Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

অনেক দিন আগে এক কবি লিখেছিলেন, অনেক কথাই শুনি? গান গেয়ে কে বৃষ্টি নামায়, ছড়ায় মুক্তোমণি/ ভোজবাজিতে। একটা জিনিষ পারবে জাদুকর?/খাবারগুলো ভাগ কর তো সমান ভাগে?/দেখি জান কী মন্তর!’ একটু পাল্টে নিই লাইনগুলোকে ‘খাবারগুলো দাও তো কম দামে, দেখি তুমি কেমন সরকার। ’ দেশের বিত্তহীন পরিবারেরর সদস্যদের মনের কথা কিন্তু এটাই। এরা বঞ্চিত, তারা অবহেলিত তাই তারা চাইছেন, সরকার আন্তরিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করুক ক্ষুধা-দারিদ্র-বঞ্চনা-বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে। মুখে লম্বা লম্বা কথা না বলে দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মৌলিক স্বার্থ সুনিশ্চিত করুক। গত কয়েক বছর ধরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু গত দু’বছরে অন্যান্য বছরের তুলনায় চাল-ডাল-চিনি-সবজি সব কিছুর মূল্য পনেরো থেকে পচাত্তর শতাংশ বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দাভাব। মজুতদারী ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সরকার বলছে, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে। তবে সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞজনেরা এসব কথা মানতে নারাজ। তাদের ধারণা সরকারের কিছু মন্ত্রী ও এমপিদের যোগসাজসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে জড়িত। এজন্য অনেকটাই দায়ী সরকারি নীতি। শহরের বড় বড় পাইকারী বিপণন কেন্দ্রগুলো অর্থাৎ বিগ-মেট্রো বাজারগুলোর প্রতি বাদান্যতা দেখানোর জন্য দাম বেড়েছে পণ্যের। সরকার যদি একদিকে সম্ভাব্য মজুতদারি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিত ও অন্যদিকে গণবন্টন ব্যবস্থাকে জোরদার করে নির্দিষ্ট দামে পণ্য সরবরাহ করত, তাহলে এতটা দুর্গতিতে পড়তে হত না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এদিকে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষ বিচলিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। রোজগার বাড়েনি তাদের। যা ছিল তাই আছে। সেখানে বাড়তি কিছু যোগ হয়নি। আগে বরং ঘরোয়া ফসল, হাঁস-মুরগি পালন ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক-গৃহস্থ যোগান ছিল প্রায় প্রত্যেকের ঘরে ঘরে। নানা কারণে এসবও এখন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বিত্তহীন লোকেরা পড়ছেন আতান্তরে। তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহে এর চাপ বাড়ছে।

খরা হতে পারে, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন ইত্যাদি হতে পারে অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেকোনও সময় ঘটতে পারে। এজন্য দেশের সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সুদিনে সঞ্চয় করে রাখলে পরে পস্তাতে হয় না-এর রকম নীতিবাক্য প্রাইমারী স্তরের শিক্ষা। সরকার এসব ব্যাপার নজর রাখে না কেন? আপৎকালীন ঘাটতি মেটাতে এমন কোনও পদক্ষেপ কি নেওয়া উচিত নয়, যাতে সাধারণ মানুষকে দুর্গতিতে পড়তে না হয়। খরা হয়েছে, ব্যয় হয়েছে অতএব জিনিষের দাম বাড়বে, বললেই সব হয়ে গেল? কৃষকদের যাতে ভাল ফলন হয়, তারা তাদের ফসল যাতে ভালমতো বাজারজাত করতে পারেন, দুটো পয়সা লাভ করেন, বাড়তি ফসল সঠিক উপায়ে গুদামজাত করার ব্যবস্থা নেন, এসব ব্যাপারে কতটা কার্যকর ভূমিকা সরকারের থাকার কথা ছিল এবং সরকার বাস্তবক্ষেত্রে কতটা নেয় তা ভেবে দেখার দরকার রয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।

