Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আফগানিস্তানে খাদ্য সহায়তা বাড়াতে হবে

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

খাদ্য সহায়তা না দিলে আফগানিস্তানের কয়েক মিলিয়ন মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়বে বলে সর্তক করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্যকর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি)। দুর্ভিক্ষের কথা জাতিসংঘ বলছে না। তবে অনেকে এ ধরনের আশঙ্কার কথাও বলছেন। আফগানিস্তানে ২২ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে আছে। ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। আফগানিস্তানের অর্থনীতি পুরোপুরি বিদেশি সহায়তা নির্ভর। জিডিপির ৪০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে আসে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে কোনো দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে এলে সেটি দাতানির্ভরদেশ হিসেবে বিবেচিত। খাদ্য সংকট তৈরি করে প্রতিপক্ষকে দমানো একটি পুরানো কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে কুলিয়ে উঠতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলেও শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হিসেবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালেবান সরকারের ওপর।

শীত যতই এগিয়ে আসছে আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট তত বাড়ছে। হু হু করে আফগান শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ছে। টাকা দিলেও খাদ্য মিলছে না অনেক সময়। সাধারণ মানুষের হাতে টাকাও নেই। যা পারছে তা বিক্রি করে খাবার সংগ্রহ করছে। অনেকের ধারণা ছিল, আফগান যুদ্ধ বুঝি শেষ। মার্কিন সৈন্য বাড়ি গিয়েছে। তালেবান ফের আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছে। সব কিছু আগের মতো চলবে। এটা সত্য যে, আফগানিস্তানে তালেবানের নিরঙ্কুশ আধিপাত্যে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় তালেবানের হাতে নেই। যেমন সাধারণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পক্ষে সবার জন্য খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করা সহজ বিষয় নয়। আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট বৈশ্বিক রাজনীতি বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট কৃত্রিম এবং আরোপিত। তালেবানদের শায়েস্তা করার একটা কৌশল মাত্র। একইভাবে আফ্রিকানদের শায়েস্তা করা হয়েছিল গত শতকে। এখন পর্যন্ত তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও খাদ্য সংকটে ডুবে আছে আফ্রিকানরা। তবে তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে এ অবস্থা নাও হতে পারে। মিত্র রাষ্ট্রগুলো থেকে কিছু খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে এবং পাবে তালেবান। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো খাদ্যসংকট হওয়ার কথা নয়। যুদ্ধ ছাড়া ওই অঞ্চলে এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি যে খাবার নিয়ে চারিদিকে হাহাকার শুরু হবে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তা প্রবাহ থমকে আছে। আইএমএফ আফগান সরকারের বিদেশে গচ্ছিত সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ। ফলে তালেবান সরকারের গচ্ছিত সম্পদ ব্যবহার করতে পারছে না। বিবিসি জানিয়েছে, অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারির বেতন আটকে আছে। ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না অনেকে। অনেকে খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। সেপ্টেন্বরে মাত্র ৫ শতাংশ আফগানের হাতে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ছিল। যদিও গত সেপ্টেন্বরে জেনেভায় দাতাদের বৈঠকে এক বিলিয়ন ডলারেরর খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। অক্টোবর পর্যন্ত খাদ্য সহায়তার এক তৃতীয়াংশও পৌঁছায়নি। এই হচ্ছে আফগানিস্তানের খাদ্য সহায়তার সর্বশেষ পরিস্থিতি।

কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের ওপর বসে থেকেও বর্তমানে অসহায় আফগানরা। অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। প্রায় ৬ লাখ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটারের আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটির ১ হাজার ৪০০-এর বেশি বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। খনিজগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, মতান্তরে সেটা ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সোনা, রূপা, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ছাড়াও রয়েছে উচ্চমানের পান্না, রুবি, নীলকান্সমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্নপাথরের মজুদও। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) গবেষণা অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন তামা, ২ দশমিক ২ বিলিয়ন টন লোহা, ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন দুর্লভ বস্তু রয়েছে। আর রয়েছে সোনা, রূপা, দস্তা, পারদ ও লিথিয়াম। সেখানে এত বেশি পরিমাণ লিথিয়াম আছে যে, দেশটি বিশ্বের লিথিয়ামের রাজধানী হয়ে উঠতে পারে। দুর্লভ বস্তু বা বেয়ার আর্থইলিমেন্ট (আরইই) হচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর আকর্ষণীয় বস্তু। মুঠোফোন বা ল্যাপটপ থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট, এমনকি হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে আরইই ব্যবহার করা হয়। হাইটেক শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরইইয়ের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ও আফগানিস্তানের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (এজিএস) একটি যৌথ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শুধু উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে আনুমানিক ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্রাস এবং ৫০০ মিলিয়ন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। মূল্যবান রত্ন পাথরের পাশাপাশি আফগানিস্তানে সোনারও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। শতাব্দিকাল ধরে আফগানিস্তানের গজনি, কাবুল, কান্দাহার, তাখার প্রদেশসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে সোনা উত্তোলন করা হচ্ছে। তালেবান সরকার যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ মেলে তাহলে নিজস্ব সম্পদেই আফগানিস্তান একটি স্বনির্ভর দেশ হতে পারবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এ দেশটির প্রতি অনেকের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। তারা চাইছে কোনভাবে যদি আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশটি ভিন্ন কায়দায় দখল করা যাবে। মানবিক সহায়তার নামে পশ্চিমারা আবার জেঁকে বসতে পারে। তবে মিত্রদের সহায়তা নিয়ে তালেবান যদি পরিস্থিতি দক্ষভাবে মোকাবেলা করতে পারে, তাহলে আফগানযুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবে। সামরিক পর্ব শেষে আফগানযুদ্ধ এখন বেসামরিক পর্বে প্রবেশ করেছে। সামরিক আগ্রাসন আফগানিস্তানে ব্যর্থ হয়েছে। এখন যদি সামাজিক উন্নয়ন ও খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত হয়, রাজনীতি গঠনমূলক ও সহনশীল হয় তবে নতুন এক আফগানিস্তান আমরা দেখতে পাবো।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন