বিরুদ্ধে। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর রমরমা ব্যবসায়িক স্বার্থ ও নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে তা আমাদের অজানা নয়। ভারতজুড়ে হিন্দুত্ববাদিদের সহিংসতা উস্কে দিতে ফেইজুবক স্পষ্টতই বিজেপি’র স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে বলে দু’বছর আগে কয়েকটি মার্কিন মানবাধিকার গ্রæপের তরফ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এ আলোচনায় ভারতে কর্মরত ফেইজবুক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল তাতে খোলাখুলিভাবেই বুঝা গিয়েছিল ফেইজবুক গ্রæপ ভারতের শতকোটি মানুষের বাজার নিজেদের পক্ষে রাখতে স্থানীয় এজেন্টরা ফেইজবুকের নীতিমালার পরিপন্থী ভ’মিকা পালন করেছে। বিভিন্ন দেশে মুসলমান বিদ্বেষী দাঙ্গাহাঙ্গামা বাঁধানোর হুজুগে প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে ফেইজবুকের নেপথ্যভ’মিকা খুবই স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে রাইটস গ্রæপগুলোর তরফ থেকে ভারতের মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গা এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক গণহত্যা তথা এথনিক ক্লিনজিংয়ে মদদ দেয়ার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো পোস্ট নিয়ন্ত্রণ অথবা ভাইরাল করার ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ তৎপরতার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষীয় কর্পোরেট সাপোর্ট অনেক বেশি ফলপ্রসু হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি পোস্টের মধ্যে বেশকিছু পোস্ট ভাইরাল হওয়ার জন্য পটেনশিয়াল হলেও এদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক পোস্ট মূলধারার মিডিয়া লুফে নিয়ে তা বৈশ্বিক সংবাদ শিরোনামে পরিনত করে থাকে। পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদ বা কর্পোরেট পুঁজিবাদের মৌলিক স্বার্থ পরিপন্থী ইস্যুগুলো কখনোই উভয় মাধ্যমে এমন আনুকুল্য পেতে দেখা যায়নি।
সম্প্রতি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে সেনা অভ্যুত্থানসহ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গেছে। এসব ঘটনার সাথে সে সব দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য ও প্রত্যাশার যোগসুত্র থাকলেও কিছু আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সব ঘটনা তেমন সাড়া জাগায়নি। এর মানে কি এই যে, এসব অভ্যুত্থানের সাথে পশ্চিমা কর্পোরেট স্বার্থের যোগসাজশ রয়েছে? উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী উত্তর আফ্রিকার দেশ মরোক্কো দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব গণমাধ্যমে তেমন আলোচিত হয়নি। গত সপ্তাহে দেশটির মধ্যাঞ্চলের এক পাহাড়ি গ্রামে রায়ান নামের ৫ বছরের এক শিশু ১০৪ ফুট গভীর কুপে পড়ে গেলে সেই শিশুটিকে উদ্ধারে নামে সরকারি উদ্ধারকারি দল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেইভরায়ান # হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হওয়া এই ঘটনা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের মূল ধারার প্রায় সব মিডিয়ায় বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। দুর্ঘটনাক্রমে কূপে পড়ে যাওয়া শিশু রায়ানকে বাঁচাতে বিশ্ববিবেক উদ্বেল হয়ে উঠেছিল তা’তে আমাদের অখুশি হওয়ার কিছু নেই। তবে ওরা শিশুটিকে বাঁচাতে পারেনি। এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে সউদি নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রাচ্যের কোয়ালিশন বাহিনীর বিমান হামলায় শিশুসহ অন্তত ১০০ জন সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিক নিহত এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছিল। হুথি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি ডিটেনশন সেন্টারে হামলা চালিয়ে একসঙ্গে শত শত মানুষকে হতাহত করে সউদী বাহিনী। কি আশ্চর্য সে মর্মান্তিক ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা বা প্রতিবাদের ঝড় উঠেনি। দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যায়, হতাহত হয় সে সব রোধ করা হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দের