Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আফগানিস্তানে ধরাশায়ী মুঘল ব্রিটিশ রুশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধে লাখ লাখ আফগান নাগরিক ও মার্কিনী-ন্যাটো বাহিনীর হাজার হাজার সেনার মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বরণের পর আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে তালেবানের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পুরনো হিসাব নিকাশ পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এমনটা কেউ আঁচ করতে না পারলেও একটি অসম যুদ্ধ ২ দশক ধরে প্রলম্বিত হওয়া এবং তালেবানের যুদ্ধক্ষমতায় চিঁড় ধরানোর ব্যর্থতার যে চিত্র গত দশকের শুরুতে দেখা গিয়েছিল, তাতে অনুমান করা যাচ্ছিল আফগানিস্তানের ভূমিপুত্রদের হাতে আবারো পরাশক্তির পরাজয় ঘটতে চলেছে। গত দুই দশকে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার একযুগ পর তিরিশের দশকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছিল, যা ইতিহাসে গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন আভ্যন্তরীন ফ্øাইটের বিমান চালিয়ে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার এবং মার্কিন সামরিক সদরদফতর পেন্টাগনসহ তিনটি স্থানে বিমান হামলার জবাবে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জবুশ যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালিয়ে দেশ দুটিকে দখল করে নেয়া সেই অন্তহীন যুদ্ধেরই অংশ ছিল। জর্জবুশ তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আক্ষরিক অর্থেই তথাকথিত সন্ত্রাসীদের (মুসলমান) বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ বা ধর্মযুদ্ধ শুরুর কথা বলেছিলেন। কৌশলগত কারণে সে অবস্থান থেকে সরে আসলেও তারা যুদ্ধের মূল টার্গেট থেকে সরে আসেনি। মার্কিন সরকার, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তরফে নাইন-ইলেভেন হামলার ঘটনার যেসব তদন্ত কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার কোনোটিতেই সেসব ঘটনায় আল কায়েদা বা তালেবানের সম্পৃক্ততার অকাট্য কোনো তথ্য-প্রমান খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং নানা আলামত ও বিশেষজ্ঞ মতামতে নাইন-ইলেভেন হামলার ঘটনার সাথে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার যোগসূত্রের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার আগের দিন পর্যন্ত নিউইর্য়কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে থাকা ইহুদি মালিকানাধীন কর্পোরেট কোম্পানীগুলোর অফিস সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, অথবা হামলার দিন হাজার হাজার ইহুদি কর্মী ও কর্মকর্তাদের প্রায় সকলেই অনুপস্থিত ছিল। এ কারণে বিভিন্ন দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ টুইন-টাওয়ার ভবন ধসে মারা গেলেও ইহুদি ব্যবসায়ী বা নাগরিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য ছিল। মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরে জুইশ লবির প্রভাবের কারণে নাইন-ইলেভেন তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে অনেক লুকোচুরি ও গোজামিল থাকলেও গত ২০ বছরে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু গ্রন্থ এবং সামরিক বিশ্লেষকদের মতামত প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন লেখক জাস্টিন রাইমান্দোর লেখা ‘দ্য টেরর ইনিগমা ৯/১১ অ্যান্ড ইসরাইলি কানেকশন’ বইটি ২০০৩ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে নাইন-ইলেভেন ঘটনার সাথে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা অকাট্যভাবে তুলে ধরেছেন রাইমান্দো।

শতাব্দীর বৃহত্তম সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান দখলের সিদ্ধান্তকে মার্কিন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ভুল সিদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন আরেক মার্কিন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছি’। তবে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে মার্কিন সেনাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করায় তার প্রতিদ্ব›দ্বী ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন ট্রাম্প। সিদ্ধান্তে ভুল থাকলেও এই যুদ্ধে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে, সেই খরচের বড় অংশই গেছে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের সমরাস্ত্র বাণিজ্যের অ্যাকাউন্টে। মন্দা অর্থনীতিতে অধিক মুনাফার লক্ষ্য অর্জনে এটিই ছিল সর্বোত্তম পন্থা। প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করার পর জর্জ বুশের উত্তরসূরী বলেন, এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত, তবে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ওয়ার প্রফিটিয়ারিংয়ের রাস্তা খোলা রাখতে তিনি সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সমর্থন করতে পারছেন না। এটাই হচ্ছে এখনকার পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বহু বছর ধরেই কর্পোরেট পুঁজিবাদের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। পুঁজি ও ক্ষমতার ম্যাকানিজমের প্রভাব এতটাই প্রত্যক্ষ ও প্রগাঢ় যে, এর বাইরে গিয়ে রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট