পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আফগানিস্তান অসংখ্য পাহাড়বেষ্টিত একটি দেশ। একে দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণে অবস্থিত পাকিস্তান। পশ্চিমে ইরান। উত্তরে তুর্কেমিনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজাকিস্তান। আর উত্তর-পূর্বে গণচীন। আফগানিস্তান রূঢ় আবহাওয়ার একটি দেশ। এর অধিকাংশ এলাকা পর্বত ও মরুভূমি দ্বারা আবৃত। উত্তর দিকে কিছু সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে কিছু গাছপালা রয়েছে। গ্রীষ্মকালে আফগানিস্তানের আবহাওয়া অতি উষ্ণ থাকে। আর শীতকালে প্রচন্ড শীত পড়ে। আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকে এদেশ বহু বহিরাক্রমণ হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের মধ্য দিয়েই চলাচল করেছে। অনেক জাতি এখানে বসতি স্থাপন করেছে। এ দেশে বসবাসরত সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো পশতু। ৫০ হাজার বছর আগে থেকেই আফগানিস্তানে মানুষের বসতি ছিল। আফগানিস্তানকে অনেক জাতি শাসন করেছে মর্মে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সম্প্রতি তালেবানদের অগ্রযাত্রায় আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকার পতন হয়। ফলে বিশ্বমিডিয়ার সংবাদ মাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে পড়ে আফগানিস্তান। বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশিদের কাছেও আফগানিস্তানের হাড়ির খবর জানার আগ্রহ বেশ লক্ষণীয়। আফগানিস্তান একটি দরিদ্র সার্কভুক্ত দেশ। তবে এর রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আফগানিস্তানে জন্ম নেয়া নানা গোত্র বিভিন্ন কারণে বেশ প্রসিদ্ধ। মধ্যযুগে হিন্দুস্থানে শাসনকার্যে এসকল প্রসিদ্ধ গোত্রের মানুষেরা ব্যাপক অবদান রেখেছে। আধুনিক যুগে উপমহাদেশের রাজনীতিতেও তাদের সংশ্লিষ্টতা দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমা, সংগীত, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আফগানিস্তানের খানেরা। জড়িয়ে আছে কাপুরেরা, আফ্রিদিরা এবং আরো অনেকে। এসব খান, কাপুর আর আফ্রিদিদের পূর্বপুরুষের শিকড় এই আফগানিস্তান। দূর অতীতের অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে আফগানিস্তান ছিল একটি সরাইখানার মতো। মরুময় ঝাঁঝালো আবহাওয়া ডিঙ্গিয়ে তারা আসতো সিন্ধু, পাঞ্জাব আর বাংলার উর্বর সবুজ ভূমির দিকে। পাহাড়-পর্বত, বন-বাদাড়ের চড়াই-উৎরাই মাড়িয়ে তাদের সাক্ষাৎ মিলতো গিরিপথের উপর দাঁড়ানো এক সরাইখানার সাথে। আর সে সরাইখানা হলো আফগানিস্তান। অভিবাসন প্রত্যাশীর সকলকেই এ সরাইখানার আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হতো।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে এখানে অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষজন আসতে শুরু করে। আফগানিস্তান শাসন ও দখলের নিমিত্তে অনেকেই সেখানে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে নাই। দখলদার ঔপনিবেশকরা পরাজিত হয়েছে। লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। অবশেষে আত্মসমর্পণের গ্লানি নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ পরিক্রমায় একের পর এক আফগানিস্তানে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। দেশটি অতীতে পারস্য, গ্রীস, সেলুসিড, মৌর্য, আরব, মঙ্গল, খোয়ারিজম ও তিমুরীয় শাসকগণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তারা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে মহামতি আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাটকে পরাজিত করে আফগানিস্তানের দখল নেন। দখলে নিয়েই আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আফগানরা ‘অপরাজেয়’। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এশিয়ার কুশান জাতি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। চতুর্থ শতাব্দীতে হুন নামের মধ্যএশীয় এক তুর্কি জাতি কুশান জাতিকে পরাজিত করে। সপ্তম শতাব্দীতে আফগানিস্তানে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। আরব মুসলিমেরা পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। দশম শতাব্দীতে উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে এসে একদল মুসলিম শাসক আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। একই সময়ে এখানে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয়। গজনীর সর্বশেষ সুলতান ছিলেন মাহমুদ গজনবী। তিনি ৯৯৮ সাল থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। তিনি প্রায় সকল হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় আফগানিস্তান সাহিত্য ও শিল্পের নগরীতে পরিণত হয়। মাহমুদ বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসবিদ আল-বিরুনী ও মহাকবি ফেরদৌসীর নামও। মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনবীর প্রভাব হ্রাস পায়। ১২০০ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২১৫ সালে খোয়ারিজমি শাহদের কাছে ঘুরি রাজ্যের পতন ঘটে। ১২১৯ সালে মঙ্গোল সেনাপতি চেঙ্গিস খান খোয়ারিজিমিদের পরাজিত করেন। ১৪০০ শতাব্দীতে তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন। ঘুরি থেকে তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে এখানে ইসলামী স্থাপত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। এ সময় তৈরি হয় মসজিদ, মাদরাসা, মিনার ও মাজার-ই-শরীফ। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন বাবর ১৫০৪ সালে কাবুল ও কান্দাহার দখল করে নেন। ১৫২৬ সালে বাবর ভারতে আক্রমণ করেন। তিনি লোদী বংশকে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুনকে দিল্লির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আর অন্য তিন পুত্র কামরান মির্জা, আস্কার মির্জা ও হিন্দাল মির্জাকে কাবুল, কান্দাহার ও বদকশান শাসনের দায়িত্ব প্রদান করেন। মোগলদের সময়ে কাবুল, দিল্লি ও আগ্রা একই সূত্রে গ্রথিত ছিল। ১৫৪৫ সালে হুমায়ুন কাবুল, কান্দাহার, গজনবী ও বদকশানের একচ্ছত্র শাসক হন। দিল্লি থেকেই তখন আফগানিস্তানের প্রদেশগুলি মোগলদের দ্বারা শাসিত হতো।
১৭৪৭ সালে আবির্ভাব ঘটে আহমদ শাহ দুররানির। তিনি ছিলেন তেহরানের প্রতাপশালী সেনাপতি নাদির শাহের অনুগত এক সেনাধ্যক্ষ। কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। কাবুল, কান্দাহার, হেরাত, গজনবী ও পেশাওয়ার নিয়ে জন্ম হয় আধুনিক আফগানিস্তানের। তিনি আফগানিস্তানে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। আর কালক্রমে এক শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তার মৃত্যুর পর পুত্র তৈমুর শাহ আফগানিস্তানের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত করেন। ১৭৯৩ সালে তৈমুরের মৃত্যু হয়। অতঃপর তাঁর পুত্র জামান শাহ, মাহমুদ শাহ, সুজা শাহ ও অন্যান্যরা সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময়ে আফগানিস্তান নিয়ে সর্বপ্রথম বেপরোয়া নাক গলানো শুরু করে ব্রিটিশরা। তারা ১৮৩৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ১৮৪২ সালে তারা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আফগানিস্তান আবার পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯১৪ সালে আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন হাবিবুল্লাহ খান। ১৯১৯ সালে তুরস্কের অনুসারী বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে। তার স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র আমানুল্লাহ খান। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘ যুদ্ধে ইংরেজরা ক্লান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা পরাজয় বরণ করে। এসময় কাবুলে ব্রিটিশ সৈন্যসহ মোট ১৬০০০ ব্রিটিশ নাগরিক অবস্থান করছিল। আফগান যোদ্ধারা তাদেরকে খাইবার গিরিপথ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ব্রিটিশদের অতিরিক্ত নাক গলানোর কারণে এদের প্রায় সকলকেই আফগান যোদ্ধারা হত্যা করে। মাত্র একজন সৈনিক ডাক্তার ঘোড়ার পিঠে ঝুলতে ঝুলতে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এটাও সম্ভব হয়েছিল আফগানদের ইচ্ছাতেই। কারণ তারা চেয়েছিল অন্তত একজন ব্রিটিশ যেন ফিরে গিয়ে তাদের করুণ পরিণতির কথা ব্রিটিশদের কাছে বলতে পারে। স্বাধীনচেতা আফগান শাসক আমানুল্লাহ ইংরেজদের ক্ষমতা খর্ব করেন। আফগানিস্তানকে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ১৯২৯ সালে দেশে আবার অস্থিরতা নেমে আসে। ক্ষমতা দখল করেন হাবিবুল্লাহ কালাকানি নামে এক দস্যু সর্দার। ১৯৩০ সালে আফগানিস্তানের নতুন শাসক হন জহির শাহ। তিনি একটানা ৪০ বছর আফগানিস্তান শাসন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজতান্ত্রিক শাসন চলমান থাকে। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। এতে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন মোহাম্মদ দাউদ খান। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বামপন্থী সামরিক নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকি। অতঃপর ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেন পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি। এ সরকারের নাম দেয়া হয় বামপন্থী পিডিপিএ। এ সরকারের কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। এ সরকারটি ছিল সোভিয়েতের অনুগত, তাবেদার।
ব্রিটিশদের আদলে এসময় আফগানিস্তানে শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ার আনাগোনা। তাদের অনুগত সরকারকে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বাধীনচেতা আফগানরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তারা মাত্র ৬ মাস আফগানিস্তানে থাকবে বলে ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেছিল দশ বছর। তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের ময়দান হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে দীর্ঘ ১০ বছর। এ যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয় লক্ষ লক্ষ আফগান নাগরিক। ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ ইরানে আশ্রয় নেয়। এখনো প্রায় ২০ লাখেরও বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। সহিংসতার কারণে তাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এ যুদ্ধে ধ্বংস হয় মূল্যবান স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। এসময় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি ও শহুরে গোষ্ঠিগুলো তাবেদার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। যাদের একটি গ্রুপকে বলা হতো আফগান মুজাহিদীন। আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। পিডিপিএ সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর আফগান মুজাহিদদেরকে সহযোগিতা করতো যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ। ক্রমাগত মুজাহিদ বাহিনী গেরিলা হামলা জোরদার করতে থাকে। সোভিয়েত বাহিনী ক্লান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। অতঃপর সোভিয়েত ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু আধিপত্য বিরোধী এবং আধিপত্য সমর্থক গোষ্ঠির মধ্যে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সংঘটিত এসব যুদ্ধের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে তালেবান নামক একটি সশস্ত্র সংগঠন। ১৯৯৬ সালে তালেবান তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। তালেবান এসময় সংঘটিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আল-কায়েদা নামে আরেকটি ইসলামিক গ্রুপকে তালেবানরা আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। মুজাহিদ বাহিনীর একটা গ্রুপ তালেবানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। তালেবানরা ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে নেয়। জিহাদি এ গ্রুপগুলো ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের দাপট ছিল। তালেবান দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা ১৯৯৮ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের পুরো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারা ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক দেশ পরিচালনা শুরু করে। উল্লেখ্য, এ সময় পর্যন্ত তালেবানের আমেরিকা মিত্র শক্তি হিসেবে মনে করতো। স্বাধীনচেতা আফগানরা স্বাধীনভাবে দেশ চালাতে থাকে। আর এতে ক্রমাম্বয়ে নাখোশ হতে থাকে দীর্ঘদিনের মিত্রশক্তি আমেরিকা। অতঃপর তালেবানের ঘরে সন্ত্রাসের অজুহাত খুঁজতে থাকে বিশ্বমোড়ল আমেরিকা।
ঠিক এ সময়েই ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৫০০ জন আমেরিকান নাগরিক নিহত হয়। আমেরিকা এ হমলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়া উসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে। তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার জন্য তালেবানের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তালেবান তাদের অতিথি উসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। অতঃপর ঠুনকো এ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে একযোগে হামলা চালায়। ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে চলে এ হামলা। তালেবানের উপর পৃথিবীর সর্বাধুনিক অস্ত্র ও শক্তি প্রয়োগ করে আমেরিকা। তারা দেশটিকে পদানত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে তালেবান মার্কিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আর অদম্য মনোবলই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। এ মনোবলের উপর ভর করেই তালিবান যুদ্ধ চালিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। এ যুদ্ধে আমেরিকার ব্যয় হয়েছে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রাণ হারিয়েছে অনেক সৈন্য। মূলত শান্তির ছদ্মাবরণে মার্কিনীরা চেয়েছিল আফগানিস্তানে একটি পশ্চিমা ঘেঁষা শাসন কায়েম করতে। কিন্তু আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর এ চেষ্টা যে ব্যর্থ হবে সেটা বুঝা যাচ্ছিল ২০১১ সালেই। কারণ এ বছরই তালেবানের সাথে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে আমেরিকা। আর আমেরিকার আত্মসমর্পণের পথ উন্মোচন করে দেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে উভয়ের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি নিশ্চিত করে যে, তালেবানদের সম্ভাব্য বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসেন। তিনি তার দেশের নিশ্চিত পরাজয় বিলম্বিত করতে চাননি। ২০২১ সালের ৩১ আগস্টের মধ্যে সকল সৈন্য ফিরিয়ে নেবেন বলে তিনি ঘোষণা দেন। সৈন্য প্রত্যাহারের আগেই তালেবান পুরো আফগানিস্তান দখল করে নেয়। ইতোমধ্যে তালেবান নেতাদের নিয়ে সরকার ঘোষিত হয়েছে। আজ ১১ সেপ্টেম্বর সেই সরকারের শপথ গ্রহণের কথা রয়েছে।
আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আফগানিস্তান হচ্ছে ‘অপরাজেয়’ একটি দেশ। এর আরেকটি নাম হলো, ‘সাম্রাজ্যবাদের গোরস্থান’। নামটি যথার্থ বলেই মনে হয়। কারণ যত বড় বীর এদেশে প্রবেশ করেছে সকলকেই নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে। সকল বীরকেই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আলেকজান্ডারের এই কথা কেউ মনে রাখেনি। যারাই আফগানিস্তান দখল করতে গেছে তাদের সকলকেই করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ শিকার বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি আমেরিকা। আমেরিকার রাহুমুক্ত হলো আফগানিস্তান। নিজেদের দেশকে শত্রুমুক্ত করল তালিবান। ফলে আবারও স্বাধীন হলো আফগানিস্তান। তালেবানকে বিশ্বপরাশক্তিগুলো একযোগে জঙ্গি আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু তাদের বিজয়ের পর পরাশক্তিদের অনেকেই তালেবানকে সমর্থন করেছে। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলেও আখ্যা দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এবার বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, তালেবান বিজয়ী হয়ে আমেরিকার সমর্থকদেরকে গুলি করে হত্যা করেনি। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও রক্তপাত ঘটায়নি। মানুষ হত্যায় সহযোগিতাকারী দালালদেরকে পাকড়াও করেনি। আমেরিকা ও তার মিত্রদের উপর এখন পর্যন্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বরং বিদেশিদের দূতাবাস থেকে বিমানবন্দরে যেতে সহায়তা দিয়েছে। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে। আপাতত তাদেরকে সহনশীল বলেই মনে হচ্ছে। তালেবান মূলত আফগানিস্তানে ইসলামী শরীয়াহ চালু করতে চায়। অন্যতম শীর্ষ তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার এক ঘোষণায় বলেছেন, তালেবানের মূল লক্ষ্য আফগানিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করা। তিনি বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায় না। তালেবান মনে করে, আফগানিস্তানের সব শ্রেণির মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান। তিনি বলেন, ইসলামী অনুশাসনের আওতায় আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি প্রণীত হবে। মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। নারী অধিকার এবং বাকস্বাধীনতার প্রতি তালেবান সম্মান প্রদর্শন করবে। এছাড়া তালেবান নারীর শিক্ষা ও চাকরির অধিকার নিশ্চিত করবে। তাদের সম্পদের মালিকানা ও ব্যবসা করার অধিকার প্রদান করবে। আর এসব হবে ইসলামী আইন ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ রেখে।
যাহোক তালেবান বিজয় অর্জন করেছে। তাদের দেশকে স্বাধীন করেছে। তারা নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা তাদের স্বাধীন আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের স্বীকৃত রীতিও বটে। এ নীতি অনুযায়ী তারা যে কোনো আদর্শ গ্রহণ করতে পারে। আর এটা তাদের একান্তই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা করা বোকামী ও অনধিকার চর্চার শামিল। তারপরও বিশ্বের কিছু রাষ্ট্রকে কয়েকটি বিষয়ে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ বেশ উতলা হয়ে পড়েছে। দখলদারদের মিত্রদের জন্য তারা বেশ মায়া কান্না করছে। আসলে এ মায়াকান্নার কোনো মানে হয় না।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।