পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উপসাগরীয় ছোট দেশ কাতার। আয়তন মাত্র ৪৪১৬ বর্গমেইল। একসময়কার দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় জর্জরিত দেশটি এখন বিশ্বরাজনীতিতে বেশ আলোচিত। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করে দেশটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে।
তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসে ভরপুর দেশটি তাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়েছে ভালোভাবে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় করা দেশ হিসেবে দেশটি পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে কাতারের বিপুল বিনিয়োগ। ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে কাতার। দেশটিতে বেকার নেই বললেই চলে।
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আরব বসন্তের সূচনা হলে কাতারের অবস্থান ছিল সৌদি-আরব ও আরব আমিরাতের বিপরীতে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে ব্যাপক ভিত্তিক সহযোগিতা ও সমর্থন দেয় কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা কাতার কতৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের পক্ষে ব্যাপক কাভারেজ দেয় আল-জাজিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সবসময় চাইতো, ইসলামি দলগুলির সাথে গোপন সম্পর্ক তৈরি করতে। কাতার এক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করে ও উভয় পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ইসলামপন্থী দলগুলির প্রতি কাতারের একতরফা সমর্থন ভালো চোখে দেখেনি সৌদি ও আরব আমিরাত। এমন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইন কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে পাঠায়। অবশ্য, পরবর্তীতে তারা আবার কাতারে ফিরে আসে। এভাবে জিসিসির সদস্য দেশগুলোর মাঝে একধরনের বৈরিতা দেখা দেয়। এরপর ২০১৭ সালের জুন মাসে এসব দেশ কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে। তারা কাতারের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করে। ফলে জিসিসিতে কাতার একঘরে হয়ে পরে। তবে তুরস্ক ও ইরানের সহযোগিতায় কাতার পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়।
কাতারে রয়েছে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি। আগে থেকেই কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের অগ্রবর্তী সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। এই ঘাঁটিতে দশ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা, প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে। এভাবেই ঘাঁটি স্থাপন করতে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয় কাতার। এদিকে অবরোধ প্রত্যাহারে আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ, তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করাসহ ১৩টি শর্ত দেয় সৌদি-আমিরাতের নেতৃত্বাধীন অবরোধ আরোপকারী দেশসমূহ। তবে কাতার এসব শর্ত মেনে নেয়নি। কাতার তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে বেশ জোর দেয়। কারণ, সৌদি ও আমিরাত কাতারে সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দিয়েছিল। ফলে কাতার সামরিক ও বিমান বাহিনীর আধুনিকীকরণে জোরালো উদ্যোগ নেয়, যা অব্যাহত আছে। কাতার তার বিমানবাহিনীতে ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল, মিরেজ-২০০০, যুক্তরাজ্যের টাইফুন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কর্তৃক নির্মিত এফ-১৫ যুদ্ধবিমান যুক্ত করছে। এতে সামরিক শক্তিতে সৌদি-আমিরাতের সাথে ছোট দেশ কাতারের শক্তির পার্থক্য কমেছে। এছাড়া কাতার তুরস্ক থেকে উন্নত ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ, পেট্রোল বোট কিনেছে। একইসাথে কাতার স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীকেও শক্তিশালী করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।
বিশ্বরাজনীতিতে কাতারের বড় ভূমিকা এখন সফল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগান শান্তি আলোচনায় তালেবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতা করে কাতার। এই শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করে কাতার বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের ভাবমর্যাদা ও গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। এর আগে এই শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিল আরব আমিরাত। কিন্তু আরব আমিরাতের উপর তালেবানের আস্থা না থাকায়, তালেবান এতে রাজি হয়নি। মনে করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে আমিরাতের ভূমিকার কারণে তালেবান আমিরাতের উপর ভরসা করতে পারেনি। পরে কাতারের দোহায় তালেবানকে রাজনৈতিক কার্যালয় খোলার অনুমতি দেয় কাতার সরকার। কাতারের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে প্রথমে শান্তি আলোচনা ও পরে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়। আর এখন আফগানিস্তানের নতুন তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলি কাতারের সাথে যোগাযোগ করছে। অবশ্য কাতার আরো আগে থেকেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ২০০৮ সালে কাতার ইয়েমেনের সরকার ও হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে। ২০০৯ সালে লেবাননের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মীমাংসা ও ২০১২ সালে ফিলিস্তিনের হামাস ও ফাতাহ আন্দোলনের মধ্যকার সমঝোতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কাতার। এছাড়া ২০০৯ সালে আফ্রিকার সুদান ও চাঁদ এবং ২০১২ সালে জিবুতি ও ইরিত্রিয়ার মাঝে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে কাতার। ২০১১ সালে সুদানের সরকারের সাথে বিরোধীদের দারফুর চুক্তি সম্পাদন ছিল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের অন্যতম সফলতা।
মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সাম্প্রতিক ভূমিকাগুলি বিশ্বরাজনীতিতে যেমন কাতারের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে, তেমনি এসব ভূমিকার নেপথ্যে কাতারকেও নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হয়েছে। তাছাড়া, বিশ্বরাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে অর্থনৈতিক গুরুত্বও থাকতে হয়, যা বর্তমানে কাতারের রয়েছে। যার যত অর্থ রয়েছে সে ততো গুরুত্ব পায় বিশ্বরাজনীতিতে। এছাড়াও কাতারে রয়েছে তেলের রিজার্ভ। যে তেল বিশ্বরাজনীতিতে একটা দেশের গুরুত্ব বহন করে। আমরা দেখতে পাই, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তিগুলোর অবস্থান সেটাও তেলের কারণেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।