কাউন্সিলে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ খুবই ক্ষীণ। বর্ণবাদ বিরোধিতা, প্রকৃত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দেশের সম্পদের উপর জনগণের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও ম্যালকম এক্স’র মত সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারক নেতাদের আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগান দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত ব্যক্তিরা মার্কিন গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ ও কলঙ্কিত করা ও বর্ণবাদী সন্ত্রাস চালুর মধ্য দিয়ে জায়নবাদী ইহুদিদের স্বার্থ হাসিলে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব ও অংশীদারিত্বের অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতেও কুণ্ঠিত হননি। আফগানিস্তান দখলের সিদ্ধান্তকে শতাব্দীর সেরা ভুল বলে আখ্যায়িত করার সাথে সাথে জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকেও ভুল দাবি করা ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে কত বড় ভুল করেছেন, তা বুঝতে যদি জো বাইডেন বা পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টেদের আরো ২০ বছর সময় লেগে যায়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে আফগানিস্তানের চেয়ে অনেক বড় ভূ-রাজনৈতিক পরাজয় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। গত এক দশকে অন্তত তিনবার হেজবুল্লাহ ও হামাসের হাতে নাস্তানাবুদ ইসরাইলী সেনাবাহিনীকে আর অজেয় শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমের স্বীকৃতি ও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পুরনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই হতে পারে মার্কিনীদের মুখ রক্ষার শেষ কৌশল।

গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিশ্ব সংবাদের অন্যতম প্রধান শিরোনাম হয়ে আছে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় ও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ঘটনাক্রম। অনেকে এখনো এমআইসি ও কর্পোরেট প্রোগাগান্ডার পুরনো ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাচ্ছেন। খোদ মার্কিন প্রশাসন যখন তালেবানদের সাথে কাজ করার পথ খুঁজতে শুরু করেছেন, তখন উপমহাদেশের পশ্চিমা বশংবদ স্যেকুলার বুদ্ধিজীবীদের ছা-পোনারা তালেবানদের সন্ত্রাসী-কাঠমোল্লা আখ্যা দেয়া এবং আফগানিস্তানকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার শোকে মাতম তুলতে শুরু করেছে। গত ১৫ আগস্ট ২০ বছর পর বিনাযুদ্ধে তালেবানদের কাবুল দখলের আগেই মার্কিন বাহিনী কমান্ডাররা কাবুলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে ১১ সেপ্টেম্বরের টাইমলাইনে পড়ার আগেই আফগান কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে বিমানযোগে পালিয়ে যেতে শুরু করে। প্রায় সকলেরই ধারনা ছিল, তালেবানের কাবুল দখলের সময় ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘাত হবে, অনেক প্রাণহানি ঘটবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তালেবানরা নিজস্ব ঘরানার শরিয়া আইন চাপিয়ে দিয়ে একটি অদ্ভুত শাসন কায়েম করবে ইত্যাদি। তেমন একটি বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি তৈরী হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা তাদের তালেবানবিরোধী যুদ্ধের একটি জাস্টিফিকেশন দাঁড় করাতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেল। একটিও গুলি না ফুটিয়ে, বিনাযুদ্ধে কাবুল দখলের পর সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী সবার মাঝে পৌঁছে দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ তৈরীর প্রাথমিক উদ্যোগে বেশ সফল হয়েছেন তালেবান কমান্ডাররা। কাবুল তালেবানদের দখলে যাওয়ার পর যেসব বেসামরিক লোকজন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত-আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, তালেবানরা প্রথমেই তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের সুবাদে আফগানিস্তানে নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবের মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলতে সেখানে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল ভারত। মার্কিনীদের পলায়নের পর থেকে ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক-কূটনৈতিক ব্যক্তিরাও সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সেই সাথে আফগানিস্তানে আবারো তালেবানি শাসনের জুজু নিয়ে একশ্রেণীর ভারতীয় নেটিজেনের যেন ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আফগানিস্তানে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশটি পিছিয়ে যাবে, নারী স্বাধীনতা খর্ব হবে, অধিকার হারাবে ইত্যাদি দুশ্চিন্তা যেন তাদের গ্রাস করে ফেলেছে। অথচ কাবুলে তালেবানের শুরুটা ছিল অভাবনীয় চমৎকার, শান্তিপূর্ণ। তারা ভারতীয়দের নির্বিঘেœ তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার অভয় দিয়েছে। কাবুল থেকে ফিরে আসা একজন ভারতীয় শিক্ষক তালেবানদের কাবুল দখলের পরবর্তী অবস্থার যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, গত কয়েক দিনে তা ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। তমাল ভট্টাচার্য নামের সেই যুবক শিক্ষক-এনজিও কর্মী বলেছেন, তালেবানরা কাবুলে প্রবেশের পর তাদের শরিয়া ব্যবস্থায় কাবুলে নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ব্যবসায় বাণিজ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি বলছেন, শরিয়া শাসনে কাউকে ঠকানোর সুযোগ নেই। তালেবানরা কাবুলে ঢোকার আগে ১৪০ টাকায় যে কাবাব খাওয়া হতো, তালেবানদের আগমনের সাথে সাথে কাবাবে গোশতের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ভারতীয়সহ বিদেশিদের উপর তৃতীয় কোনো পক্ষ হামলা করে যাতে তালেবানদের উপর বদনাম চাপাতে না পারে, সে জন্য তারা বিদেশি নাগরিক ও নারীদের নিরাপত্তায় বাড়তি ব্যবস্থা করেছে। একজন ভারতীয় প্রত্যক্ষদর্শীর এই সাক্ষ্য তালেবান ও মুসলিম বিদ্বেষী নেটিজেনদের প্রোপাগান্ডার বেলুনটিকে অনেকটাই চুপসে দিয়েছে। তবে গত কয়েক দিন ধরে আসামসহ বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে তালেবানের পক্ষে ফেইজবুক পোস্ট দেয়ার কারণে বেশকিছু মানুষকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় পুলিশ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তৃতীয় বিশ্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, তালেবান-আলকায়েদা, ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় সম্পর্কে ভারতীয়দের মধ্যে উৎকণ্ঠা যেমন আছে, তেমনি কিছু মানুষের উচ্ছ্বাসও থাকবে। ভারতের সাথে স্বাভাবিক বাণিাজ্যিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে তালেবানের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হলেও তালেবানের পক্ষে মতামত দেয়ায় ভারতে পুলিশি হয়রানি আফগানিস্তানের নতুন বাস্তবতা নিয়ে ভারত সরকারের নীতিগত অবস্থানকেই নির্দেশ করছে।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের পশতুন সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতকের আফগান পশতু কবি খোশালখান খাট্টক সে দেশের স্বাধীনচেতা মানসসত্তার প্রতীক হয়ে আছেন। খোশাল খান খাট্টকের দাদা মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাট্টক সম্প্রদায়ের দলপতি ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর তার পিতা শাহবাজ খান খাট্টক সম্প্রদায়ের দলপতি নির্বাচিত হন এবং সম্রাট শাজাহানের আনুকূল্য ও সেনা কমান্ডার হিসেবে মানসবদার পদমর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু আফগান জনগণ কখনো মুঘলদের আধিপত্য সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সেখানে খাট্টক, ইউসুফজাই, বারাকজাই, দুররানি সম্প্রদায়ের মধ্যকার দ্ব›দ্বকে কাজে লাগিয়ে বাইরের শক্তি আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করেছে। খাট্টক ও ইউসুফজাই সম্প্রদায়ের বিরোধের জেরে শাহবাজ খানের মৃত্যুর পর খোশাল খান খাট্টক নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে মুঘলরা তাঁকে খাট্টক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে তাঁর পুত্রকে ক্ষমতায় বসানোর পর খোশাল খান মুঘলদের বিরুদ্ধে পুরো পশতুন জাতিগোষ্ঠীর বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা শুরু করেন। কবিতার মধ্য দিয়ে পশতুন জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে খোশাল খান অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই প্রেরণা পরবর্তী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগানদের প্রেরণাদায়ি শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ঊনবিংশ শতকে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এখানে বৃটিশ ও রাশিয়ার আধিপত্যের লড়াই চরম আকার ধারণ করে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সুযোগে আফগান নেতা দোস্ত মোহাম্মদকে সরিয়ে শাহ সুজাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার পর বৃটিশদের বিরুদ্ধে আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮৩৯-৪২ সালে প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে বৃটিশরা সেখানে আধিপত্য কায়েম করতে ব্যর্থ হয়, আফগান প্রতিরোধের মুখে বৃটিশ বাহিনী দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার পর শাহ সুজা নিহত হয় এবং দোস্ত মোহাম্মদ বুখারা থেকে ফিরে এসে পুনরায় মসনদে বসেন। দোস্ত মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার তৃতীয় পুত্র শের আলী খান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে সময় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেইলি লর্ড লিটনকে ভারতের গর্ভনর নিযুক্ত করার পর তিনি আফগানিস্তানে রাশিয়ান প্রভাব ঠেকাতে কাবুলে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলে শের আলি খানের বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে দিল্লী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ভাইসরয় লর্ড লিটনের ভাষায়, আফগানিস্তান হচ্ছে বৃটিশ ও রাশিয়ার মত হেভি মেটালের মাঝখানে একটি ‘আর্থেন পিপকিন’ বা মাটির পাত্র। যেকোনো মূল্যে সেখানে রাশিয়ার প্রভাব থামিয়ে দিতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে একটি সাময়িক বিজয় লাভ করলেও তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

ভৌগোলিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে প্রাচীনকাল থেকেই আফগানিস্তান বিশ্বরাজনীতি, বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। স্থানীয় আফগান সম্প্রদায়গুলো প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথেই লড়াই করেছে। ইসলামের প্রথম যুগেই আফগানিস্তানের জরথ্রুস্তবাদীদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর পর তা ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। আলেকজান্ডারের সমরাভিযান থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ও হিন্দুশাহী পর্যন্ত পরবর্তী প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরাশক্তি আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। তবে আফগানিস্তানে মুসলমান শাসকদের বিজয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশটি এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পাদপীঠ হয়ে ওঠে। একাদশ শতকের শুরুতে গজনির সুলতান মাহমুদ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রাজাদের মধ্যকার দ্ব›দ্ব-সংঘাতের মধ্যে সিরিজ সামরিক অভিযান চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। কথিত আছে সুলতান মাহমুদ ১৭বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহামম্মদ বাবর আফগানিস্তান থেকে এসেই ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সম্রাট বাবর ১৫৩০ সালে আগ্রায় মৃত্যুবরণ করলেও তার কবর হয় কাবুলে যা বাগ-এ বাবুর নামে পরিচিত। তবে আফগানরা শেষ পর্যন্ত দিল্লী কেন্দ্রিক মুঘল শাসন বা বৃটিশ শাসন মেনে নেয়নি। আফগানদের এই জাতীয়তাবোধ ও জাত্যাভিমান বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য গাত্রদাহের কারণ ছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে জামালউদ্দিন আফগানি যে প্যান ইসলামিজমের আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। জামালউদ্দিন আফগানির আন্দোলন সফল হলে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমাদের শত বছরের মাস্টারপ্ল্যান অসম্ভব ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ উত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের যেকোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থানের পথকে অত্যন্ত সুকৌশলে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছিল। বৃটিশ, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া এবং মার্কিন হস্তক্ষেপ সাম্প্রতিক বাস্তবতা। আফগান তালেবান বা মুজাহিদরা ইসলামিক শরিয়া বা ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে কতটা লালন করতে পারছে, সে প্রশ্নে না গেলেও আফগানিস্তানের নির্ভীক তালেবানরা এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, ব্যক্তিগত লালসার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবে আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলা করলে যেকোনো বড় শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব। তিন লাখের বেশি সদস্য নিয়ে আত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত বিশাল আফগান সামরিক বাহিনীকে ২০ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্যের উপস্থিতি সত্তে¡ও মাত্র ৮০ হাজার আফগান তালেবানের কাছে চরম পরাজয়ের শিকার হওয়ার ঘটনা আধুনিক বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ বছর ধরে আফগানিস্তানকে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু উপত্যকতায় পরিণত করা বিদেশি বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসরদের উপর একটিও গুলি না চালিয়ে রাজধানী শহর দখলে নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজস্ব শাসন পদ্ধতি পুন:প্রতিষ্ঠার বিরল নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে তালেবান কমান্ডাররা। সাম্রাজ্যবাদের কুশীলবরা সামনের দিনগুলোতে কি ভূমিকা রাখে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তালেবানরা কতটা সফল হয় তা দেখতে আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
[email protected]



 

Show all comments
  • নূরুল ইসলাম ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৩৭ এএম says : 0
    মা শা আল্লাহ। জাযাকাল্লাহু খাইরান। লেখক অনেক সুন্দর ভাবে বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • নূরুল ইসলাম ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৪৩ এএম says : 0
    মা শা আল্লাহ। জাযাকাল্লাহু খাইরান। লেখক অনেক সুন্দর ভাবে বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • নাজনীন জাহান ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
    সাম্রাজ্যবাদী দখলদার বাহিনীর কবরস্থান
    Total Reply(0) Reply
  • Kazi Arif ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
    ব্রিটিশ পরাজয় বরণ করছে রাশিয়া পরাজয় মেনে নিছে আমেরিকা লেচ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে । যাদের দেশ তাঁরাই টীক করবে দেশটা কি ভাবে চলবে দালালী করে কোন লাভ নাই ।
    Total Reply(0) Reply
  • নাজমুল ইসলাম ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
    মোল্লাদের মাথার পাগড়ী কেবল মসজিদে ইমামতির জন্য নয়, এ পাগড়ী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যেও!
