Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাতক্ষীরায় অনিয়ম ও লুঠপাটে তৈরি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সাতটি ঘর ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন

সাতক্ষীরা থেকে আক্তারুজ্জামান বাচ্চু | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০২১, ৫:২৭ পিএম

সাতক্ষীরায় অনিয়ম ও লুঠপাটে তৈরি করা মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘরের সাতটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘরগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কলারোয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা জোবায়ের আহমেদ চৌধুরি। আশ্রয়ন প্রকল্প ২ এর আওতায় সাতক্ষীরায় প্রথম ধাপে ভুমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ১১৪৮ টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে খুব খারাপ অবস্থায় থাকা কলারোয়ার তৈলকুপি গ্রামে পুকুর পাড়ে নির্মিত ১৩ টির মধ্যে সাতটি ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে উধাও করা হয়েছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে উপহারের ঘর নির্মানে অনিয়ম দূর্নীতির তদন্তের ঘোষনা আসার পরপরই মাঠে নেমেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। নবাগত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীরসহ সংশ্লিষ্ট উপজেলা সদরের নির্বাহি কর্মকর্তারা উপহারের নির্মিত ঘরগুলো নিয়মিত পরির্দশন করছেন। একই সাথে ২য় ধাপের ৬৫৫ টি চলমান ঘর তৈরির মান যেনো ঠিক থাকে সেদিকেও নজর রাখছেন এসব কর্তারা। বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ ঘর মেরামতসহ রাস্তাঘাট তৈরির কাজও চলছে।
জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে “ আশ্রয়নের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার ” শ্লোগান নিয়ে দেশের ভুমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান কার্যক্রমে সাতক্ষীরায় আশ্রয়ন প্রকল্প ২ এর আওতায় প্রধম ধাপে ১১৪৮টি ঘর বরাদ্দ হয়। প্রতিটি ঘর নির্মাণ খরচ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। মোট ঘর নির্মাণ খরচ ১৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮ হাজার টাকা। ভুমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে গৃহ নির্মাণ কাজ সুষ্ঠভাবে মনিটরিং করার জন্য জেলায় আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার আহবায়ক ছিলেন, সাতক্ষীরার সাবেক জেলা প্রশাসক এস,এম মোস্তফা কামাল।
সিডিউল অনুযায়ি দুই কক্ষের প্রতিটি সেমি পাকা ‘ঘরের আয়তন ৩৯৪ বর্গফুট। একটি রান্না ঘর,একটি টয়লেট ও ইউটিলিটি স্পেস। ঘর নির্মাণে প্রথম শ্রেণির উন্নত মানের ইট ও ঢালাইতে পিকেট ইটের খোয়া ব্যবহার করতে হবে। ঘরের ভিত হবে ১০ ইঞ্চি ও দেয়াল হবে পাঁচ ইঞ্চি। ঘরের মেঝে ঢালাইতে একটা সিমেন্ট, তিনটা বালি ও ছয়টি খোয়া মিশ্রিত। দেয়াল গাথুনিতে একটা সিমেন্ট, ৬টি বালি দিতে হবে। পাঁচ ইঞ্চি চওড়া ও ৬ ইঞ্চি লিংটন তৈরিতে ৪ টি ১০ মিলি ও ৪টি ৮ মিলি রড ব্যবহারের খাঁচা করতে হবে। এটি ঢালাই করার সময় উন্নত মানের সাদা বালি ও লাল বালি মিশিয়ে ১.৮ এফ এম করতে হবে। এখানে উন্নত মানের ইটের খোয়া ৪ টি, ২ টি বালি ও ১ টি সিমেন্ট মিশিয়ে ঢালাই করতে হবে। প্রতিটি ঘরের ৫ টি জানালায় খাঁচা তেরি ঢালাই করতে হবে। জানালার গ্রীল সাইডে ফ্লাড হবে এক ইঞ্চি পুরু। জানালার গ্রীল হবে ১০ মিলি পুরু। ২২ গেজির টিন দিতে হবে। দরজার ফ্রেম হবে দেড় ইঞ্চি। ১৮ গেজির সিড দিয়ে দরজা করতে হবে। টয়লেটের দরজা হবে বাথরুমে। ৬ টি রি্ ংএর টয়লেটে উন্নত মানের স্লাপ থাকবে।
গুনগত মানের মেহগুনি,শিশু, লোকাল শাল, কড়াই অথবা স্থাণীয় ওই মানের কাঠ দিয়ে ঘরের চাল তৈরি করতে হবে। .৩৬ মিলি মিটার পুরু ঢেউটিন চালে দিতে হবে। মটকা হবে .৪৬ মিলি মিটার পুরু। ঘর তৈরি শেষে রং করাসহ প্রতিটি ঘর নির্মানে রয়েছে নানাবিধ নির্দেশনা। কিন্তু এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হয়নি।
সদর উপজেলার গাভা, আলিপুর, হাড়দ্দহা, বৈকারি, তলুইগাছা, কলারোয়া উপজেলার দরবাসা, ফাজিলকাটি, পুটুনি, সোনাবাড়িয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার একাধিক স্থানের গৃহ নির্মাণে নি¤œমানের ইট, খোয়া, বালি ব্যবহার করা হয়েছে। লিংটন ও জানালায় খাঁচা ছাড়াই ঢালাই হয়েছে শুধুমাত্র সাদা বালি ও সিমেন্ট দিয়ে। এখানে লাল বালির মিশ্রনে এফ এম দৃশ্যমান শুন্য। এছাড়া, মেঝে ঢালাইয়ে নিয়ম অনুযায়ি সিমেন্ট বালির কোনো পরিমাপ ছিলো না। সিমেন্টের সাথে ইচ্ছে মতো মেশানো হয়েছে বালি, ব্যবহার করা হয়েছে অতি নি¤œমানের ইটের খোয়া। ঘরের মেঝে পানি দিয়ে আটকে রাখার কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়েনি। দরজা, জানালা, চাল, টিনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়েছে। নি¤œমানের সামগ্রী দিয়ে কম খরচে দ্রুত ঘর নিমার্ণের