পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্তমান বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ন্যাক্কারজনকভাবে পরাস্ত করে তালেবান আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব করায়ত্ত করেছে। শুধুমাত্র দলীয় ঐক্য, শৃঙ্খলা, ঈমানী শক্তি, বিচক্ষণতা ও আমজনতার সমর্থনের কারণেই তারা এই নজিরবিহীন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। ব্যাপক জনসমর্থন না থাকলে কারও পক্ষেই দীর্ঘদিন গেরিলা যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আফগান যুদ্ধে ভিয়েতনামের চেয়েও খারাপ পরিণতি হয়েছে আমেরিকার। আর ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর এটাই সংস্থাটির বড় পরাজয়। তাই ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ বলে বহুল প্রচলিত উক্তিটি ভুল। কারণ, তালেবান তো মাদরাসা পড়ুয়া মোল্লারাই। এর আগেও তালেবান যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে ৫ বছর দেশ পরিচালনা করেছিল। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর ভয়াবহ আক্রমণে তালেবান সরকারের পতন হয়। অতঃপর তারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা গ্রামাঞ্চল দখল করতে করতে অর্ধেকের বেশি অঞ্চল দখল করে শাসন করে। এর পর গত ৬ আগস্ট শহর দখলের অভিযান শুরু করে। মাত্র ৮ দিনের মধ্যেই তারা ২৮টি প্রদেশ দখল করে নেয়। ফলে বিস্ময় সৃষ্টি হয় সারাবিশ্বে। আর ১৫ আগস্ট সরকারি ও বিদেশি বাহিনীর কোনো বাধা ছাড়াই বিনা রক্তপাতে রাজধানী কাবুল দখল করে তারা।
তালেবানের বিজয়ের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট গনি, অনেক মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, সাবেক মুজাহিদ কমান্ডার রশিদ দোস্তাম ও আতা মোহাম্মদ দেশ থেকে পালিয়েছেন। কমান্ডার ইসমাইল খান ও বালখে’র গভর্নর সালিমা মাজারি বন্দি হয়েছেন। এছাড়া, হাজার হাজার সেনা দেশ ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ করেছে। গনি শেষাবধি আবুধাবিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি পালানোর সময় বিপুল অর্থ নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী ও সন্তানরা আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পলাতক আফগান প্রেসিডেন্ট গনিকে আর আফগানিস্তানের কোনো কর্মকর্তা বলে স্বীকার করে না। অপরদিকে, সারাদেশের মানুষের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি হয়। তাই রাজধানীতে আসার হিড়িক পড়ে। আবার রাজধানী দখলের পর তারা বিদেশে যাওয়া শুরু করে। বিমান বন্দর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ফলে ২০ জনের অধিক নিহত হয় গুলিতে এবং পদদলিত হয়ে। অনেক দেশ বিমানে করে তার লোক ও আফগানদের নিতে থাকে। সীমান্ত দিয়েও বহু মানুষ দেশ ত্যাগ করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তাই সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।
তালেবানের বিজয়ের দু’দিন পর থেকেই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, দোকান, বাজার খুলতে থাকে। নারীরাও অংশগ্রহণ করছেন তাদের কাজে। যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। টিভিতে নারীরা সংবাদ পাঠ ও উপস্থাপনা শুরু করছেন। দেশটির জাতীয় ক্রিকেট দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার অনুশীলন শুরু করেছে। পালিয়ে যাওয়া আফগানদের ফেরত পাঠাতে উজবেকিস্তানের সাথে চুক্তি হয়েছে তালেবানের। দেশটি কিছু আফগানকে ফেরত পাঠিয়েছে। এছাড়া, দখলদার সেনাদের ভয়ে যারা দেশ ত্যাগ করেছিল, তাদের অনেকেই দেশে ফিরতে শুরু করেছে। তালেবানের অনুরোধে আফগানিস্তানে পুনরায় জ্বালানি তেল রফতানি শুরু করেছে ইরান। আফগানিস্তানে কর্মরত বাংলাদেশি এক প্রকৌশলী গত ২৩ আগস্ট বিবিসিকে বলেন, আমি ১৮ বছর যাবত এ দেশে কাজ করছি। তালেবানের বিজয়ের পর কোনো নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি না। আমাদের টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে কর্মরত আফগানরা নিয়মিত ফিল্ড ওয়ার্ক করছে। তারা কোনো অসুবিধা বোধ করছে না। তবে, সকলের মধ্যে কিছুটা ভয় রয়েছে। তাই আমাদের কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশিরা দেশে চলে গেছে। কাবুল ফেরত ভারতীয় শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য কলকাতায় ফিরে এসে বলেছেন, তালেবানরা শিক্ষকদের খুবই সম্মান করে। তাই আমি বাইরে গেলে তারা আমাকে পাহারা দিত। জার্মান ও ইরান বেতারে প্রকাশ, ধীরে ধীরে আফগান নারীরা কাজে যোগ দিচ্ছেন। বেশ কিছু দূতাবাস চালু আছে।
যুদ্ধে জয়ী হয়েও তালেবান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে, যার সদস্য হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। তালেবান সরকার গঠিত হলে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এটা বর্তমান বিশ্বে এক নজিরবিহীন ঘটনা। অনুমেয় যে, সব বিদেশি সেনা না যাওয়া পর্যন্ত তালেবান সরকার গঠন করবে না। বিদেশি সব সেনার যাওয়ার শেষ সময় আগামী ৩১ আগস্ট। অবশ্য, সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তালেবান। দলটির সহ প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা বারাদার কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন। তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তিনি সকলের অংশগ্রহণে সরকার গঠনের জন্য তালেবান নেতা ও অন্য দলের নেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করেছেন। তালেবান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও দেশব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেক পোস্ট বসিয়েছে। কাবুলে নতুন মেয়র, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর এবং কাবুলের গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী হিসাবে গুল আগাকে, ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে সদর ইব্রাহিম, গুয়ানতানামো বের সাবেক কারাবন্দী মোল্লা আবদুল কাইয়ুম জাকিরকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গোয়েন্দাপ্রধান হিসাবে নাজিবুল্লাহর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, আফগানিস্তানে থেকে পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের দমনের জন্য একটি কমিশন, মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তালেবানের বর্তমান কর্মকান্ডে মনে হয়, আগের তালেবান আর বর্তমান তালেবান এক নয়। আগের তালেবান ছিল খুবই কট্টর ভাবাপন্ন। আর বর্তমান তালেবান হচ্ছে উদার ভাবাপন্ন। আধুনিকও। তাই তারা আগে আইটি ব্যবহার না করলেও এখন আইটি ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছে। তারা খুব দক্ষও। দীর্ঘদিন যাবত বিশ্ব স¤প্রদায়ের সাথে সংলাপ করে ও মিডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেদের পক্ষে অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করেছে। তাদের সাম্প্রতিক ঘোষিত নীতিসমূহও খুবই উদার। যেমন: সকল নাগরিকের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান রক্ষার অঙ্গীকারসহ অতীত কর্মের জন্য সকলকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে। সরকারি প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন স্বাভাবিকভাবে চলবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সবাই মিলে দেশকে নির্মাণ করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়েছে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা যেন তাদের ব্যবসা স্বাভাবিকভাবে চালায় ও জনগণের সেবা করে, তার তাকিদ দেয়া হয়েছে। তালেবানের তরফে বলা হয়েছে, সকল ক‚টনীতিক, দূতাবাস, কনস্যুলেট ও দাতব্য কর্মীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। ‘আফগানিস্তানে নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষা করা হবে। নারীদের তাদের বাড়িতে একা থাকার অনুমতি দেয়া হবে এবং তাদের শিক্ষাগ্রহণ ও কাজের সুযোগ অব্যাহত রাখা হবে। তালেবান না হলেও তাদেরকে সরকার গঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বোরকা বাধ্যতামূলক নয়, হিজাব পড়লেই চলবে। আফগানিস্তানের বাইরে তালেবানের কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। ২০ বছর আগের অবস্থায় এখন আমরা আর নেই। অভিজ্ঞতা, পরিপক্বতা ও লক্ষ্যের দিক দিয়ে আমরা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছি। বেসরকারি গণমাধ্যম অবাধে ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু সাংবাদিকদের জাতীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করা উচিত নয়। দেশ চলবে ইসলামী শরিয়াহ আইনে। এখন থেকে আফিম