কারণে দেশে দেশে যে সব রাজনৈতিক সহিংসতা, দাঙ্গা-হানাহানি চলছে বিশ্বজনমত ও বিশ্ববিবেক ঠিকমত কাজ করলে সে সব বন্ধ করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। দেশের সম্পদের সুরক্ষা ও সুষম বন্টনের প্রশ্নে শাসকরা যা করতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপরীত। এই বৈপরীত্যের মাঝখানে রয়েছে পশ্চিমা কর্পোরেট স্বার্থের মতলবি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সেখানে কর্পোরেট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের মত সংস্থাকে এই চক্রের মন রক্ষায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। মন্দের ভালো দিক হচ্ছে, কর্পোরেট, ইম্পেরিয়াল ও জায়নবাদি স্বার্থের বিপক্ষে গেলেও অনেক কিছুই এখন আর গোপন রাখা যাচ্ছে না। সত্তুর বছর ধরে চলতে থাকা জাতিগত নিধন ও আগ্রাসি নিপীড়নের মধ্যেও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম দমিয়ে দেয়া যায়নি। পশ্চিমা কপোর্রেট মিডিয়ার উপর জায়নবাদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে বিশ্বের চোখ সেখানে ফোকাস হতে না পারলেও আস্তে আস্তে সবকিছু সবার সামনে খোলাসা হয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলী বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসন ও নিপীড়নের তথ্যপ্রমান ভিত্তিক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, ২৮৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এই রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ ও ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণ। সত্তুর বছর ধরে চলা অব্যাহত সামরিক আগ্রাসনের পরও মুসলমানদের জনপদ হিসেবে ফিলিস্তিন কখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। হাতে বানানো রকেট হামলার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শত শত বোমা হামলা, বিমান হামলা করে গাজা ও পশ্চিম তীরের বহু পুরনো জনপদকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করার পর স্বপ্নবাজ ফিলিস্তিনীদের আবারো নিজের শহরকে গড়ে তুলতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে নাকবা বা অভিশপ্ত কালোরাত্রিতে ইউরোপ থেকে জাহাজে জায়নবাদি হাগানা মিলিশিয়ারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসে ফিলিস্তিনি জনপদের উপর বুলডোজার চালিয়ে কামান-বন্দুকের বিভীষিকায় লাখ লাখ ফিলিস্তিনী বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সেই থেকে প্রতিবেশি দেশগুলোর আশ্রয় শিবিরে থাকা ফিলিস্তিনীরা একদিনের জন্যও তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম থামিয়ে রাখেনি। জায়নবাদি শক্তির আস্ফালন কি শুধু ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থনেই ৭০ বছর ধরে টিকে থাকা সম্ভব ছিল, নাকি এর পেছনে ইসরাইলের সাথে শক্তিশালী আরবদের গোপন সমঝোতা ও নেপথ্য সমর্থন কাজ করছে? এ প্রশ্নের জবাব এখন প্রায় সবারই জানা। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদী ও পেট্টোডলারের কর্পোরেট পুঁজিবাদি স্বার্থের সাথে জায়নবাদি কতিপয় আরব রাজ পরিবারের গোপণ সমঝোতার শত বছর পেরিয়ে এসে যখন অনৈতিক জায়নবাদি রাষ্ট্রের ভিত্তি টালমাটাল হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির নতুন নীলনকশা সামনে এনে মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। ফিলিস্তিনের জনগণের পাশাপাশি বিশ্বসম্প্রদায় সেই প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যে এবং গোপণে ইসরাইলীদের সাথে শর্তহীনভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নামে ভন্ডামিতে লিপ্ত হয়েছে। সেখানে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার ইস্যুটিকে গলাটিপে হত্যার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। বলাবাহুল্য ইসলাম বিদ্বেষী এসব আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো শাসক জড়িত থাকলেও সে সব দেশের সাধারণ জনগণের ন্যুনতম অংশেরও সমর্থন নেই। অপরপক্ষে ইরানি সামরিক-কৌশলগত সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিন ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হেজবুল্লাহ ও হামাস ইসরাইলী সামরিক