পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আফগানিস্তানে তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পুরো আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর থেকে তারা আগামী সরকারের ধরণ কেমন হবে, কারা থাকবে, এ নিয়ে দ্রুতই কাজ শুরু করেছে। গত ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুল দখলে নেয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সংগঠনটির মুখপাত্ররা এমন ধারণা দিয়েছেন যে, তারা আফগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং দেশকে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সব মত ও পথের নেতৃত্বের সমন্বয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠন করবেন। তালেবান মুখপাত্রদের এমন বক্তব্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়, তালেবান আক্ষরিক অর্থেই একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন করতে আন্তরিক ও বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি সংগঠনটির নেতারা আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, আফগানিস্তানের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতির প্রতিনিধি নিয়ে তারা অংশগ্রহণমূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছেন। এ সরকারে দেশের সব নৃগোষ্ঠী ও উপজাতি থেকে উঠে আসা নেতাদের নেয়া হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে থাকবেন একজন ‘আমির-উল মোমেনিন’ তথা বিশ্বাসীদের কমান্ডার। তিনিই ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দেবেন। তারা ভবিষ্যৎ সরকার গঠন ও মন্ত্রীদের মনোনয়নের জন্য একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করেছে। ইতোমধ্যে বিচার, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ ও তথ্যমন্ত্রী এবং কাবুলবিষয়ক বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ কে হবেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তালেবান আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করতে যে অংশগ্রহণমূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ, তারা ভাল করেই জানে, দেশটিতে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী নিজ নিজ নীতি ও আদর্শ নিয়ে শত শত বছর ধরে বসবাস করছে। তাদেরকে একসূত্রে এবং একই প্ল্যাটফর্মে আনতে না পারলে আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই তারা অংশগ্রহণমূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এ সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি ও সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে জাতিগত বৈচিত্র্য। চার কোটি মানুষের দেশটিতে কোনো গোষ্ঠীরই একক আধিপত্য নেই। সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে সুন্নী মুসলিম সম্প্রদায়ের পশতু। তারা মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশের বেশি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই আফগান রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য রয়েছে। তবে বর্তমানে আফগান বলতে কেবল পশতু নয়, বরং জাতি-গোষ্ঠি নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককেই বোঝায়। আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতি স্থাপন করেছে। দেশটির বর্তমান জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়।
দুই.
বিশ্বের কোনো দেশই থেমে থাকে না। যতই সংঘাত-সংঘর্ষ, অপশাসন ও দখলদারিত্বের শিকার হোক না কেন, এসব মেনে নিয়েই দেশের জনগণ এগিয়ে যায়। কখনো কখনো প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আফগানিস্তান যে দীর্ঘ ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র জোটের দখলদারিত্বের মধ্যে ছিল, তার মধ্যেও আফগানিস্তানের জনগণ থেমে থাকেনি। নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং অন্য দেশের চাপিয়ে দেয়া শাসন ব্যবস্থার মধ্যেও তারা চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী এই অপশক্তিকে একশ্রেণীর আফগান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে সহযোগিতা করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েই জীবনযাপন করেছে। সাধারণ আফগানরা অপেক্ষায় ছিল, কোনো এক সময় দখলদারিত্বের অবসান হবে এবং আগ্রাসী শক্তি বিদায় নেবে। দুই দশক পর তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাদের এই স্বপ্ন পূরণ করেছে তালেবান। তারা তালেবানের আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণকে স্বাগত জানিয়েছে। তা নাহলে, তালেবানের পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব হতো না। আফগান জনগণের মধ্যে যদি কোনো গোষ্ঠী তালেবানকে অপছন্দও করে থাকে, তবে তার চেয়ে বেশি অপছন্দ যে দখলদার বাহিনী ও তাদের শেকড় গাঁড়তে সহযোগিতা করা তল্পিবাহক সরকারের বিরুদ্ধে ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, কোনো জাতিই চায় না, বাইরে থেকে এসে দখলদার শক্তি দেশ দখল করে শাসন করুক। বরং নিজ দেশের অপছন্দের কোনো দল বা সংগঠন যদি ক্ষমতায় থাকে কিংবা দখলদার বাহিনী হঁটিয়ে ক্ষমতায় আসে, তা তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে, তার ভালো-মন্দ বিচারের চেয়ে দখলদার বাহিনীর বিদায় সবার আগে প্রধান্য পায়। তারা এটা মনে করে, পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে উক্ত সংগঠন বা দলের দোষ-ত্রুটি বিচার করা যাবে। তালেবানের ক্ষেত্রে আফগান জনগণের এই মনোভাব এবং অকুণ্ঠ সমর্থন কাজ করেছে এবং তা ইতিবাচক। এখন পর্যন্ত আফগানরা তালেবানকেই উপযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য মনে করছে। তালেবানও জনগণের অভিপ্রায় ও আকাক্সক্ষার কথা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সরকার গঠনে তার গৃহীত পদক্ষেপ এবং দেশে শান্তি বজায় রাখতে নিরলস চেষ্টার মধ্যে। বলা বাহুল্য, আফগান জনগণ সুদূর অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। যেমন গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল, হুতাক ও দুররানি ইত্যাদি। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর মধ্য এশিয়া থেকে এই এলাকায় লোকজন আসতে শুরু করে। এদের অধিকাংশই ছিল আর্য, যারা ইরান ও ভারতেও বসতি স্থাপন করেছিল। তখন এই এলাকার নাম ছিল আরিয়ানা। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি পারস্য সাম্রাজ্য আরিয়ানা দখল করে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডার পারস্যের সম্রাটকে পরাজিত করে আরিয়ানার পূর্ব সীমান্ত এবং তারও পূর্বে চলে যেতে সক্ষম হন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর অনেকগুলো রাজ্য এশীয় সাম্রাজ্যের দখল নেয়ার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে সেলুসিদ সাম্রাজ্য, বাকত্রিয়া সাম্রাজ্য ও ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে মধ্য এশীয় কুশান জাতি আরিয়ানা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ৭ম শতাব্দীতে আরব সৈন্যরা আফগানিস্তানে ইসলাম নিয়ে আসে। পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশ আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১০ম শতকে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে সামানিদ নামের মুসলিম শাসকবংশ আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। ১০ম শতাব্দীতে গজনীতে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। গজনীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা মাহমুদ গজনভি ৯৯৮ থেকে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ এলাকা শাসন করেন এবং তার সময়েই তিনি কাফিরিস্তান ছাড়া বাকি হিন্দু রাজাদের পরাজিত করে সমগ্র আফগানিস্তানে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। গজনী সাহিত্য ও শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং মাহমুদ বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যারা তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইতিহাসবিদ আল বিরুনী ও মহাকবি ফেরদৌসী। মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং ১২শ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানের ঘুর শহরে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ঘুরিরা ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমি শাহদের কাছে পরাজিত হয়। ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোল সেনাপতি চেঙ্গিস খান তার সৈন্যদল নিয়ে খোয়ারিজমি শহর হেতাত ও বালখ এবং বামিয়ানে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এশীয় সেনাপতি তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন ও ভারতে অগ্রসর হন। ঘুরি থেকে তিমুরীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে এখানে ইসলামী স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। এসময় তৈরি বহু মসজিদ ও মিনার আজও হেরাত, গজনী ও মাজার-ই-শরীফে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের আর বাবার দিক থেকে তৈমুর লঙের বংশধর জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর ১৫০৪ সালে আরঘুন রাজবংশের কাছ থেকে কাবুল দখল করেন। তারপর ১৫২৬ সালে তিনি ভারতে গিয়ে দিল্লী সালতানাতে আক্রমণ চালিয়ে লোদি রাজবংশককে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। সাধারণত মুঘলেরা কাবুল এবং পারসিকেরা হেরাত দখলে রাখতো। আর কান্দাহারের শাসনভার প্রায়ই হাতবদল হত। এসময় পশতুন জাতি তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে, তবে স্বাধীনতা লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯ শতাব্দীতে দেশটি ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বে একটি ক্রীড়নক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাজা ও তার আত্মীয়রা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মত রাজপরিবারের বাইরের একজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া হয়, যাতে রাজপরিবার আইন প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধানে দেশটিতে আরও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে রাজা কেবল নির্বাচিত আইনসভার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এসময় যাতে জাতিগত ও বামপন্থী দল গঠিত হতে না পারে, সেজন্য রাজা রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করেন। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সালে অরেক অভ্যুত্থানে নিষিদ্ধ বামপন্থী দল পিপল্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই দলের সাম্যবাদী শাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। তবে ইসলামী বিদ্রোহী মুজাহেদিনেরা এই শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুলের দখল নেয় এবং ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং তালেবানদের উৎখাত করে নিজের পছন্দমতো সরকার গঠনে সহায়তা করে। সেই থেকে দীর্ঘ দুই দশক যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখলে রাখে। অবশেষে তাদের বিদায় নিতে হয়। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আফগানিস্তানের এই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশটি বেশিরভাগ সময়ই বাহিরের শক্তি এবং তার পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ইতিহাসের সুদীর্ঘ এই ধারাবাহিকতায় অবশেষে আফগানরা তাদের নিজ দেশের শাসন ব্যবস্থায় ফিরতে যাচ্ছে।
তিন.
আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো এখন পর্যবেক্ষণ এবং অপেক্ষার নীতি অবলম্বন করছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তালেবান কি ধরনের সরকার গঠন করে এবং দেশটিতে আবার মৌলবাদের উত্থান ঘটে কিনা কিংবা নারীদের অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে বলেছে, আফগানিস্তানের মাটিকে সন্ত্রাসের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে না দেয়া এবং মানবাধিকার রক্ষার শর্তে ভবিষ্যতে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তালেবানের ওপর যতই নাখোশ হোক না কেন, তাদের স্বার্থেই আজ হোক কাল হোক তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। যে সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা তারা করছে, তা রুখতে আফগানিস্তান তথা তালেবান সরকারের কাছ থেকে দূরে থাকলে তাদের কোনো লাভ হবে না। বিচ্ছিন্নতার ভয় তাদের কুড়েকুড়ে খাবে। তাতে তালেবান সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, তারা দূরে থাকলে বা স্বীকৃতি না দিলেও পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে তালেবান এখন আর একা নয়। ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে কাজ করছে। এমনকি ভারতও এখন তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক করতে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব আফগানিস্তানকে আপাতত স্বীকৃতি না দিলেও অন্যান্য দেশ তার পাশে রয়েছে। ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর যে দুই-তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেল, এখন তার চেয়ে অনেকে বেশি দেশের সমর্থন পাচ্ছে তারা। এই সমর্থন যে সময়ের সাথে সাথে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এতে পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের যে ভয় ও আশঙ্কা রয়েছে তা অমূলক থেকে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক না রাখলে বা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলে, বিচ্ছিন্ন থেকে কি তারা শঙ্কা দূর করতে পারবে? সন্ত্রাসবাদের শঙ্কা দূর করতে হলে তালেবান সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে হবে। কারণ, তালেবান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। কাজেই, তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সহযোগিতা করাই হবে আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসমুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ রাখা। অন্যদিকে, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে নতুন এক বিশ্ব রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। আফগানিস্তান এমনই একটি দেশ যার ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশসহ পুরো এশিয়া ও ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশটির গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর চীন ঠেকাও যে নীতি, সেক্ষেত্রেও আফগানিস্তান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। উপমহাদেশে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে আফগানিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তালেবানও আফগানিস্তানকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহবান করেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রেও তারা কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমা বিশ্বের উচিৎ হবে না, আফগানিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। তাদের স্বার্থে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আফগানিস্তানে একটি ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ বা ভারসাম্যপূর্ণ সরকার গঠনে সহযোগিতা করা। আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাইরের শক্তির চাপিয়ে দেয়া সরকার নাকি নিজ দেশের স্বাধীন সরকারের অধীনে পরিচালিত হতে চায়, পশ্চিমা বিশ্বকে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
চার.
আফগানিস্তানের নতুন প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বিশ্ব এখন অনেকটাই দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশ, অন্যদিকে আঞ্চলিক এবং নতুন পরাশক্তির দেশ। সার্বিক বিবেচনায়, আফগানিস্তানকে কেউই উপেক্ষা করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে, তালেবানও আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে সরকার গঠনে মনোনিবেশ করেছে। ইতোমধ্যে বিশ বছর আগের তালেবান আর বর্তমান তালেবান নীতির মধ্যে পরিবর্তন রয়েছে। তালেবান বুঝতে পেরেছে, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দেশকে এগিয়ে নেয়া কষ্টকর। ফলে তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় এবং সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, তালেবান তার দেশের ইসলামিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই দেশ পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে। এ কথা অনস্বীকার্য, প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নিজস্বতা ধরে রেখেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। আফগানিস্তানও এর বাইরে নয়। তালেবান তার দেশের জনগণের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং সংস্কৃতি ধরে রেখেই এগুবে, এটাই স্বাভাবিক। এখানে কারো চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং উচিতও নয়। পশ্চিমা বিশ্বকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। আফগানিস্তানের নিজস্ব ধারাকে উপেক্ষা করে সন্ত্রাসবাদের শঙ্কায় পিছিয়ে গেলে, তাতে তাদের কোনো লাভ হবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।