ও চোরাচালান নিষিদ্ধ। এসব প্রতিশ্রুতির পর এ পর্যন্ত কেউই, এমনকি তাদের ঘোর শত্রুরা পর্যন্ত কোনো সমালোচনা করেনি। তাই অনুমেয়, তালেবান ঘোষিত নীতিগুলো দেশ-বিদেশে গৃহীত হয়েছে। তাদের অতীত নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে। স্মরণীয় যে, তালেবান দীর্ঘদিন যাবত গ্রামাঞ্চল এবং গত ১৫ আগস্ট থেকে সমগ্র দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোথাও থেকে লুটপাট, সহিংসতা ও দুর্নীতির খবর পাওয়া যায়নি। অপরদিকে, আমেরিকার কংগ্রেসের ওয়াচডগ সংস্থা সিগার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গত দু’দশক ধরে আমেরিকার বরাদ্দ করা কয়েক হাজার কোটি ডলার ফুঁৎকারে উড়ে গেছে। সাধারণ আফগানের কোনো কাজেই লাগেনি।’ এমনকি পুলিশ ও সেনারাও নিয়মিত বেতন পেত না। পুলিশের বেতন বকেয়া রয়েছে গত ৮ মাস যাবত।
তালেবানের বিজয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলিম জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। আর চরম নাখোশ হয়েছে ইসলামের শত্রুরা। তাই তারা তালেবান বিরোধী ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। আতংকও ছড়াচ্ছে। তিলকে তাল বানাচ্ছে, যা ফলাও করে প্রচার করছে তাদের ঘরানার মিডিয়াগুলো। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়া অগ্রগামী। বিশ্ব নেতৃবৃন্দও তালেবানের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য তদ্বির ও বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করছেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত পান্ডে বলেছেন, আফগানিস্তান একটি কবরে পরিণত হয়েছে। পুরো দেশটিতে মানবিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। পাক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বকে অবশ্যই আফগানিস্তানকে সহায়তা করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, তালেবানের নেতৃত্ব স্পষ্ট হলে তিনি দলটির সাথে আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছেন। ওআইসির বিশেষ বৈঠকে নেতৃবৃন্দ আফগানিস্তানে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং দেশটির উন্নয়নে সহায়তা করতে জোটের সদস্যদেশগুলোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, নতুন করে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে আশ্রয় দেয়া দেশটির উচিত হবে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, তালেবান আফগানিস্তান মোটামুটি দখল করেই নিয়েছে। তাই নিজেদের মতামত আফগানিস্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া উচিত নয় অন্য দেশগুলোর। জি-৭ জোট নেতারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নমনীয়তা ও নারী অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেই তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
তালেবানের বিজয়ের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন দেশে পড়তে শুরু করেছে। আফগানিস্তান থেকে দ্রুত সব সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। ট্রাম্প তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। চীন বলেছে, বর্তমান আফগান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। রাশিয়া বলেছে, আমেরিকানরা ঘরে ফেরেনি, তারা পালিয়েছে। আফগানিস্তানে পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তিত্ব দুর্বল হয়েছে। ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এশিয়া সফর করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো সুফল হবে বলে মনে হয় না। এবার মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে থাকা মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নেয়া শুরু হতে পারে। ন্যাটোর কাছ থেকে আফগানিস্তান ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় করা উচিৎ বলে অনেক দেশ জানিয়েছে। এটা হলে যখন তখন যেকোন অজুহাতে কোনো দেশে আক্রমণ চালানো বন্ধ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পর সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। কারণ, ভারতের ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে আফগানিস্তানে। এছাড়া, সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও মেইনটেন্সের কাজ করতো, যা হাতছাড়া হয়েছে। উপরন্তু তালেবান ইস্যুতে ভারত আঞ্চলিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য ভারতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার।
দীর্ঘকালীন যুদ্ধে আফগানিস্তান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, ‘আফগানিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে মূলত সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে। বর্তমানে দেশটির দারিদ্র্যের হার ৭০% ও বেকারত্বের হার ৪০%। দেশটি দুর্নীতি ও মাদকে ভরপুর। অসংখ্য মানুষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে আছে। দেশটিতে এখন তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নগণ্য। এসব হয়েছে পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের দখলদারিত্বের কারণে। এই অবস্থায় তালেবানের বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাড়ে নয়শ কোটি ডলারের সম্পদ জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিত করেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। এসব অত্যন্ত অন্যায় ও অবিচারের শামিল বলে জানিয়েছে তালেবান।
যুদ্ধ জয়ের চেয়ে যুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা বেশি কঠিন। তেমনি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা কিংবা প্রতিশ্রুতি দেওয়া যত সহজ, তা বাস্তবায়ন করা তত সহজ নয়। কারণ, কর্মপরিকল্পনা কিংবা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় অর্থ লাগে। সর্বোপরি মানুষ তার জীবনমান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে না। তাই তালেবানকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে স্বল্প দিনের মধ্যেই। এখনই যা করতে হবে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো: নিজেদের মধ্য ঐক্য ও শৃঙ্খলা অটুট রাখা, দেশের সব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে নির্মূল ও সব বেসরকারি আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা, দল-মত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে সরকার গঠন করা। জনহিতৈষী শাসন, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এইসঙ্গে সামরিক ব্যয় হ্রাস ও প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহারসহ দেশ পুনর্গঠন, শরণার্থী ও বাস্তচ্যুতদের পুনর্বাসন ও দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে। এসবের জন্য বিপুল অর্থ দরকার, যা দেশীয় অর্থ দিয়ে সম্ভব নয়। তাই বিদেশি বিপুল ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগ দরকার। চীন পুনর্গঠনের জন্য অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবুও প্রয়োজনীয় অর্থের সবটা চীন থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অন্য দেশের এবং সংস্থারও ব্যাপক ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগ দরকার। এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, ওআইসি ও ধনী মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে পারে। আফগানিস্তান খুবই সম্ভাবনাময় দেশ। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মধ্য এশিয়ায় যাতায়াতের প্রধান পথ। এছাড়া, দেশটিতে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রয়েছে। অনুত্তোলিত খনিজ মজুদের পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার বলে খবরে প্রকাশ। সর্বোপরি দেশটির মানুষ খুবই সাহসী ও কর্মঠ। দেশটির ইতিহাস-ঐতিহ্যও সমুজ্জ্বল। একদা তারা অনেক অঞ্চল শাসন করেছে। উপরন্তু তারা বহুবার পরাশক্তিকে পরাভূত করে দেশকে মুক্ত করেছে। তাই সঠিক নেতৃত্ব পেলে এবং দুর্নীতি ও মাদক নির্মূল, দেশীয় সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার ও কানেক্টিভিটি জোরদার করতে পারলে স্বল্প দিনের মধ্যেই দেশটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আর দেশটি শান্তি ও উন্নতির পথে ধাবিত হলে তালেবানের বিজয় ও রাষ্ট্র পরিচালনা চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে অনেক দেশ তালেবান সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য। অনুমেয় যে, চীন ও রাশিয়ার কারণে দেশ দুটির বলয়ভুক্ত দেশগুলোও অচিরেই একই পথ অনুসরণ করবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।