Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যাকাণ্ড আর কত

| প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ‘শূন্য’তে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর বিএসএফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল রাকেশ আস্তানা সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার আগের বছরের জুনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ শীর্ষ কনফারেন্সে বিএসএফ প্রধান রজনী কান্ত মিশ্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার। দেখা যাচ্ছে, দুই দেশের সরকার প্রধানের যৌথ ঘোষণা এবং বিএসএফ প্রধানদের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনা যায়নি। বলা যায়, বিএসএফ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। সীমান্তে সে বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা অব্যাহত রেখেছে। গত ৩ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তে বিএসএফ দুই বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ১০ দিনের মাথায় গত শুক্রবার লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বুড়িরহাট সীমান্তের কাছে বিএসএফ আরও দুই বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বিএসএফ বলছে, ভারত থেকে গরু চোরাচালানকারী দল সীমান্ত পার হওয়ার সময় তারা গুলি চালিয়েছে। গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত হওয়ার পাশাপাশি এক ভারতীয়ও নিহত হয়েছে। কোচবিহার দিনহাটা আসনের তৃণমূলের নির্বাচিত এমএলএ উদয়ন গুহ এ ঘটনার জন্য বিএসএফকে দায়ী করে বলেছেন, বিএসএফের মদদ ছাড়া সীমান্তে পাচার সম্ভব নয়। প্রায় গোটা অঞ্চলই কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। স্টিলের রড দিয়ে মোড়া কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে কী করে পাচার হয়, তা নিয়ে সবারই প্রশ্ন আছে। তিনি বলেছেন, বিএসএফের সদস্যরা চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকতে পারে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে অনাকাক্সিক্ষত আখ্যায়িত করে বলেছেন, বিএসএফকে সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর সীমান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বের আর কোথাও এমন সীমান্ত নেই। ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার। এই সীমান্ত জুড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে। তার এ হত্যাকাণ্ডের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয় চোরাচালানকে। অথচ বিএসএফ এমনও বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে, যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজ জমিতে কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল কিংবা নিজ পানিসীমায় মাছ ধরছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে গুলি চালিয়ে বিএসএফ বহু বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সব হত্যাকাণ্ডের দায় চোরাচালানের ওপর চাপানো একটা অজুহাত মাত্র। এবারও ১০ দিনের মধ্যে ৪ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনাকে চোরাচালানের ওপর চালানো হয়েছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসও আপত্তি জানিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ফিরহাদ হাকিম অভিযোগ করেন, বিএসএফ সীমান্তের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, যাতে তারা সংসদ নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেয়। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএসএফ বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। অথচ এ বাহিনী যে অভিযোগের ভিত্তিতে গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করে তা কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাদের মতে, প্রয়োজন হলে বিএসএফ ‘নন লিথেল’ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফ ৯ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সাম্প্রতিক ৪ জনকে হত্যার মাধ্যমে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ জনে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিএসএফ ১২৩৬ বাংলাদেশীকে হত্যা এবং ১১৪৫ জনকে আহত করেছে। দুই দেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যায়’ থেকে শুরু করে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কের সাথে তুলনা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত শুক্রবার এ সম্পর্ককে ‘অতুলনীয়’ এবং ‘জাদুকরী’ সম্পর্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ সম্পর্কের এত উচ্চমার্গীয় অবস্থানের পরও বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। একদিকে অতুলনীয় সম্পর্ক অন্যদিকে গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা, এমন বিপরীত চিত্র বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। বিশ্বের অনেক দেশের সাথেই অনেক দেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে। ভারতের সাথে নেপাল, ভুটানের মতো ল্যান্ডলকড দেশের সীমান্ত রয়েছে, সেখানে কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যার কথা শোনা যায় না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা রয়েছে, যে দুর্বলতা সীমান্ত হত্যার প্রধান কারণ।

বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যে ধরনের সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে এবং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার বাস্তবায়ন এ সম্পর্কের সূত্র ধরেই করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ। সীমান্তহত্যাকাণ্ড বন্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কয়েকদিন পরপর বিএসএফ খোড়া অজুহাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করবে এবং নিজের মতো ব্যাখ্যা করে জায়েজ করার অপচেষ্টা করবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা বন্ধুত্বেরও নিদর্শন হতে পারে না। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের তরফ থেকে অবিলম্বে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্ঘাটনে উভয় দেশের কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন