Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আফগানিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা কেমন হবে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৭ এএম

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে এবং দখলদারিত্ব কায়েম করে দেশটিকে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছে, তার অবসান হতে চলেছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের ৯৫ ভাগ সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাকি সৈন্য ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘ দুই দশকে আফগানিস্তানে অবস্থান করে কয়েক হাজার সৈন্য খুইয়ে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র কি পেল? নাইন-ইলেভেনের হোতা হিসেবে আল কায়দাকে দায়ী করে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে কি লাভ হলো? অথচ নাইন-ইলেভেনের সাথে আফগানিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা বা কোনো আফগান নাগরিকের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনও আফগান নাগরিক নন এবং আফগানিস্তানে বসে এ সংগঠন সৃষ্টি করেননি। হতে পারে, লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার মানে কি এই যে, ভিনদেশী এক ব্যক্তি ও তার সংগঠনের কারণে গোটা একটি দেশে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মেরে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী দিতে পারবে? আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ওসামা বিন লাদেনকে যখন কথিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয়, তখন তিনি আফগানিস্তানে ছিলেন না। ছিলেন পাকিস্তানের একটি এলাকায়। তাহলে এখানে আফগানিস্তানের দোষ কি ছিল যে, হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে হবে? যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের কথা বলে, কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার মানবাধিকার টনটনে হয়ে উঠে এবং খবরদারি শুরু করে, অথচ আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করে যেভাবে নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়, তা কি মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে? শুধু আফগানিস্তান কেন, ইরাকে হামলা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে দেশকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তি কি মানবাধিকার রক্ষা করেছে? সাদ্দাম হোসেনের কথিত পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার ধ্বংসের উছিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট যেভাবে হামলা চালিয়ে সমৃদ্ধ একটি দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে তা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র জোটের লক্ষ্য যে সন্ত্রাস দমন ছিল না, বরং মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ও সম্পদ লুটের মূল উদ্দেশ্য ছিল তা এখন পরিস্কার। কারণ, সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর দেখা গেছে ইরাকে কোনো পরমাণু অস্ত্র ছিল না। নাইন-ইলেভেনও যে যুক্তরাষ্ট্রই ঘটিয়েছে, তাও এখন প্রমাণিত। যে তালেবানকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল, এখন সেই তালিকা থেকে সংগঠনটিকে বাদ দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তালেবান এখন আর সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।

দুই.
আফগানিস্তানের ইতিহাস-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খনন করে দেখা গেছে, উত্তর আফগানিস্তানে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মনুষ্যবসতি ছিল। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানের কৃষি খামার বিশ্বের প্রাচীনতম খামারগুলোর একটি। আফগানিস্তানে অনেক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি সাম্রাজ্য। ১৯ শতাব্দীতে দেশটি ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বে মধ্যবর্তী ক্রীড়নক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তান যুক্তরাজ্য থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজা ও তার আত্মীয়রা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মত রাজপরিবারের বাইরের একজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া হয় যাতে রাজপরিবার আইন প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধানে দেশটিতে আরও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে রাজা কেবল নির্বাচিত আইনসভার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এসময় যাতে জাতিগত ও বামপন্থী দল গঠিত হতে না পারে সেজন্য রাজা রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করেন। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সালে আরেকটি অভ্যুত্থানে নিষিদ্ধ বামপন্থী দল পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই দলের সাম্যবাদী শাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। তবে ইসলামী মুজাহেদিনেরা এই শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। পিডিপিএ-কে সহযোগিতা করার জন্য ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ এক দশক ধরে যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। এর পরপরই দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখলে নিয়ে সরকার গঠন করে। তালেবান সন্ত্রাসবাদী দল আল কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছে এমন অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ২০০১-এর শেষ দিকে তালেবান সরকার উৎখাত করে নিজের অনুগত সরকার গঠন করে। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানের সংবিধান নতুন করে লেখা হয় এবং একটি রাষ্ট্রপতিভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হয়।

দেখা যাচ্ছে, সুপ্রাচীনকাল থেকেই আফগানিস্তান বাইরের দেশের দ্বারা বারবার আক্রমণ ও হামলার শিকার হয়েছে। যার ফলে দেশটিতে বারবারই স্থিতিশীলতার ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্র তার সৈন্য প্রত্যাহার করায় পুনরায় তালেবান একের পর এক দেশটির গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিজেদের আয়ত্তে নিচ্ছে। তালেবান দাবি করেছে, তারা আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমান্তের ৯০ শতাংশই দখল করে নিয়েছে। সীমান্ত দখল ছাড়াও দেশটির অধিকাংশ এলাকাও ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। মোট ৩৪টি প্রদেশের অধিকাংশই তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পথে রয়েছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত কোনো প্রাদেশিক রাজধানী দখল করতে পারেনি তারা। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের দখলে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, আফগানের ইতিহাস বলে হানাদার বাহিনী ফিরে যাওয়ার পর তাদের অনুগত সরকার কখনোই টিকে থাকতে পারেনি। এ প্রেক্ষাপটে, তালেবানের হাতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের পতনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, সৈন্য প্রত্যাহার করলেও দেশটিতে মানবিক ও কূটনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিকে আশ্বস্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আশরাফ গনিকে টেলিফোনে বাইডেন আশ্বস্ত করেন, একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং ন্যায্য রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সহযোগিতা চালিয়ে যাবে। বাইডেন আফগানিস্তানের জন্য ১০ কোটি ডলারের জরুরি সাহায্য তহবিলও ঘোষণা করেছেন। এছাড়া আফগানিস্তানে পরিষেবা এবং বিভিন্ন সামগ্রী খাতে ব্যবহারের জন্য আরও ২০ কোটি ডলারের জরুরি সহায়তা অবমুক্ত করা হয়েছে। এই অর্থ আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা এবং মার্কিন অনুগত আফগানদের আমেরিকায় বিশেষ ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় নিয়ে যেতে ব্যবহার করা হবে। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করা আফগানরা এখন তালেবানদের হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ অভিবাসন ভিসায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার আফগান যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনের জন্য আবেদন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে ইচ্ছুক এমন আফগানদের প্রথম দলটি এ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার কথা। প্রথমে তাদের ভার্জিনিয়ার ফোর্টলি সামরিক ঘাঁটিতে রাখা হবে। সেখানে তাদের অভিবাসন আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। প্রথম দফায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ আফগানকে ফোর্টলি স্থাপনায় নিয়ে আসা হবে। ভার্জিনিয়া ছাড়া আফগানিস্তান ত্যাগ করতে ইচ্ছুক লোকজনের স্থায়ী অভিবাসন প্রক্রিয়া করা পর্যন্ত হাজার হাজার আফগান পরিবারকে রাখার জন্য স্থান খোঁজা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা বাইরের কোনো মিত্র দেশে তাদের স্থানান্তর করে অভিবাসন আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হবে। ১৮ হাজারের বেশি আফগান নাগরিকের আশ্রয় আবেদন অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়ে এখন নিজের সমর্থিত সরকার ও লোকজনদের পুনর্বাসনের দিকে নজর দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আফগানিস্তানকে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে ফিরেছে, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এটাই একমাত্র পরাজয় নয়, ভিয়েতনাম থেকেও তাকে পরাজিত হয়ে ফিরতে হয়েছে। অচিরেই ইরাক থেকেও তাকে ফিরতে হচ্ছে।