রান্নার গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেলের দাম পর্যায়ক্রমে অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী ও পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে অনেক। বেড়েছে চাল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, মসলাপাতি, সয়াবিনসহ অন্যান্য ভোজ্য তেলের দাম। বর্তমানে মসুর ডাল ১২০ টাকা, চাল মাঝারি ধরনের ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, আটা ৩৫ টাকা, ময়দা ৫০ টাকা, চিনি ৭৫ টাকা, সোয়াবিন তেল ৫ লিটার ৫৯৫ টাকা, ২ লিটার ২৪৫ টাকা, ১ লিটার ১২৫ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা, রসুন ১২০ টাকা, আদা ৮০ টাকা, হলুদ ১০০০ গ্রাম ৫৫ টাকা, জিরা ৪৮ টাকা, মরিচ ১০০ গ্রাম ২৫ টাকা, ছোলা ৬৮ টাকা, কাঁচা মরিচ ১৫০ টাকা কেজি।

সবজি বাজারের অবস্থা আরো খারাপ। প্রতি সবজির দাম বেড়েছিল রমজান শুরুর আগেই প্রায় দ্বিগুণ। মুরগীর মাংসের কেজি ১৩৫ টাকা, খাসির মাংসের কেজি ৭০০ টাকা, গরুর মাংসের কেজি ৬০০-৬৫০ টাকা। এছাড়া একটি মধ্যম সাইজের ইলিশের দাম ৫ থেকে ৬শ’ টাকা। বড় রুই কাতলার দাম তো গগণ চুম্বী। ট্যাংরা, পুঁটি, পাবদা, শিং, কৈ, মাগুর মাছের দাম শুনলে বাজার থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। দুধের লিটার ৮০-৮৫ টাকা। এ হলো বাজারের সর্বশেষ অবস্থা।

সাধারণ মানুষ খাবে কী? অসুস্থ হলে চিকিৎসাই করাবে কীভাবে? দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের দুঃখ-কষ্টের সত্যিই কোনও শেষ নেই। ঘরে ঘরে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র, এ এক অশেষ যন্ত্রণা।

যারা অতি দীনদরিদ্র কায়ক্লেশে দিন কাটাতেন, মূল্যবৃদ্ধির চাপে তাদের এখন অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। এদের পাশে দাঁড়ানোর আজ আর কেউ নেই। এদের জন্য আন্দোলন করার কেউ নেই। গ্রামের গরিব মানুষ প্রকৃত অর্থেই আজ অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত। জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না সরকারের শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও। তারাও নীরব।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামের সাঁড়াশি চাপে বিত্তহীন পরিবারগুলোতে বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। উপযুক্ত বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের। বাড়ছে শিশু-প্রসূতি মৃত্যু। শিক্ষা, পুষ্টি ইত্যাদি সব কিছু থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন এক বিরাট অংশের মানুষ যারা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক। এবারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কিন্তু বিগত দিনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য করোনাও যে তার একটি বিশেষ কারণ তা স্বীকার করতেই হয়। চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেশবাসী আজ আর এটাকে নিছক সন্দেহ নয়, একবোরে চরম সত্য হিসাবেই ধরে নিয়েছেন। ভাব দেখে মনে হয়, সরকারের এই পিঠে কূলা আর কানে তুলা দেয়া অবস্থা। অন্যদিকে মজুতদার মুনাফাখোরের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লাগামহীনভাবে মুনাফা চলছে। যদি তাই না হত তবে বর্তমান অসহনীয় দ্রব্যমূল্য রোধ করার জন্য কঠোরতম আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শুধু মুখে বড় বড় কথা বলে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার প্রয়াস চালানো হতো না। এ যেন খেলার শর্ত অন্ধকারে চোখে কাপড় বেঁধে সরকার কানামছি খেলা শুরু করেছে তাদের কোটিপতি চোরাকারবারি সাগরেদদের সঙ্গে নিয়ে। অন্তত: সাধারণ মানুষ তাই মনে করে। অত্যাবশ্যক সামগ্রীর এ লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের নির্বিকার মনোভাব দেখে এ দেশের সাধারণ মানুষ সত্যিই হতাশ।
লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দ্রব্য


আরও
আরও পড়ুন