পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বাত্মক পদক্ষেপ সত্ত্বেও ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক আগ্রাসন। গডফাদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের হাত ঘুরে ভয়ংকর সব মাদক পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার কাছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বোকা বানিয়ে সাইবার জগতে এখনো বসছে নিয়মিত মাদকের হাট। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ৯ শতাধিক গডফাদারসহ ১০ হাজার মাদক ব্যবসায়ীর বিপরীতে র্যাব-পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ রাষ্ট্রের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মাদক অধিদফতর কর্মকর্তাদের একাংশের সততার সংকট মাদক ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখছে। উভয় পক্ষের মুনাফার ঝুলি ক্রমে স্ফীত হচ্ছে। একই কারণে এ-সংক্রান্ত মামলার যথাযথ তদন্তও হয় না। রাঘববোয়াল না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরা হয়। মামলায় শুধু বহনকারী এবং তার ওপরের দু-এক জনের নামই অভিযোগপত্রে আসে। গডফাদার কিংবা তার ঠিক পরের স্তরের ব্যবসায়ীদের নাম আসার উদাহরণ খুবই বিরল। যে কারণে অলিগলিতেই মিলছে ক্রেজি ড্রাগস ইয়াবা, হেরোইন-ফেনসিডিল। মাদক আগ্রাসন থামাতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রদীপ গংদের নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা পেয়েও সরকারের বদলে নিজেদের মাদক ব্যবসায়ীদের কর্মচারী ভাবেন তাদের চাকরিচ্যুতই নয়, শাস্তির ব্যবস্থা করাটাও জরুরি। এটা সম্ভব হলে মাদক আগ্রাসন থামবে।
দেশব্যাপী মাদকের ভয়াবহতা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি এ বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিও লক্ষণীয়। সরকার এর আগের মেয়াদের শেষ দিকে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহু মানুষ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছিল। অবশ্য তাতে মাদকদৌড়াত্ম্য এতটুকু কমেনি। মাদক ব্যবসায়ীরা সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিল সরকার। ২০১৮ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মাদকের ব্যবহার, পরিবহন, চাষাবাদ, উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল পাস করা হয়। এ বিষয়ে সরকার এতটাই কঠোর ছিল যে, ওই বিলের ওপর দেয়া বিরোধী দলীয় সদস্যদের সংশোধনী, জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছিল। তবে এরপরও মাদক ব্যবসা বা এর প্রসার যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। মাদকের অবৈধ ব্যবহার শূন্যের কোটায় আনতে মাদকবিরোধী প্রচারণা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে মাদকের অপব্যবহার বন্ধে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে।
মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এটি অনুধাবন করেই মাদকনির্মলে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন মাদককারবারের সাথে জড়িত। তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজধানীতেও মাদকব্যবসা রমরমা। মাদকের জগতে এক সময় ‘হেরোইন’ নামক মরণ নেশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান নেশাসক্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশাদ্রব্য বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়ক-এমন কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এই মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে-মধ্যে ছোটখাট মাদক কারবারী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।