পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বৃটিশ ভারতের পেশোয়ারে ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ ইউসুফ খানের বোম্বাই চলচ্চিত্র জগতে এসে ‘দিলীপ কুমার’ হয়ে ওঠার পেছনে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনোজাগতিক কেমিস্ট্রি কাজ করছিল তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। কিন্তু অবিভক্ত ভারতের বলিউডে সেই দিলীপ কুমারের মহানায়ক হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে তার অনবদ্য অভিনয় শক্তি ও অসামান্য প্রতিভা। তাঁর অসাধারণ অভিনয়ে সমৃদ্ধ চল্লিশের দশকে জোয়ারভাটা, আন্দাজ, বাবুল ইত্যাদি। দর্শকনন্দিত এসব ছবির মধ্য দিয়ে বোম্বের চলচ্চিত্র জগত নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়। এরপর ৫০ বছর ধরে তাঁর অগ্রযাত্রা কখনো স্থবির হয়নি। দীর্ঘ ৯৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন শেষে উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাশিল্পী দিলীপ কুমার গত বুধবার দিল্লির একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটল। এই মহানায়কের মৃত্যুতে উপমহাদেশজুড়ে এক ধরনের আলোড়ন লক্ষ করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সীমারেখা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিভাজনরেখা মুছে দিয়ে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ এই ট্র্যাজিক কিংয়ের মৃত্যুতে শোকসন্তপ্ত ও সশ্রদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বগণমাধ্যমও ভারতীয় চলচ্চিত্রে দিলীপ কুমারের অসামান্য অবদানের কথা অকৃত্রিমভাবে উঠে এসেছে। উপমহাদেশ ও বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
ভারত বিভক্ত হলেও দিলীপ কুমারের বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো উপমহাদেশের সব মানুষের মধ্যে সমান আবেগ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিভেদ-বৈরিতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনে দিলীপ কুমার যেন শান্তি ও সম্প্রীতি বন্ধনের রূপকার হয়ে ওঠেন। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ অবসানে দিলীপ কুমারের ভূমিকার কথা জানা যায়। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধান ব্যক্তিত্বরা শোক প্রকাশ করছেন। সেই সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বলিউডে সব তারকার শোকের প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। শাহরুখ খানের সাথে দিলীপ কুমার ও স্ত্রী সায়রা বানুর সাথে সম্পর্ক ছিল অনেকটা পিতা-পুত্রের মতো। দিলীপ কুমারের মৃত্যুর খবর শুনে ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন নিজের জীবনে দিলীপ কুমারের প্রভাব সম্পর্কে সবিস্তারে লিখেছেন। দিলীপ কুমারের অটোগ্রাফের জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষার বয়ান দিয়েছেন অমিতাভ। দিলীপ কুমারের অন্ধভক্ত ও পিতৃতুল্য জ্ঞান করে তাঁকে তিনি নায়কদের নায়ক বলে অভিহিত করেছেন। আটবার ফিল্মফেয়ারের সেরা অভিনেতার পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং পাকিস্তানে নিশান-ই-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন দিলীপ কুমার। বাংলাদেশেও অসাধারণ জনপ্রিয়তা ছিল দিলীপ কুমারের। ১৯৯৫ সালে তিনি যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন, সাংস্কৃতিক কর্মীদের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে প্রমাণিত হয়েছিল এদেশে তিনি কতটা জনপ্রিয় হয়ে আছেন।
দিলীপ কুমারের মৃত্যু খুব সাধারণ ঘটনা নয়। সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিভাজনকে পিছনে ফেলে গত ৭ দশক ধরে তিনি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর পর আরেকবার তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ল। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিজ্ঞা ও প্রভাবে ভারতের কিছু হিন্দুত্ববাদী হিংসুকের ভালো লাগেনি। তারা দিলীপ কুমারকে অপবাদ দিতে পিছপা হচ্ছে না। অথচ আমরা স্মরণ করতে পারি, দিলীপ কুমার যখন রাজ্যসভায় মহারাষ্ট্র থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ির সাথে দিলীপ কুমারের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। প্রায় ৮০ বছর ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে নক্ষত্রের মতো প্রোজ্জ্বল থেকেও তিনি কখনোই সাম্প্রদায়িকতায় অভিযুক্ত হননি। তবে তার মুসলমান আত্মপরিচয়ের কারণে বিভিন্ন সময় একশ্রেণীর ধর্মান্ধ, বর্ণবাদী হিন্দু তাঁেকও আক্রমণ করতে ছাড়েনি। তারা এতটা বিদ্বেষ ও নীচুতার পরিচয় দিলেও ভারতের অধিকাংশ মানুষ তাকে এক বিরল মহৎপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবেই জানে। গতকাল দিলীপ কুমারের শেষ বিদায়ে ধর্মেন্দ্রের মতো অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। ভারতীয় পত্রপত্রিকার পাতাগুলো এমন অসংখ্য আবেদনময় প্রতিবেদনে ভরে উঠেছে। এটাই বাস্তব। সাম্প্রদায়িকতা, হীনমন্মতা কখনো মহত্বের ও সম্প্রীতিকে গ্রাস করতে পারে না। গতকাল নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দিলীপ কুমারকে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রথম রিয়েলিস্টিক ধারায় উন্নীত করার কৃতিত্ব দিয়েছে। সাংস্কৃতিক জগতে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদী বৈষম্য ও হিংসার কোনো স্থান নেই; দিলীপ কুমার তার সারা জীবন ধরে তার প্রমাণ দিয়েছেন। একজন ধার্মিক, নিয়মনিষ্ঠ মুসলমান হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। দিলীপ কুমারের মতো এমন ভার্সেটাইল ব্যক্তিত্ব উপমহাদেশে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু অসামান্য অভিনয় শিল্পী হিসেবেই নয়, একজন প্রজ্ঞাবান ও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবেও তার অবদান সবার কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সময়ে তার চিরবিদায় এ উপমহাদেশের শান্তিকামী মানুষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ট্র্র্যাজিক কিংয়ের মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার অনন্ত শান্তি কামনা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।