পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মতো রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যের যথেচ্ছ অপরাধমূলক তৎপরতার কারণে মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ ও আস্থার সংকটে পতিত হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে মূল রুটগুলোকে অরক্ষিত রেখে এবং মাদকের সাথে জড়িত রুই-কাতলা- রাঘববোয়ালদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে সাধারণ নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য। মাদক আইনের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার করে তারা মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার নানা রকম তৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এ জন্য ২০১৮ সালে সংশোধিত মাদক আইনের কিছু অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতার পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। মাদকের গডফাদার ও মূল রুটগুলো বন্ধ না করে শুধুমাত্র খুচরা বিক্রেতা এবং সেবনকারীদের ধরে এর বিস্তার বন্ধ করা যাচ্ছে না। উপরন্তু মাদকের সন্দেহভাজন হিসেবে নিরীহ সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়ার অভিযোগ বেড়েই চলেছে। মাদক কারবারের সাথে জড়িত কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি, সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার মূল আসামি প্রদীপ কুমার দাশের মাদকের বানোয়াট অভিযোগ তুলে বহু মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি ও নারী ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর তৎপরতায় জড়িত থাকার তথ্য উঠে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের এ হেন অপকর্মের সংখ্যা মোটেই কম নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁকফোঁকড় গলিয়ে তারা যাচ্ছেতাই করছে। কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ‘সন্দেহ’, ‘অনুমান’ বা ‘বিশ্বাস’ই যথেষ্ট যে কোনো ব্যক্তির গ্রেফতারের জন্য। আইনের এই অধিকারের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের নাগরিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে। পক্ষান্তরে মাদকের গডফাদার এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত চক্র শত শত কোটি টাকার মাদক বাণিজ্য অব্যহত রাখতে অপরাধের জাল বিস্তার করে রাখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সীমান্তরক্ষীদের সাথে মাদক মাফিয়াদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সীমান্তে সাধারণ কৃষক, রাখাল বা সাধারণ মানুষ প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে নিহত হলেও সীমান্তে গড়ে ওঠা মাদকের কারখানা ও মাদক চোরাচালানকারীরা অধরাই রয়ে যায়। এর ফলে মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার যতই কঠোর আইন করুক না কেন, আইন প্রয়োগে পুলিশের অনাকাক্সিক্ষত ব্যত্যয় ও ফাঁক-ফোঁকড়ের কারণে মাদকের বিস্তার রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেশের যুব সমাজের মধ্যে মাদকের ক্রমবর্ধমান বিস্তার সমাজে নানাবিধ সংকটের জন্ম দিচ্ছে। পারিবারিক কলহ, সামাজিক অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির নেপথ্যে বড় ভূমিকা পালন করছে মাদক। মাদক আইনের অসঙ্গতি এবং মাদক সম্পর্কিত তৎপরতার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যের অপরাধমূলক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই।
দেশের সব সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করার দায়-দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা কমিয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো যথাযথভাবে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে পুলিশকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। মাদকের পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধেও পুলিশের ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার দেখা যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা আইনগত নিরপেক্ষতা এবং ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দ্বারা পরিচালিত হলে সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। সর্বব্যাপী দুর্নীতি, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, অর্থপাচার, মাদক চোরাচালান, মানব পাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন কমিশন, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরে যেমন ড. বেনজির আহমেদের মতো মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন, একইভাবে দুদকসহ অন্যান্য বিভাগেও অনেক দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন। সর্বাগ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অসততার অভিযোগ মুক্ত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইমিগ্রেশন গণহয়রানির রীতিমত আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিমানযাত্রী, প্রবাসী কারো ইমিগ্রেশনে অনিয়ম ও হয়রানি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। দুদকের কর্মকর্তাদেরও অনেকে ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বলা যায়, বিনা অর্থ ও হয়রানিতে কোথাও সেবা পাওয়া যায় না। মাদকসহ আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধের সাথে জড়িত ও সম্পৃক্ত সকলকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়ায় অপরাধী পুলিশ, দুর্নীতিবাজ ইমিগ্রেশন অফিসার, মতলববাজ দুদক কর্মকর্তাদের ধরতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ছাড়া আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আইনগত অস্বচ্ছতাসমূহ দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালার অনুসরণ ছাড়া যে কোনো ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তকেই বিদেশ গমন রোধ বা পাসপোর্ট জব্দ করার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। অপরাধের ধরন ও মাত্রা সাপেক্ষে আইনগত উপায়ে ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুদকের ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইনের অস্পষ্টতা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, কারো বিদেশ যাত্রা রোধ করতে দুদকের সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি না থাকায় এ বিষয়ে বিশেষ জজ আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।