দানবকে বার বার রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, নতুন বিশ্ববাস্তবতার আলোকে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরাইলী বাহিনীর আধিপত্য এক সপ্তাহের মধ্যেই চুর্ণ করে দেয়া সম্ভব। আফগানিস্তানে তালেবানদের হাতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর পরাজয়, সিরিয়ায় পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহী ও প্রক্সি বাহিনীর পরাজয় এবং ইয়েমেনে হুতিদের হাতে সউদী কোয়ালিশন বাহিনীর নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে সহজেই বুঝা যায়- ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বা পশ্চিমা বাহিনীর দাদাগিরির সময় আর নেই।
ইরান বা তুরস্ককে বাদ দিলে মধ্যপ্রাচ্যের বড় দেশগুলো প্রকৃত অর্থে স্বাধীন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। পশ্চিমাদের বড় অর্থনৈতিক ও ভ’-রাজনৈতিক স্বার্থের বরকন্দাজ মধ্যপ্রাচ্যের রাজারা অন্য ছোট দেশগুলোর উপর আধিপত্যবাদী দাদাগিরির এজেন্সী পাচ্ছে। ইয়েমেনে আরব বষন্তের হাওয়া সে দেশের রাজনীতিতে ইরান সমর্থিত হুতিদের প্রভাব বাড়িয়ে দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইয়েমেনের ক্ষমতায় থাকা প্রথম প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ্র পতন ঘটে। সালেহ্র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুররাব্বু মানসুর হাদির প্রতি সউদি শাসকদের সমর্থন তাঁকে ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেয়। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মত ইয়েমেনে হাদীর অন্তবর্তি সরকারকে সমর্থন দিয়ে সউদি আরব সেখানে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ইরান সমর্থিত হুতিদের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নব্বইদিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও হাদী দুই বছরের অন্তবর্তিকালীন সরকারের প্রস্তাব পাস করেন এবং হুতিদের নির্বাচন বর্জন এবং আন্দোলনের মধ্যেই তিনি নিজেকে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এসবই করা হয় প্রতিবেশি দেশ সউদি আরবের সমর্থনে। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট ও রাজনৈতিকভাবে সুসংহত হুতিদের বিরোধিতা, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহর সমর্থকদের বিরোধিতা ছাড়াও হাদীর নিজ রাজনৈতিকদল জেনারেল পিপল্স কংগ্রেসের সমর্থন হারানো সত্বেও রাজনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল ও অজনপ্রিয় হাদীকে দিয়ে হুতি নিধনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করাতে চেয়েছিল সউদি আরব। একপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসার দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালে গণআন্দোলনের মুখে জনরোষ থেকে বাঁচতে তিনি সউদি আরবে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত ৭ বছর ধরে তিনি সউদি আরবে অবস্থান করছেন। ইয়েমেন যুদ্ধকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদী নীলনকশার একটি নতুন চ্যাপ্টার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ওয়ার অন টেররিজমের ধারাবাহিকতায় ইরাক-আফগানিস্তান দখল, আরব বষন্তের টালমাটাল বাস্তবতা, লিবিয়ায় বিদ্রোহ, মিশরে হাজার বছরের মধ্যে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসি সরকারের পতন ঘটিয়ে সেখানে সামরিক স্বৈরশাসন কায়েম, সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী বিদ্রোহ, আইএস সন্ত্রাসসহ প্রতিটি সংঘাতে ইরানের পরোক্ষ প্রভাবে ইসরাইল ও পশ্চিমা নীলনকশা ভেস্তে গেছে। সেখানে ইয়েমেনে ইরান প্রভাবিত আনসারাল্লাহ বা হুতিদের দমনে সউদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম সামরিক জোট গঠন করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
গত ১লা ফেব্রæয়ারি(২০২২) ব্রæকিংস অনলাইনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘দ্য হুতিজ হ্যাভ ওন ইন ইয়েমেন: হোয়াট নেক্সট? এই নিবন্ধের লেখক একজন সিনিয়র পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ এবং সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার- ব্রæস রিডেল। ইয়েমেন যুদ্ধকে তিনি ইয়েমেনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন, গ্রন্থের নাম ‘আমেরিকা অ্যান্ড দ্য ইয়েমেন: অ্যা ট্রাজিক এনকাউন্টার’। ইয়েমেনে হুতিদের ক্রমবিকাশ এবং মার্কিন বিরোধি যুদ্ধে বিজয়ের ইতিহাস বর্ননা করতে গিয়ে ব্রæস রিডেল দেখিয়েছেন সেই ষাটের দশকের শুরুতে ইয়েমেনে মুতায়াক্কিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মিশর সমর্থিত আরব জাতীয়তাবাদি অভ্যত্থান সংঘটিত হয়। রিপাবলিকান বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সউদি আরব ও ইসরাইল জায়দি বিদ্রোহীদের সমর্থন যোগায়। সংঘাতে শেষতক মিশর ও সোভিয়েত সমর্থিত রিপাবলিকানরাই বিজয়ী হয়। আবু আব্দুল্লাহ সালেহ তিন দশক ধরে সেই বিজয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। ইরাক যুদ্ধে মার্কিনীদের ইরাক দখলের বাস্তব প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইয়েমেনে কট্টর মার্কিন বিরোধী ইসলাম পন্থী আনসারাল্লাহ বা হুতিদের কার্যক্রম জোরদার হয়ে ওঠে এবং ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। এভাবেই আফগানিস্তানের পর ইয়েমেনে মধ্যপ্রাচ্যের সম্মিলিত বাহিনীকে দুর্বল, দরিদ্র ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধাদের কাছে চরম এনকাউন্টারের সম্মুখীন হয়ে পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে।
সউদি আরবের নেতৃত্বে প্রায় ১২টি আরবদেশের সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন যুদ্ধে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে। গত ৭ বছরে সেখানে ন্যুনতম রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারলেও ইতিমধ্যে ইয়েমেনকে বিশ্বের অন্যতম মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। ইউনিসেফের দেয়া তথ্য অনুসারে গত সাত বছরে সেখানে সউদি বাহিনীর বিমান হামলায় ১০ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। চল্লিশ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুহীন হয়েছে। এই মুহুর্তে ইয়েমেনের ২১ মিলিয়ন বা দুইকোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ নানাবিধ সংকটে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে ধুঁকছে। বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন পাদপীঠ ইয়েমেনের নাগরিকরা সব সময়ই ধার্মিক ও শান্তিপ্রিয়। তারা কখনো প্রতিবেশি সউদি আরবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। সেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিজেদের বশংবদ স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হুতিদের প্রতিরোধে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট আরব বাহিনী। এখানে আবারো প্রমানীত হল, স্থানীয় ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল ও আধ্যাত্মিকভাবে নিবেদিত শক্তির কাছে বিশ্বের যে কোনো সামরিক শক্তিকে পরাজিত হতে হয়। তবে নেপথ্যের শক্তি হিসেবে জায়নবাদিরা এটা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে, ফিলিস্তিনের নাকবাসহ গত ৭০ বছরে যত হত্যাকান্ড, মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, গত ৭ বছরে মুসলমান আরব প্রতিবেশিরা ইয়েমেনে তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক বিপর্যয় ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। আঞ্চলিক ও পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর এসব নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বিমান হামলায় শত শত মানুষ হত্যার চেয়ে দুর্ঘটনায় কুপে পড়ে যাওয়া শিশু উদ্ধারের লাইভ সম্প্রচার যেন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যাকে বার বার প্রচার করে সত্য বলে চালিয়ে দেয়া এবং একটি তুচ্ছ ঘটনার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে আরেকটি বড় ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার এই কৌশল তারা নাৎসী প্রচারমন্ত্রী গোয়েবল্স এর কাছ থেকে শিখেছিল। কিন্তু শুধু প্রচারনা দিয়ে পরাজয় ঠেকিয়ে রাখা যায় না। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে তা ধারাবাহিকভাবে প্রমানিত হয়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।