Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা

| প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা পুঁজিতান্ত্রিক নয়া বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। বিগত শতকের আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে আফগানিস্তানে মুজাহিদ বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েত দখলদারিত্বের অবসানের মধ্য দিয়েই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে আন্ত:মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র সজ্জিত দুই পারমানবিক পরাশক্তির মধ্যকার ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান এবং এক নতুন ইউনিপোলার বা একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছিল। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যাটো সহযোগিদের নিয়ে আফগানিস্তানে ইতিহাসের বৃহত্তম সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে নিয়েছিল ২০০১ সালের অক্টোবরে। মার্কিন দখলদারিত্বের ২০ বছর ধরে আফগান তালেবানরা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে আগ্রাসী বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। অবশেষে তালেবানদের সাথে পরাজয় মেনে নিয়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে। প্রাথমিক সমঝোতায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা ঘোষণা করা হলেও প্রায় বিনাযুদ্ধে, অভাবনীয় দ্রুত গতিতে তালেবানদের কাবুল দখলের পর পুরো দৃশ্যপট বদলে যায়। সেনা ফিরিয়ে নেয়ার তারিখ একদিন কমিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৩১ আগস্টের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও কার্যত ৩০ আগস্টই ছিল আফগানিস্তানে সেনাদের অবস্থানের শেষদিন। পেন্টাগন থেকে প্রকাশিত এক টুইট বার্তার বরাতে গতকাল ইউএস টুডে অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ ও ছবিতে দেখা যায়, মার্কিন সেনাবাহিনীর ৮২তম এয়ারবোর্ন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল ক্রিস ডোনাহিউ কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানন্দরের রানওয়েতে একটি কার্গো বিমানে উঠার জন্য হেঁটে যাচ্ছেন। শেষ সেনাদের নিয়ে মার্কিন সামরিক কার্গো বিমানটি রানওয়ে ত্যাগ করার পরই তালেবানরা বিমানবন্দরটির রানওয়েতে হেঁটে গিয়ে চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করেন।

মার্কিন বাহিনীর সব সৈন্য ফিরে যাওয়ার অন্তিম মুহূর্তকে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে আখ্যায়িত করে আফগানিস্তানকে এখন সত্যিকার অর্থে ‘স্বাধীন সার্বভৌম’ বলে ঘোষণা করেছে তালেবান নেতারা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে তালেবানদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বিশ বছরে হাজার হাজার সহযোদ্ধা, লাখ লাখ আফগান স্বজন হারানোর বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় চলমান বিশ্বব্যবস্থার গতি পরিবর্তনের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মার্কিন ছত্রছায়ায় ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনে জায়নবাদী আগ্রাসন এখন প্রবল প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনও ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও চরম পরাজয়ের সম্মুখীন হল। সায়গন থেকে মার্কিন সেনাদের পলায়নের দৃশ্যের সাথে কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের তেমন পার্থক্য নেই। এ থেকে এটাই আবার প্রমানিত হল যে, শুধু সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জেতা যায় না। আগ্রাসী বাহিনীর মনোবল সব সময়ই দুর্বল থাকে। ইমানী শক্তিতে বলিয়ান যেকোনো ঐক্যবদ্ধ জাতি যেকোনো পরাশক্তিকে পরাভূত করতে পারে। আফগান তালেবানরা আবারো তার প্রমান করেছে। আফগানিস্তানের এই বিজয় তার জনগণের বিজয়। আফগান জাতি গত চারশ’ বছরে মোঘল, মোঙ্গল, বৃটিশ, রুশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিকে পরাস্ত করে স্বাধীনচেতা বিজয়ী শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। এ কথাও মনে রাখা দরকার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একশ্রেণীর নেতিবাচক মন্তব্য বা সমালোচনার মধ্য দিয়ে বর্তমান আফগানিস্তানকে বিচার করলে হবে না। আফগানিস্তানের জনগণ কি চায়, তাই দেশটির ভবিষ্যত নির্ধারণের মূল নিয়ামক শক্তি।

যেসব ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে আফগানরা বার বার পরাশক্তির আক্রমণ ও দখলদারিত্বের সম্মুখীন হয়েছে, এখন সেসব বিষয়কে সামনে রেখে সেখানে একটি স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও রাজনৈতিক বিভাজনের ঘেড়াটোপ থেকে আফগানদের রক্ষা করতে উন্নয়ন কর্মকাÐের সাথে রিকনসিলিয়েশন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের বিকল্প নেই। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আফগানরা আর কোনো পরাশক্তির ফাঁদে পা দিবে না। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের পাশাপাশি চীন, সউদী আরব ও রাশিয়াকে একটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রোডম্যাপ গ্রহণ করতে হবে। দেশটির পুনর্গঠনে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না। সেখানে আফগান জনগণের প্রত্যাশা ও সদিচ্ছার প্রতিফলন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের ভিত্তিতেই গড়ে তুলতে হবে। অন্যদেশের চাপিয়ে দেয়া বা আরোপিত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরাশক্তির পুতুল সরকার দুর্নীতি ও লুটপাট করে দেশকে দুর্বল করে দিলেও এদের দ্বারা কারোই চূড়ান্ত স্বার্থ হাসিল করা সম্ভব হয় না। এশিয়া, মধ্যএশিয়া ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে হিসেবে আফগানিস্তান বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের অন্যতম অংশীদার হিসেবে আফগানিস্তানে চীনা বিনিয়োগের যে নতুন সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে আফগান জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ বছরে আফগানিস্তানে দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে সেখানে যেসব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তা নিরসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। আফগান জনগণের এই মহাবিজয় যেন নতুন কোনো ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কবলে নস্যাৎ হয়ে না যায়, আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আফগানিস্তান বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি প্রশংসার দাবী রাখে। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন