পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের পক্ষে। বিজয়ীরাই সর্বদা ইতিহাসের আনুক‚ল্য পেয়ে থাকে। তালেবানের বর্তমান উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত কিছুদিন ধরে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেসব মিডিয়ায় তালেবানের সর্বদা বর্বর জঙ্গিগোষ্ঠি হিসাবে উপস্থাপন করা হতো, কাবুল বিজয়ের পর তারাই আজ তাদের স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসাবে আখ্যা দিচ্ছে। জনৈক ইতিহাসবিদের কথাই ঠিক যে, পৃথিবীর ইতিহাস আসলে বিজেতাদের ইতিহাস।
ধারণার চেয়েও নাটকীয়ভাবে তালেবান আবার কাবুলে ফিরে এসেছে। হেরাত, কান্দাহার, মাজার-ই-শরীফ, গজনী, জালালাবাদ হয়ে ঝড়ের গতিতে কাবুল দখলে নিতে তাদের তেমন কোনো বেগই পেতে হয়নি। লক্ষ কোটি ডলার ব্যয়ে আমেরিকানদের হাতে সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ নেয়া আফগান সেনাবাহিনী কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলেনি। একটি বুলেটও খরচ হয়নি। এমন রক্তপাতহীন বিজয় এ যুগে সত্যিই অভাবনীয়। আফগানিস্তানের সুশিক্ষিত একামেডিসিয়ান প্রেসিডেন্ট জান বাঁচাতে নিজের আভিজাত্য, কুলীনতা, মান-সম্মান, লাজ-শরম সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অবমাননাকর পথই বেছে নিয়েছেন। তড়িঘড়ি করে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নিতে আমেরিকান কর্তৃপক্ষের মরিয়া চেষ্টা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির পলায়নপর অসহায় চেহারা করুণভাবে তুলে ধরল। আর কাবুল বিমানবন্দরে আফগানদের বিমানের পাখা ধরে আকাশপথে দেশ ছাড়ার অভ‚তপূর্ব চেষ্টা তো যে কোনো বিচারেই নজিরবিহীন। সবকিছু মিলিয়ে সীমাহীন ঘটনাপ্রবাহের ঘনঘটা চলছে বিশ্বমিডিয়ায়।
আশির দশকে দক্ষিণ আফগানিস্তানের অতি সাধারণ একটি স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর একপর্যায়ে ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত তালেবান আফগানিস্তান শাসন করে। অতঃপর নাইন-ইলেভেনের পর চিত্র বদলে যায়। যেই আমেরিকা ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানের ব্যবহার করল, তারাই তাদের রুখতে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে। স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা মুহূর্তেই পরিচিত হয় জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে। তারপর বিগত ২০ বছর ধরে বহু অর্থ ব্যয় করে, সামরিক ক্ষমতার চ‚ড়ান্ত প্রদর্শনীর পরও তারা তালেবান নির্মূল করতে পারেনি। অবশেষে তাদের সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোকেই তারা সঠিক কাজ মনে করেছে। সেই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রায় রক্তপাতহীন এই দ্রুত বিজয়, যা কিনা খোদ আমেরিকাও কল্পনা করেনি। এই অনায়াস বিজয়ের পিছনে কয়েকটি কারণ লক্ষ্যণীয়।
(১) যুদ্ধ, সংগ্রাম, অস্ত্রবাজি আফগানদের প্রাচীন ঐতিহ্য। পশতুন জনগোষ্ঠীর প্রতিটি বাড়িতে অস্ত্র থাকাটা যেন আবশ্যক। তাদের ঘরে ঘরে অস্ত্রের সমাবেশ প্রমাণ করে, তারা কতটা যুদ্ধবাজ জাতি। আফগানিস্তানের আবহাওয়া ও মাইলের পর মাইল পাথুরে খাড়া পাহাড়ি ভূখন্ড বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদর্শ স্থান। এমন যুদ্ধপ্রিয় জাতির বিরুদ্ধে সেই প্রাচীনকাল থেকে কোন বিদেশি শক্তি এসে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। আমেরিকার মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তালেবানের নির্মূল করতে সমর্থ হয়নি।
(২) স্বাধীনচেতা আফগানরা বিদেশিদের উপস্থিতি কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইরত গোষ্ঠি হিসেবে সাধারণ আফগানরা তালেবানের সমর্থন দিয়েছে।
(৩) পশ্চিমাপন্থী আফগান সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি তালেবানের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন এনে দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অসংখ্য আফগানী শিক্ষার্থীর কাছে শুনেছি যে, অধিকাংশ আফগানের তালেবান গ্রুপকে সমর্থন করার কারণ হলো তালেবান আমলে আর যাই হোক দেশে কোনো দুর্নীতি ছিল না। সমাজে ন্যায়বিচার ছিল। ফলে সমাজে শান্তি ছিল। তাদের কট্টরপন্থা ও অমানবিক ক্রিয়াকর্মের যে সব অভিযোগ তোলা হয়, তার বেশিরভাগই অতিরঞ্জন। অফিস-আদালতে চোরাগোপ্তা হামলা, জনাকীর্ণ স্থানে আত্মঘাতি হামলা ইত্যাদি যেসব ভয়ংকর অপরাধ বিগত বছরগুলোতে সংঘটিত হয়েছে, তার অধিকাংশই বিচ্ছিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠি কিংবা বহিঃশত্রুদের হাতে ঘটেছে বলে তাদের বক্তব্য। সুতরাং তালেবানকে কোনো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠির সাথে তুলনা করার সুযোগ নেই।
(৪) সেদেশের গোত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী ও রক্ষণশীল। আর আফগান প্রশাসন ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা দেশের কোনো না কোনো গোত্রের সাথে স¤পর্কিত। ফলে নিজ নিজ গোত্রের তালেবানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বিদেশি সৈন্যদের পক্ষ হয়ে নিজ জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করার পিছনে তারা নৈতিক বল পায়নি। ফলে আধুনিক অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান হলেও খুব সহজেই তারা বিনা যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে, যখন খোদ আমেরিকাই তালেবানদের সাথে চুক্তি করেছে, তখন তারা আর এ যুদ্ধের কোনো অর্থ খুঁজে পায়নি।
(৫) আফগানরা জাতিগতভাবে কঠোর ধর্মপ্রাণ। ধর্ম তাদের জাতীয় সংস্কৃতির অত্যন্ত শক্তিশালী অঙ্গ। সুতরাং, তালেবানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ হিসেবে তারা মন থেকে সমর্থন জানিয়েছে। একথা নিশ্চিত যে, যথেষ্ট জনসমর্থন ও সেনাসমর্থন পেয়েই তালেবান শাসন ক্ষমতায় এসেছে। তবে এর পিছনে সমকালীন জটিল বিশ্বরাজনীতিও যে প্রবলভাবে ভ‚মিকা রেখেছে, তা বলাই বাহুল্য। নতুবা এত সহজে তালেবানের বিজয় সাধিত হতো না।
এখন কথা হলো, যারা ইসলামপন্থী তাদের অনেকেই তালেবানের এই যুদ্ধ ও বিজয়কে নিখাদ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। কিন্তু বিষয়টি একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। তালেবানের এই যুদ্ধ মুখ্য বিচারে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা যুদ্ধই, যা আফগানিস্তানকে বিদেশি আগ্রাসনমুক্ত করার জন্য পরিচালিত হয়েছে। তালেবানের বর্তমান অবস্থান ও বক্তব্যেই তা পরিষ্কার। সুতরাং, তাদের যুদ্ধকে তাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট থেকেই দেখতে হবে। আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। যদি তাদের দেশের জনগণ তাদের শাসনক্ষমতায় মেনে নেয়, তাতে অন্য কারো আপত্তি তোলার অবকাশ নেই, কিছু বলারও নেই।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় একেক সময় একেক দল আসবে-যাবে, এটাই সাধারণ রীতি। কেউ চাইলেই তা বাধা দিতে পারবে না। সুতরাং, সর্বাবস্থায় কর্তব্য হবে রাসুল (ছা.)-এর ভাষ্য অনুযায়ী, সর্বশ্রেণীর শাসকদের জন্য নছিহতের দুয়ার খোলা রাখা, যেন তাদের মধ্যকার যাবতীয় আক্বীদা-মানহাজগত ভুল কিংবা অন্যায়-অবিচারগত ভুল তারা সংশোধন করে নেয়। শাসক সবসময় ফেরেশতাতুল্য হবে, এটা সম্ভবপর নয়। শাসক যেমনই হোক, তাদের জন্য সর্বদা কল্যাণ কামনা করতে হবে, তাদের নছিহত করতে হবে এবং তাদের সামনে সর্বদা হক কথা বলতে হবে- এমন স্পষ্ট নির্দেশনা রাসুল (সা.) স্বীয় উম্মতকে দিয়ে গেছেন। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আমরা বলতে পারি, তালেবান যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামী ইমারত গড়ে তুলতে চায়, তবে তাদের প্রতি মুসলিম হিসেবে আমাদের সমর্থন থাকবে। কিন্তু এজন্য তাদের অবশ্যই পরিণামদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। যদি তারা মুসলমানের রক্ত হালাল করে নেয়া, মানবাধিকার লংঘন করা, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি থেকে সরে আসা, শিরক-বিদ‘আতের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করা প্রভৃতি ভ্রান্ত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তবে সারাবিশ্বের মুসলমানদের আন্তরিক দো’আ ও ভালোবাসা তারা পাবে। নইলে তারা জনসমর্থন হারাবে এবং বিশ্ব মুসলিম সমাজ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
পরিশেষে সাধারণ মুসলমান হিসেবে আমাদের কামনা থাকবে, তালেবান যেন রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে ইসলামের বিশুদ্ধ ধারক ও বাহকদের পথ গ্রহণ করে। যে রাষ্ট্রক্ষমতা আল্লাহ তাদের উপর আমানত হিসেবে দিয়েছেন, তা যেন যথাযথভাবে রক্ষা করে। ইসলামের প্রকৃত শাসন ও শান্তির সুবাতাস তারা ছড়িয়ে দিক, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে পুনর্গঠন এবং আফগানদের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের কঠিন দায়িত্বকে তারা সুচারুরূপে আঞ্জাম দিক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।