তিন.
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র জোট চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, প্রতাপশালী তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনার পথ খুলে যাওয়া। তবে যে তালেবানকে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় রেখে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, সেই তালেবানের নীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তারা সত্যিকার অর্থে আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও জনগণের কল্যাণে কাজ করবে, এমন আভাস মিলছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় তালেবান যেসব অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ক্ষতির মুখে পড়েছিল, সেটি থেকে তারা শিক্ষা নেবে। এবার নিজেদের কল্যাণ মাথায় রেখে তাদের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া দেবে। আভ্যন্তরীন নীতিতে তালেবানের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন করতে সমর্থ্য হবে। এর মাধ্যমে তারা বিশ্বকে এ বার্তা দিতে সক্ষম হবে যে, তারা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়, তারা মূলধারার রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে পেরেছে। এতে দেশের জনগণের কাছেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো গায়ের জোরে বসিয়ে দেয়া আফগানিস্তানের সরকারগুলোকে জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তারা জনগণের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিবেচনায়, তালেবান যদি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনে, তাহলে তারা জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তবে এখন পর্যন্ত তালেবানের যে নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে এ পরিবর্তন কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ চীনকে বন্ধুদেশ হিসেবে উল্লেখ করে তালেবান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তানে চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবে। তালেবান কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র সুহেল শাহিন চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকাকে বলেছেন, আমরা চীনা কর্তৃপক্ষকে স্বাগত জানাই (বিনিয়োগের জন্য)। যদি তারা আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করে অবশ্যই আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমরা বহুবার চীনে গিয়েছি এবং তাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। চীন আমাদের বন্ধুদেশ। আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। আফগানিস্তানের বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সাথে সাথে তালেবান কর্তৃপক্ষ তাদের কুটনীতিক কার্যক্রমও চালু করেছে। তারা তাদের কূটনীতিক প্রতনিধিদের রাশিয়া ও ইরানে পাঠিয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান ও তুরস্কের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে তারা আগ্রহী। একইসাথে ঘোষণা দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। তালেবানের এসব বক্তব্য-বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, তারা আফগানিস্তানে একটি উদার ও গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও তার গণতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করছে। তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, তালেবান একচ্ছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। অতীতে যে সরকারই একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করেছে সে সরকার সফল হয়নি। এ কারণে আমরা আগের ফর্মূলায় সরকার গঠন করতে চাই না। তিনি বলেন, নতুন সরকারের অধীনে নারীদের কাজের অনুমতি থাকবে। তারা স্কুলে যেতে পারবে এমনকি রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করতে পারবে। তবে তাদেরকে অবশ্যই হিজাব অথবা স্কার্ফ পরিধান করতে হবে। নারীদের বাড়ির বাইরে যেতে সার্বক্ষণিক পুরুষ সঙ্গী রাখতে হবে না। ইতোমধ্যে তালেবানের দখলকৃত এলাকায় নারীদের উপস্থিতির অনুমতি রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠান আগের মতো চালুর অনুমতি দিয়েছে। তালেবানের এ আচরণ থেকে বোঝা যায়, তারা আফগানিস্তানকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

চার.
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তির বিদায়ের ফলে উপমহাদেশের রাজনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে চীন আফগানিস্তানকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ যুক্ত করার কথা বলেছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানে বিরোধে লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতা করার কথা বলেছে। কারণ, আফগানিস্তানে নতুন করে গৃহযুদ্ধের সূচনা হলে তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে গিয়ে পড়বে। ফলে পাকিস্তান আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তৎপরতা শুরু করেছে। তবে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপাকে পড়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে ভারত আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ভারতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি ইতোমধ্যে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেছে। শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নেই ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আফগান প্রেসিডেন্ট মাত্র কয়েক দিন আগেই ভারত ও আফগান পার¯পরিক বাণিজ্য কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। মধ্য এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ইরানের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত চাহবাহার সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। সব মিলিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কি হবে, তা নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। এ প্রেক্ষাপটে, আফগানিস্তানে নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ভারত তালেবানের সাথে গোপন বা ব্যাক চ্যানেল প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারতীয় পররষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, আমরা আফগানিস্তানের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছি। আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামো নির্মাণ এবং দেশটির পুননির্মাণের যে অঙ্গীকার ভারতের রয়েছে, তা আমরা অব্যাহত রাখতে চাই। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতের এই খায়েশ পূরণ হবে কিনা তা নির্ভর করছে তালেবান বা তালেবান নিয়ন্ত্রিত সম্ভাব্য আগামী সরকারের উপর। কারণ, তালেবান ইতোমধ্যে চীন এবং তার বলয়ভুক্ত বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে যেভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে ভারতের অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে। অন্যদিকে, উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের চীন ঠেকাও নীতি ও অবস্থান অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। চীন আগেভাগেই পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ নিয়ে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করে ফেলেছে।
[email protected]



 

Show all comments
  • MD.SABBIR HOSSAIN ৮ আগস্ট, ২০২১, ৯:০৭ পিএম says : 0
    অতীতে যে সরকারই একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করেছে সে সরকার সফল হয়নি। এ কারণে আমরা আগের ফর্মূলায় সরকার গঠন করতে চাই না। তিনি বলেন, নতুন সরকারের অধীনে নারীদের কাজের অনুমতি থাকবে। তারা স্কুলে যেতে পারবে এমনকি রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করতে পারবে। তবে তাদেরকে অবশ্যই হিজাব অথবা স্কার্ফ পরিধান করতে হবে। নারীদের বাড়ির বাইরে যেতে সার্বক্ষণিক পুরুষ সঙ্গী রাখতে হবে না। ইতোমধ্যে তালেবানের দখলকৃত এলাকায় নারীদের উপস্থিতির অনুমতি রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠান আগের মতো চালুর অনুমতি দিয়েছে। তালেবানের এ আচরণ থেকে বোঝা যায়, তারা আফগানিস্তানকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন