পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত চারদশকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মত। পাবলিক স্কুলের পাশাপাশি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বেসরকারি ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই যেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি লাগামহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তথাকথিত নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাবলিক পরীক্ষায় যেনতেন প্রকারে তাদের শিক্ষার্থীদের উচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে শিক্ষাকে অ্যাকাডেমিক গ্রেড সর্বস্ব করে তুলেছে।গত কয়েক দশকে পাঠ্যপুস্তকের মান, পাঠ্যসূচি প্রণয়ণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তদুপরি ক্লাসে তেমন কিছুই পড়ানো হয়না, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাসিক, ত্রৈমাসিক/সেমিস্টার ও বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল গ্রেড না হলে শিক্ষার্থী উপরের ক্লাসের জন্য অনুত্তীর্ণ বিবেচনা করা হয়। বাধ্য হয়েই নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরা সন্তানদের উচ্চ গ্রেড নিশ্চিত করতে বছরের শুরু থেকেই কোচিং, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠাতে বাধ্য হন। স্বচ্ছল অভিভাবকরা স্কুল-কলেজের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খরচাদির বাইরে স্থানভেদে একেকটি বিষয়ে ১ থেকে ৩ হাজার টাকায় প্রাইভেট টিউটর রেখে সন্তানের উচ্চ গ্রেড নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেন। পাঁচ থেকে আটটি বিষয়ে প্রাইভেট টিউটর দেয়ার সক্ষমতা অধিকাংশ অভিভাবকেরই নেই। এই সুযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব কোচিং ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তাঁরা জানেন, কোচিং বাধ্যতামূলক না হলে বেশিরভাগ অভিভাবকই সন্তানকে স্কুল-কলেজের কোচিংয়ে দিবেন না। অতএব সবার জন্য কোচিং বাধ্যতামূলক এবং কোচিংয়ের বেতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল বেতনের দ্বিগুণ বা আরো বেশি। এভাবেই ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কর্পোরেট চেইন শপের মতো কর্পোরেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের উপর সরকারের যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, অথবা সরকারের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই তারা দেশে হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট শিক্ষাবাণিজ্য গড়ে তুলেছে। আদতে এভাবেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সুউচ্চ ভবন, শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত শেণীকক্ষ, সিসিক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একটি মেকি জৌলুস দেখানো হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইনোভেটিভ, ক্রিয়েটিভ ও ইনটুইটিভ মাইন্ড গড়ে তোলার পাশাপাশি সুনাগরিক ও মহৎ হৃদয়ের সৎ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন জাগানোর মত কোনো কর্মসূচি বা শিক্ষাকার্যক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থায় নেই বললেই চলে।
বৃটিশ আমলের শুরু থেকে পরিকল্পিতভাবে বৃটিশদের চাপিয়ে দেয়া ভোগবাদী মূল্যবোধ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অবক্ষয় ও নিম্নগামিতার যাত্রা শুরু হয়। বৃটিশ-ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে বৃটিশদের শাসনকার্য পরিচালনার উপযোগী জনশক্তি ও জনমত গঠনের লক্ষ্যে ১৮৫৪ সালে বৃটিশ ইন্ডিয়ার গর্ভনর লর্ড ডালহৌসির কাছে বৃটিশ শিক্ষা নিয়ন্ত্রক বোর্ডের প্রেসিডেন্ট চার্লস উডের পাঠানো সুপারিশগুলোকে উড ডেসপাচ নামে অভিহিত করা হয়। এর তিন দশক পর ইউলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে গঠিত বৃটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষাকমিশন গঠনের আগেই উড ডেসপাসের মধ্য দিয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছিল। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ভার্নাকুলার বা স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হলেও ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস, নীতি-নৈতিককতা ও চিরায়ত মূল্যবোধ সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে ১৮৮২ সালে গঠিত হান্টার কমিশন প্রত্যেক জেলায় কমপক্ষে একটি সরকারি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক রাজ্য বা প্রশাসনিক কেন্দ্রে আলাদা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা, গ্রাম্য, দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠির শিশুদের জন্য নিজস্ব বাস্তবতায় শিক্ষাকে সহজলভ্য করে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। একুশ সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষা কমিশনে একজন মুসলমান সদস্যসহ ভারতীয় সদস্য ছিল মাত্র চারজন। এরা হলেন, সাইয়েদ মাহমুদ, ভুদেব মুখার্জি, আনন্দ মোহন বসু ও কেটি তেলাং। অন্য মহাদেশ থেকে ভারত শাসন করতে আসা ইংরেজরা নিজেদের সুবিধামত একটি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলেও উপনিবেশোত্তর ৭০ বছরেও আমরা নিজস্ব ঐতিহ্য, ধ্যান-ধরনা, আত্মপরিচয়. মূল্যবোধ, জাতীয়তাবাদ, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতার আলোকে একটি মানসম্মত শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি বৃটিশদের কেরানি তৈরীর উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ভার্ণাকুলার ল্যাঙ্গুয়েজের পাশাপাশি ইংরেজী ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটি নতুন ভাবধারা তৈরীতে সফল হয়েছিল। আমরা বৃটিশদের তৈরী শিক্ষা কারিক্যুলামের ধারাবাহিক উন্নয়ন করতে যেমন ব্যর্থ হয়েছি, নিজেদের মত করে নিজের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়েছি।
শত বছরের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা ১৯৪৭ সালে একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠণ করেছি। শাসকদের সংর্কীণ চিন্তার কারণে প্রত্যাশিত শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে ১৯৭১ সালে আমাদেরকে আবারো স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা শুধু একটি পতাকা আর মানচিত্র চাইনি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা এই ভূখন্ডের মানুষকে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ দিতে চেয়েছিলেন, যা’ এইর্ ভূখন্ডের মানুষ কখনো পায়নি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে গৌড়-বাংলায় শাসকদের দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও উচ্চবর্ণের লোকদের আধিপত্যে সমাজে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, ইতিহাসে তা মাৎস্যন্যায় নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দ্বাদশ শতকের পর থেকে পারস্য, তুর্কি, আফগান থেকে আগত মুসলমান সুলতান ও মোঘলদের শাসনে এ অঞ্চলে এক ধরণের স্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছিল। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে শত শত বছরের মুসলমান শাসনে শাসকদের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার চমৎকার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। বৃটিশ শাসনে প্রথমেই শত শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। তবে দুইশ’ বছরের ধারাবাহিক প্রয়াস সত্তে¡ও ইংরেজরা এই ভূখন্ডের মানুষকে খ্রিষ্টান মিশনারীদের ট্যাবলেট গেলাতে না পারলেও একটি ভোগাবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এখানকার রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে বিশৃঙ্খল, অস্থিতিশীল করে তোলার আয়োজনটা তাদেরই সৃষ্টি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বাংলায় পাল রাজাদের শাসনামলে যে মৎস্যান্যায় দেখা দিয়েছিল হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা কি এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও সেই পাল আমলের মত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখছি না? আজকের অধপতিত সমাজব্যবস্থা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্বের অভিশাপ, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লুটপাট, ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের মূলে রয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সীমাহীন ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতার কারণেই দেশে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে কর্পোরেট শিক্ষা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। শিশুদের সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে একটি সমৃদ্ধ স্বদেশ গড়ে তোলার বদলে শিক্ষা এখন নতুন প্রজন্মের কোটি কোটি নাগরিকের সার্টিফিকেট বাণিজ্যের দোকানদারিতে পরিনত হয়েছে। দেশে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র, অর্থপাচার, মানবাধিকার হরণ, ঘুষ-দুর্নীতির মচ্ছব এবং সামাজিক অপরাধ প্রবণতার ধারা বন্ধ করতে হলে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুনাফা বাণিজ্য ও অপরাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বের করে আনতে হবে।
প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে যাচ্ছে। করোনার ভাইরাস মহামারীর শুরুতে এবং পরবর্তিতে যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, ট্রায়াল ও উৎপাদনে সফলতার কথা জানান দিচ্ছিল, তখনি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ মহলের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসতে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। দুই বছর ধরে সবকিছু বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, অতএব আমাদেরকে সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাভাইরাস মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। হচ্ছেও তাই বিশ্বের দেশে দেশে করোনা লকডাউনের মধ্যেও কোনোকিছু থেমে থাকেনি। করোনার প্রথমদিকের আতঙ্কজনক সময়টুকু বাদ দিলে আমাদের দেশে হাজার হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। শুরুর দিকে শিশু-কিশোরদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ছিল খুব বিরল। এখনো খুব বেশি নয়। মাঝখানে বেশ কয়েকমাস সংক্রমণের হার ৫ ভাগের নিচে ছিল। তাহলে, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশের স্কুলগুলো কেন বন্ধ রাখা হল? গার্মেন্টকর্মী ও বিদেশগামী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা বলা হলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার কোনো উদ্যোগ না নিয়েই শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বললেন, ভ্যাকসিন না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না! একাধিকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণার পরও সংক্রমণের হার বৃদ্ধির পাশপাশি রহস্যজনক কারণে তা আর হয়নি। সবকিছু খোলা রেখে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পেছনে সরকারের অনীহার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে দুর্মুখ কেউ কেউ বলেন, সম্ভাব্য ছাত্র আন্দোলনের ঝুঁকি থাকায় সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে নারাজ। ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বশেষ এবং রি-ওপেনের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা সর্বাগ্রে ভাবতে হবে। কোটি কোটি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মনস্তাত্তি¡ক চাপ বহন করতে পারবে না। ২০২০ সালে যে শিশুটি ৫ বছরে পদার্পণ করেছে, যে স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথমদিন স্কুলে যাওয়ার অপেক্ষা করেছিল, গত দুই বছরেও তার সে স্বপ্ন পুরণ হয়নি। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তার জীবন থেকে দুইটি বছর চলে গেল। অনির্দিষ্ট কাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলে স্কুল পড়ুয়া অনেক মেয়ে এ সময়ে বাল্য বিয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ড্রপ-আউট হয় তাই এখন দেখার বিষয়। অন্যান্য সেক্টরের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও যদি খুলে দেয়া হত, তাহলে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটত না।
করোনা মহামারি শুরুর কয়েক মাস আগে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অধিকারের ব্যানারে কোটাবিরোধী আন্দোলন চলার সময়েই দেশের শীর্ষ ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ত্বরিৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফয়সাল বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বিতর্কিত চুক্তির প্রতিক্রিয়া জানাতে ফেসবুকে দেয়া একটি স্টাটাসের কারণে আবরার ফয়সাল ছাত্রলীগের টার্গেটে পরিণত হয়। বুয়েটে যারা ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তারা দেশসেরা মেধাবী হিসেবে বিবেচিত হন। ভবিষ্যতের ইঞ্জিনিয়ার সেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র মতপার্থক্যের কারণে একজন সর্তীর্থ-সহপাঠীকে এমন নির্মমভাবে খুন করতে পারে ! কোনো সভ্য সমাজে এটা ভাবা যায় না। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ-শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুন-ধর্ষণের মত নির্মম পাশবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। আবরার ফাহাদ শুধু মেধাবী ছিলেন না,তার মধ্যে দেশপ্রেম, ইতিহাস সচেতনতা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও প্রতিবাদী চেতনা ছিল বলেই তিনি সেই ফেসজবুক স্টাটাসটি লিখেছিলেন। কি ছিল সেই লেখায়? একটু পিছনে ফিরে সেটি আবার পড়ে দেখা যাক, আবরার ফাহাদের মৃত্যুর পর লেখাটি ভাইরাল হয়ে এখন তা ইতিহাসে স্থান করে রিয়েছে। তিনি লিখেছিলেন-
১.১৯৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিলনা। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেরা মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভীক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্য অন্যকে পানি দিতে চায়না, সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩.কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন- “ পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি -
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”
আবরার ফাহাদের এ লেখায় কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই। এখানে ভারতের শাসকদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। এ জন্য তাঁকে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল!
দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম পীঠস্থান বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনে ছাত্র হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গণের অবস্থা জাতির সামনে, বিশ্বের সামনে আবারো উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরও দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের তান্ডব থেমে যায়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে করোনাভাইরাসে বন্ধ থাকা সিলেট এমসি কলেজের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী তার স্বামীর সাথে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে বেড়িয়েছিল, সেখানে স্বামীকে আটকে রেখে ছাত্রলীগের ৬ নেতাকর্মী স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিল। একেকটি পাবলিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যেন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের মৌরসিপাট্টা হয়ে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন হাল একদিনে হয়নি। বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত, এমনকি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন পর্যন্ত এ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা জাতির ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন- সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব গড়ে তোলার সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল। এমনকি পতিত স্বৈরাচারও ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছে। এরপর প্রায় ৩০ বছর ধরে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলে আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নিয়োগ ও দলবাজ সিন্ডিকেটের কারণে সেখানে সরকারিদলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, কমিশন বাণিজ্য, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার মত কাচা পয়সার কারবারে জড়িয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গণকে চরমভাবে কলুষিত করে তোলা হয়েছে।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর দেশের শিক্ষাঙ্গণ আবার সরগরম হতে চলেছে। এই করোনাকাল বিশ্বের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। আমাদের শিক্ষাঙ্গণ ও শিক্ষাব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের নামে অনৈতিক কর্মকান্ড ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িকভাবে তা বন্ধ হলেও এখন যেন সেই বর্বরতা আর ফিরে না আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কোনো ‘গণরুম’ না রাখা এবং বহিরাগতদের হলে থাকার সুযোগ কঠোরভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাবির অনুসরণে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও গণরুম, গেস্টরুম, ডায়নিংরুম, নানা নামে ছাত্র নামধারি দুর্বৃত্তদের টর্চার সেল বন্ধে প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জরুরী। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্পোরেট মুনাফাবাজি এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত করতে না পারলে দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়, সন্ত্রাস ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তির প্রত্যাশা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।