    Total Reply(0) Reply
  • Salman Ahmed ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
    এ বিজয়েও যেন মক্কা বিজয়ের সেই প্রতিধ্বনি। সেই বিস্ময়কর ক্ষমার মহানুভবতা।
    Total Reply(0) Reply
  • Abul Kasem ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
    পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে আমাদের ভাইদের বিজয় মানে আমাদেরই বিজয়। কারণ— আমরা এক দেহ, এক প্রাণ।
    Total Reply(0) Reply
  • Gn Rashed ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
    অর্থ আর ক্ষমতার জোর খুব বেশিদিন টিকে থাকেনা এটা আবার ও প্রমাণিত।
    Total Reply(0) Reply
  • M A Kaiyum Khondoker ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
    এমেরিকা যখন আফগানিস্তান যাচ্ছিল যুদ্ধ করার জন্য তখন রাশিয়া তাদের কে নিষেধ করছিল" যে আমরা এত বছর যুদ্ধ করার পরে আমরা পরাজয় বরণ করেছি তোমরা ও বরণ করবে"আজ তা প্রমানিত
    Total Reply(0) Reply
  • N Islam ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১:২৯ এএম says : 0
    প্রিয় সম্পাদক, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র যেভাবে আফগানিস্তানের ঘটনা বর্ণনা করছে, তাতে মনে হয় পশ্চিমা বা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমও লজ্জা পাবে । তাদের চাইতে আফগানদের বড় হিতাকাঙ্খী (!) খুঁজে পাওয়া ভার । এমনিতেই আপনার বিরুদ্ধে কিছুদিন পরপর মামলা হয় । আফগান জনগনের পক্ষে আপনার পত্রিকাই সোচ্চার, এসব লেখার জন্য আবার না মামলায় পড়েন ।
    Total Reply(0) Reply
  • রুহুল আমীন যাক্কার ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১:৪৮ এএম says : 0
    ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক লেখাটি উপহার জন‍্য সম্মানিত লেখক ও দৈনিক ইনকিলাব পরিবারকে অজস্র ধন‍্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের মুখপাত্র দৈনিক ইনকিলাবে ইসলাম ও মুসলমানদের জাতশত্রু ইয়াহূদ-নাসারা ও গো-শাবকদের অনুসরণে কোনো প্রতিবেদন বা তাদের ব‍্যবহৃত পরিভাষা না ছাপানোর জন‍্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • HazratAli ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১:৫০ এএম says : 0
    লেখক কে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর ভাবে বুঝানোর জন্য। পৃথিবীতে আবার ইসলামের হুকোমত কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ। তালেবানদের বিজয় মানেই সমগ্র মুসলিম জাতির বিজয়। এগিয়ে যান তালেবান বির সেনারা মহা শক্তিশালী আল্লাহ আপনাদের সাথে আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • HazratAli ২৫ আগস্ট, ২০২১, ১:৫৩ এএম says : 0
    লেখক কে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর ভাবে বুঝানোর জন্য। পৃথিবীতে আবার ইসলামের হুকোমত কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ। তালেবানদের বিজয় মানেই সমগ্র মুসলিম জাতির বিজয়। এগিয়ে যান তালেবান বির সেনারা মহা শক্তিশালী আল্লাহ আপনাদের সাথে আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • তোফায়েল আহমদ ২৫ আগস্ট, ২০২১, ২:৪১ এএম says : 0
    খুবই উপকৃত হলাম। যুক্তিসংগত সময় উপযোগী লিখা
    Total Reply(0) Reply
  • debangshu dey ৩০ আগস্ট, ২০২১, ৭:২১ পিএম says : 0
    কিন্তু ভাই দলে দলে আফগানিরা দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন একটু ব্যাখ্যা করবেন। বিদেশিরা চলে জেতেই পারেন-কিন্তু মাতৃভূমি ত্যাগের এই হিড়িক এর রহস্যটা কি? কোনোও দেশেই বিদেশি শাসনভার কাম্য নয়। কিন্তু আফগানিস্তানএ এক বিরল বিপরীত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন