পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নিবাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষ, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। মারামারি, হামলা-পাল্টা হামলা, দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার, গুলি, বোমা বিস্ফোরণ ইত্যাদি ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগে-পরে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি। মোট ৩১ জন এই ধাপে প্রাণ হারিয়েছে। প্রথম ধাপে প্রাণহানির সংখ্যা ৫। আরো ৩ জন বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছে। এই দুই ধাপের নির্বাচনে আহত হয়েছে কমপক্ষে হাজার খানেক মানুষ। ইউপি নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। ফলে নির্বাচনটি আদতে একদলীয় নির্বাচনে পর্যবসিত হয়েছে। তাই নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষ যা কিছুই হচ্ছে, তা হচ্ছে মূলত সরকারি দলের মধ্যে। এপর্যন্ত যারা হতাহত হয়েছে তাদের অধিকাংশই সরকারি দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক। বাকীরা সাধারণ মানুষ। দেখা গেছে, যেখানেই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, সেখানেই দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি অগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। দেখা গেছে, দেশীয় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণহানির চেয়ে গুলিতে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যবেক্ষকদের মতে, দলের মধ্যে কোন্দল, দলীয় মনোনয়ন বঞ্চনা। আধিপত্য বিস্তার এবং অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে এই সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটছে। এ নির্বাচন উপলক্ষে অবৈধ অগ্নেয়াস্ত্রের বাজার চাঙ্গা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। বলা হয়েছে, আইনশৃংখলা বাহিনী শ’ শ’ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র ব্যবহাকারীদের অনেককে আটক করলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ইউপি নির্বাচনই র্টাগেট। বিগত মাসগুলোতে পত্রপত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সীমান্তের ওপর থেকে অবাধে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, বিশেষ করে ক্ষুদ্রাস্ত্র অনুপ্রবেশ করছে। গতকালও একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, সীমান্তের ১১টি রুট দিয়ে দেশে অস্ত্র ঢুকছে। ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ক্ষুদ্রাস্ত্র পলিথিনে মুড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে দেয়। তারা সেই অস্ত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধানখেতে পুঁতে রেখে যায়। বাংলাদেশের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সেই অস্ত্র নিয়ে আসে। এভাবেই ভারত থেকে অবৈধ অস্ত্র আসছে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাত, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, রাহাজান ও রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
এটা দেশের আইনশৃংখলা, শান্তি ও নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সম্প্রতিককালে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ সংঘটনে আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার হতেও দেখা যাচ্ছে। যখন আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যায় কিংবা বেড়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তখন আইনশৃংখলা বাহিনীর তরফে অস্ত্র উদ্ধার ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে অভিযান বা বিশেষ অভিযান চালানো হয়। অনেক দিন হলো আইনশৃংখলা বাহিনীর ‘অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান বা বিশেষ অভিযান’ লক্ষ করা যাচ্ছে না। দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটা একটা কারণ বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সাধারণত কোনো নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে বৈধ অস্ত্র জমা রাখা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে থাকে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বৈধাবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যাতে না হতে পারে, সে লক্ষ্যেই নির্বাচন কমিশন এ নির্দেশ দিয়ে থাকে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ প্রতিপালন করতে বাধ্য। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন বৈধ অস্ত্র জমা রাখা কিংবা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানোর জন্য আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্র্তৃপক্ষকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতেও নির্বাচন কমিশন এ নির্দেশনা দেয়নি। এটা কি বর্তমান কমিশনের অজ্ঞতা, নাকি অবহেলা-উপেক্ষা? এই যে সংঘাত-সহিংসতায় এতগুলো মানুষ হতাহত হলো, তার দায় কে নেবে? নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারবে না। দায় এড়াতে পারবে না স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশও। আইনশৃংখলা সুরক্ষার দায়িত্ব প্রশাসন ও পুলিশের। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতার সময় প্রশাসন ও পুলিশ নিরব ভূমিকা পালন করেছে। আগাম, তাৎক্ষণিক ও পরবর্তী কার্যব্যবস্থা যথাযথভাবে গৃহীত হলে এত মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা হয়তো ঘটতে পারতো না।
অবৈধ অস্ত্র রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের হাতে চলে যাওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, তা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও গণপীড়নে এর ব্যবহার যেমন হতে পারে তেমনি ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধ সংঘটনেও ব্যবহৃত হতে পারে। ইউপি নির্বাচন উপলক্ষে যেসব কর্মী-সমর্থকের হাতে এখন অবৈধ অস্ত্র ঘুরছে, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা অনুরূপ কাজে এবং অপরাধকর্মে ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? পর্যবেক্ষকদের মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের সমাবেশ ও ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অনেকটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায়ই বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচন এরকমই হবে। বিরোধী দল থাকুক বা না থাকুক সরকারি দলের মধ্যেই মারামারি হবে। আরো হবে। এরপর যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তখন আরো মারামারি হবে। নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে না। বলা বাহুল্য, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেÑ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। একদলীয় ও একতরফা নির্বাচন উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ‘গৌরব’ অর্জন করেছে। এ নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে শেষ করে দিয়েছে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নেই করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনেরই অন্যতম সদস্য মাহবুব তালুকদার স্বয়ং বলতে বাধ্য হয়েছেন, দেশে প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে এবং গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে। এ অবস্থার পরিবর্তন কীভাবে হবে, কবে হবে, কে জানে! তবে পরিবর্তন হওয়া যে আবশ্যক ও জরুরি, তাতে দ্বিমত নেই। এমুহূর্তে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার দেশে যে ঝুঁকি তৈরি করেছে, তা উৎসাদনে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর অভিযান চালানোর বিকল্প নেই। এইসঙ্গে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ রূপে রহিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।