প্রতিযোগিতা চলেছে। লুঠপাট করা হয়েছে সরকারি বরাদ্দের একটি মোটা অংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘর নির্মাণে নিয়োজিত একাধিক শ্রমিক ও এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এই প্রতিনিধিকে জানান, তাদের চোখে এটি পুকুর চুরি। এমন অনিয়ম দূর্ণীতি তাদের বয়সে আর কখনো দেখেন নি। জেলা প্রশাসক এস,এম মোস্তফা কামাল তাঁর অধিনস্ত কয়েকজন কর্মকর্তাকে দিয়ে গৃহ নির্মাণে এমন লুঠপাট করেছেন। জেলা প্রশাসক এস,এম মোস্তফা কামালের কথা বলে কলারোয়াসহ জেলার বিভিন্ন ইটভাটার মালিকদের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার ইট ফ্রিতে নেওয়া হয়েছে ঘর নির্মাণের জন্য। অনেক ভাটা মালিক ইট দিতে না পারায় তাদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এমন দূর্নীতি অনিয়মের বিষয় নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়। সেসময় মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভুমিহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়ম লুঠপাটের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস, এম মোস্তফা কামাল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, এই প্রথম গৃহ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ শুনলাম। এটি সঠিক নয়। গাভা বা অন্য কোথাও কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়িই ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে, কলারোয়া উপজেলাতে ঘর নির্মাণে কিছু অনিয়মের কথা শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য এডিসি জেনারেলকে দায়িত্ব দিয়েছি। আর ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে যদি কেউ ইট বা টাকা নিয়ে থাকে তাহলে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর কয়েকদিন পর কলারোয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মৌসুমি জেরিনকে অন্যত্র বদলী করা হয়। কলারোয়ায় আসেন নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোবায়ের আহমেদ চৌধুরি। এরপর গত ২৩ জুন জেলা প্রশাসক এস,এম মোস্তফা কামাল সাতক্ষীরা থেকে বদলী হয়ে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে উপ-সচিব পদে বদলী হন।
কলারোয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জোবায়ের আহমেদ চৌধুরি জানান, আগের নির্বাহী কর্মকর্তার আমলে কলারোয়ায় আশ্রয়ন প্রকল্পের বেশ কিছু ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৩ টি ঘর পুকুর পাড়ে নির্মাণ হয়েছে। যা বসবাসের অনুপযোগি ও ঝুঁকিপূর্ণ। স্থাণীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের সাথে আলাপ করে ৭ টি ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে।
কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, আগের ইউএনও মৌসুমি জেরিন ঘরগুলো নির্মাণ করেছিলেন। সেসময় বাঁধা দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু তিনি শোনেন নি। নির্মাণ কাজে ত্রুটির কারণে অল্প দিনের মধ্যে ঘরগুলোতে ফাটল ও ধ্বসে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। তিনি বলেন, পুকুর ভরাটের জন্য পরিষদ থেকে আরো ছয় লাখ খরচ করা হয়েছিলো। কিন্তু সেটি কোনো কাজে আসেনি।
অপরদিকে, সরকারিভাবে উপকারভোগিদের ঘরের চাবি ও জমির দলিল বুঝিয়ে দেওয়া হলেও অধিকাংশ ঘরে উপকারভোগিরা থাকছেন না তাদের উপহারের ঘরে। অত্যন্ত নি¤œমানের ঘর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রাস্তাঘাট ও চাহিদা অনুযায়ি টিউবওয়েল না থাকায় তারা সেখানে বসবাস করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। অনেকের ঘরের মেঝের ছাল চামড়া উঠছে এবং ফাটল দেখা দিয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরা সদরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হক বলেন, আগের জেলা প্রশাসক যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবেই কাজ করা হয়েছে। আর টিউবওয়েল বরাদ্দের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। এটি সরবরাহের দায়িত্ব তাদের। ইতোমধ্যে অল্প কয়েকটি টিউবওয়েল তারা দিয়েছেন। এছাড়া, সদরের নবাগত ইউএনও স্যার গাভা ফিংড়ি এলাকায় উপকারভোগিদের সুবিধার্থে রাস্তা নির্মাণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, দুই একটি জায়গায় নির্মিত ঘরের ছোটখাটো ত্রুটি দেখা গিয়েছে। সেগুলো সংস্কার করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরার নবাগত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, জেলায় আগের তৈরিকৃত ঘরের মধ্যে কিছু ঘরবাড়ি জলাবদ্ধতায় রয়েছে। এর সমাধানের জন্য কাজ চলছে। কোনো ঘরে ত্রুটি থাকলে সেগুলোও সংস্কারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, চলমান ঘর তৈরির কাজের বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আশ্রয়ণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