পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আফগানিস্তানে কারা ক্ষমতায় এলো, তাদের রাজনৈতিক রঙ কী, সেটা আফগানিস্তানের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তখন বাংলাদেশের সেকুলার এবং বামপন্থীরা মনে হয়, বাংলাদেশের মাটিতে বসে ‘ক্রুসেড’ শুরু করে। বাংলাদেশের কোনো একটি রাজনৈতিক দল তালেবান সরকারের অনুকূলে একটি মন্তব্য করেছিল। আর যায় কোথায়? শুরু হয় ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে বিষ উদগীরণ। কিন্তু সেই আফগানিস্তানে যখন হত্যা, ক্যু এবং বিদেশি হানাদারদের সহায়তায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে, তখন এদেশি বামপন্থী এবং একশ্রেণীর সেকুলার আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট শাসকদের রক্তাক্ত শাসনের সমর্থনে যে উলঙ্গ নর্তন-কুর্দন শুরু করেছিল, সেকথা তথাকথিত প্রগতিবাদী বন্ধু এবং মুক্তবাকরা লুকিয়ে রাখেন। ২০ বছর পর আজ আবার যখন তালেবান বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তখন মনে হচ্ছে, ওদের গায়ে ফোসকা পড়েছে। ২০ বছর পর সমগ্র বিশ্ব এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষও এগিয়ে গেছে। শিক্ষার আলোকবর্তিকায় তারা আলোকিত হয়েছে। তারা এখন ইতিহাস পড়ছে। পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। দেখছে কমিউনিস্টদের চক্রান্ত এবং খুনাখুনির উপাখ্যান। আফগানিস্তানের তৎকালীন সোভিয়েত সমর্থনে এদেশের কমিউনিস্ট এবং সেকুলারদের মধ্যে যাদের গায়ে বাম রং লেগে ছিল তাদের নর্তন-কুর্দন এবং উঁচু গলায় কথা বলার দালিলিক প্রমাণ একটু পরেই ইনকিলাবের সম্মানিত পাঠক পাঠিকাদের সামনে উপস্থিত করব। তার আগে পাঠকরা দেখুন, আফগানিস্তানের মতো একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিকে কমিউনিস্টরা কীভাবে হত্যা এবং খুনাখুনির মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত করেছে। চলুন, একটু পিছনে ফিরে যাই।
পাঠক ভাইদের হয়তো স্মরণ আছে যে, ১৯৭৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র ছিল। সর্বশেষ রাজা ছিলেন বাদশাহ জহির শাহ। ১৯৭৩ সালে বাদশা জহিরের অত্যন্ত নিকটাত্মীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ দাউদ খান এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশা জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করেন এবং দেশটিকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। দেশটিকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করলে কী হবে, তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম দেশ এবং মধ্য এশিয়ার অন্তর্ভুক্তি না হলেও অপর একটি বৃহৎ মুসলিম দেশও সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য, অর্থাৎ অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম দেশ হলো তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিস্তান এবং কাজাখস্তান। এই পাঁচটি দেশের বাইরে অপর মুসলিম দেশটির নাম আজারবাইজান। সোভিয়েত ইউনিয়নের অপর একটি মুসলিম প্রধান অঙ্গরাজ্যের নাম চেচনিয়া।
দুই
১৯৯৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন খন্ড বিখন্ড হলে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এরমধ্যে ৬টি মুসলিম প্রধান। এগুলি হলো উজবেকিস্তান (জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ মুসলমান), তাজিকিস্তান (৯৮ শতাংশ মুসলমান), তুর্কমেনিস্তান (৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলমান), কাজাখস্তান (৯০ শতাংশ মুসলমান), কিরঘিজিস্তান (৯০ শতাংশ মুসলমান) ও আজারবাইজান (৯৭ শতাংশ মুসলমান) এবং চেচনিয়ায় ৯৫ শতাংশ মুসলমান। এর মধ্যে চেচনিয়া স্বাধীনতার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে। অনেক রক্ত দিয়েছে। কিন্তু ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমান রাশিয়া পাশবিক শক্তি, অর্থাৎ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে মাত্র ৬ হাজার ৭ শত বর্গমাইল আয়তনের মাত্র ১৪ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত দেশটিকে স্বাধীন হতে দেয়নি। অথচ, ১০ লক্ষ ৫২ হাজার ১০০ বর্গমাইলের বিশাল আয়তন সম্পন্ন ২ কোটি অধিবাসী অধ্যুষিত কাজাখস্তান রাজ্যটিকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
একটু আগে মধ্য এশিয়ার যে ৫টি মুসলিম দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি দেশের সাথেই আফগানিস্তানের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। এই তিনটি দেশ হলো তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই যে, আলোচ্য তিনটি মধ্য এশিয়ার দেশে যেমন তাজিক, উজবেক এবং তুর্কমেনদের বাস, তেমনি আফগানিস্তানেও রয়েছে ঐ তিনটি নৃতাত্ত্বিক জাতি। এদের মধ্যে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ তাজিক, ৯ শতাংশ উজবেক, ৯ শতাংশ হাজারা এবং ৩ শতাংশ তুর্কমেন। ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমানে স্বাধীন তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের তাজিক, উজবেক এবং হাজারাদের সাথে আফগানিস্তানের তাজিক, উজবেক এবং তুর্কমেনদের মাঝে কোনো দিক দিয়ে কোনো তফাৎ নাই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু বাঙালি হিন্দু বাঙালি। আর বাংলাদেশের বাঙালিদের সংখ্যাগুরু হলো মুসলমান। কিন্তু তাজিক উজবেক এবং তুর্কমেনদের মধ্যে সেই প্রভেদও নাই। আফগান জনগোষ্ঠির ৪২ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৩৫ লক্ষ হলো পশতুন বা পাঠান। এরা আফগানিস্তানের সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চল জুড়ে বাস করে। ঠিক তার নিচেই, অর্থাৎ পাকিস্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। বর্তমান নাম খাইবার পাখতুনখোয়া। এখানে সাড়ে তিন কোটি পশতুন বা পাঠানদের বাস। ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল এবং পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ৫ কোটি পশতুন বা পাঠানের বাস। তাই ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয়ভাবে যেমন পাকিস্তানের পাঠান বা পশতুনদের সাথে আফগান পাঠান বা পশতুনদের মধ্যে রয়েছে একাত্মতা, তেমনি তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের তাজিক এবং উজবেকদের আফগান তাজিক এবং উজবেকদের মধ্যে রয়েছে একাত্মতা। তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন অভিন্ন সীমান্তের কারণেই আফগানিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইতো।
তিন
আমি আগেই বলেছি যে আফগান সেনাবাহিনী প্রধান বাদশাহ জহির শাহের জ্ঞাতিভ্রাতা জেনারেল মো. দাউদ খান সামরিক অভ্যুত্থান করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটান। পাঁচ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। পাঁচ বছর পর ১৯৭৮ সালে আফগান কমিউনিস্ট বলে পরিচিত পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ) নেতা নুর মোহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এই অবস্থানে জেনারেল দাউদ খান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কমিউনিস্ট তারাকি প্রেসিডেন্ট এবং অপর কমিউনিস্ট হাফিজুল্লাহ আমিন প্রধানমন্ত্রী হন। দাউদ বিরোধী রক্তাক্ত কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ছিল।
প্রধানমন্ত্রী হাফিজ উল্লাহ আমিন কনফিডেন্ট ছিলেন যে, তার পেছনে সোভিয়েত সমর্থন আছে। এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দেড় বছর পর ১৯৭৯ সালের ৮ অক্টোবর হাফিজুল্লাহ আমিনের নির্দেশে নূর মোহাম্মদ তারাকিকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। ইতোপূর্বে তারাকি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন, অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আফগানিস্তানের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির বলে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ১ লক্ষ ১৫ হাজার সেনা সম্বলিত সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে দেশটি দখল করে। দখল করার মাত্র তিনদিন পর সোভিয়েত বাহিনী ২৭ ডিসেম্বর তাজবেগ প্রাসাদে হামলা চালায়। এই হামলা ‘অপারেশন স্টর্ম-৩৩৩’ নামে পরিচিত। অপারেশন স্টর্ম-৩৩৩ এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হাফিজউল্লাহ আমিনকে হত্যা করা হয় এবং সোভিয়েত বশংবদ বাবরাক কারমালকে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসানো হয়। শুরু হয় আফগানিস্তানে সোভিয়েত কমিউনিস্টদের দখলদারিত্ব। বাবরাক কারমাল ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৬ সালের ৪ মে পর্যন্ত ৫ মাস ৮ দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পুতুল হিসেবে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ৪ মে বাবরাক কারমাল পদত্যাগ করলে সোভিয়েত সমর্থনে ড. নজিবুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট বানানো হয়।
চার
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ১৯১৯ সালে আফগানিস্তান স্বাধীন হয়। রাজতন্ত্র হলেও ৫৯ বছর পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে কোনো রক্তারক্তি বা খুনোখুনি হয়নি। তারা দরিদ্র এবং অশিক্ষিত হলেও রক্তপাত ঘটাননি। আফগানিস্তানের হত্যা এবং রক্তপাতের রাজনীতি শুরু করে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্ট নুর মোহাম্মদ তারাকি কর্তৃক জেনারেল দাউদ এবং তার পরিবারকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই রক্তপাতের শুরু। তারপর আরেক কমিউনিস্ট হাফিজুল্লাহ আমিনের হাতে তারাকির খুন এবং সোভিয়েত মদদে হাফিজুল্লাহর খুনের মধ্যে দিয়ে তা ষোলকলায় পূর্ণ হয়।
১ লক্ষ ১৫ হাজার সৈন্য সজ্জিত সোভিয়েত বাহিনী হাফিজুল্লাহ আমিনকে রাজপ্রাসাদে হত্যা করে বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়। তখন বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ভাবলে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়, যখন দেখি যে হানাদার সোভিয়েত বাহিনীর দখলদারিত্বকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কী নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছে এবং দালালী করেছে। দৈনিক প্রথম আলোতে এই নগ্ন দালালির প্রমাণ দেখুন। গত ৩০ আগস্ট সোমবার দৈনিক প্রথম আলোর ৮ পৃষ্ঠার প্রধান উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম, ‘কাবুল: পতন না মুক্ত হয়েছে’। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। এই নিবন্ধের একস্থানে তিনি বলেছেন, “১৯৮০ সালের ১৩ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এক সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক মো. ফরহাদ বাংলাদেশের ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে’ হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘কাবুলে বিপ্লব হয়েছে, বাংলাদেশেও বিপ্লব ঘটিয়ে দেব।’ --- ১৯৭১ সালে ভারতবর্ষ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই আফগানের বিপ্লবী জনগণ, আফগানের বিপ্লবী সরকার যখন সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিয়েছে, সেই সাহায্যকে সঠিক মনে করছি।” প্রথম তালেবান সরকার সম্পর্কে একটি দলের অনুকূল উক্তির জন্য আজও যদি শোরগোল তোলা হয় তাহলে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলার সমর্থনে করা বক্তৃতা নিয়ে শোরগোল করা যায় না কেন?
সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১০ বছর পর মুজাহিদীনরা হানাদারদের বিতাড়িত করে। সে এক ভিন্ন কাহিনী। বলব আরেকদিন।
E-mail: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।