পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গেল বছর থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মারাত্মক বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সাধারণত এত ঘনঘন মূল্যবৃদ্ধির কথা শোনা যায় না। আমাদের সরকার এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখায়। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তো অন্যান্য দেশকেও নানাবিধ দ্রব্যাদি আমদানি করতে হয়। সেসব দেশেও কি গত ক’বছরে এই হারে দাম বেড়েছে দ্রব্যাদির? পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান কিন্তু এ কথা বলে না। অর্থমন্ত্রী, জ্বালানি মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীরা জোরগলায় বলে থাকেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম। তবে তারা কিন্তু সেসব দেশের মাথাপিছু গড় আয়ের সঙ্গে আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকের গড় আয়ের কথা বলেন না। মন্ত্রী ছাড়াও ছোট-বড় নেতারা গলা উঁচিয়ে একই দাবি করেন। এতে কিছু কিছু লোক পুলকিত হলেও অধিকাংশ মানুষ আতঙ্কিত হন। বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার ব্যবস্থা, সংস্কারের নামে পুঁজিপতি আর বহুজাতিক সংস্থার মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হলেও গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। মুষ্টিমেয় মানুষকে ধনকুবের করতে গিয়ে অধিকাংশকে নিষ্ঠুর দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ মূল্যবৃদ্ধি গরিবদের ওপর নির্মম কষাঘাত।
এদিকে মাঝে মাঝে কোনো অজুহাত ছাড়াই জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দামও বৃদ্ধি করা হয়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির উপর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এতে প্রথমেই পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। পণ্যভাড়া এবং যাত্রীভাড়া বৃদ্ধির ফলে আম নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পণ্যভাড়া বৃদ্ধির স্বাভাবিক পরিণতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সরকারি-বেসরকারি যানচালকরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম দশ শতাংশ বাড়লে পরিবহন মালিকেরা বাড়ায় ত্রিশ শতাংশ। অসহায় যাত্রীদের তাই এ বৃদ্ধি বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয়। সরকারে যারা আছেন, তারা তো মালিকশ্রেণির পরিপোষক। নিপীড়িত প্রতিবাদী মানুষ ফরিয়াদ জানালে লাঠি-গুলি খেতে হয়, তাদের নিরুপায় উক্তি, ‘মুক্তবাজার ব্যবস্থায় কারও উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তাহলে এ সরকারটা আছে কেন? নালায়েক চালকরা বেপরোয়া যানবাহন চালিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করবে, এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কি কিছু নেই? দেশের অভ্যন্তরে নানা ধরনের তোলাবাজ দুর্বৃত্তরা এক্সটরশন করবে, অপহরণ বাণিজ্য চলবে, সরকারের করণীয় কিছু নেই? ব্যবসায়ীরা স্বার্থে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতেই থাকবে, সরকারের কি কিছু করণীয় নেই? উচ্চপদে আসীন রাজনৈতিক মাফিয়া এবং আমলারা দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়ে যাবে, সরকারের কি কিছু করণীয় নেই? যদি নাই থাকে তবে ঠুঁটো জগন্নাথ পোষার দরকার কী? রাজনীতির কুশীলব এবং উচ্চপদাধিকারী আমলারা ভালই জানেন, তাদের রাজকীয় জীবন-যাপনের ব্যয় সংকুলানে দেশের বেশিরভাগ হতদরিদ্র, দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থানকারী, এমনকি পথের ভিক্ষুকেরও ‘ডাইরেক্ট কনট্রিবিউশন’ রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নীতি নির্ধারণের সময় এই সমস্ত লোকের কথা একবারও তারা ভাবেন না।
বাংলাদেশ একটি কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র, জনগণই তার মূল লক্ষ্য। সংবিধানের নীতি নির্ধারণ প্রস্তাবনায় তাই বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারকে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ক্রীড়ানক হলে চলবে না। এভাবে চললে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখনও এ দেশের কোটি কোটি মানুষ আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোর চেয়েও হীনতর অবস্থায় রয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক’ ‘সমাজতান্ত্রিক’ সংবিধানের নিয়ন্ত্রণে শাসক শ্রেণীর এ ধরনের আচরণে জনগণ অতিষ্ট। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম যেভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উৎকণ্ঠা ও প্রতিবাদের সুর প্রকাশ্যে আসছে। কিন্তু ব্যাপারটি যেভাবে গুরুতর হয়ে উঠছে, সে তুলনায় এর সমাধানের জন্য কোনো সরকারি তৎপরতা পরিলক্ষীত হচ্ছে না।
এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, সরকার মুখে জনকল্যাণের কথা খুব ফলাও করে প্রচার করছে। বড় নীতির বুলি আওড়ানো হচ্ছে। নানাভাবে বাহবা কুড়োনোর জন্য চমক সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু চাল, ডাল, আলু, তেল, পেঁয়াজসহ আনুসঙ্গিক অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের পিঠ যে দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে, সে কথা উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা নেতাদের কি নেই? অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যের দাম গত ১ বছরে চার-পাঁচ গুণ বেড়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে শাসকদলের নেতারা যেন নিস্পৃহ। বিরোধীদল দায়সারাভাবে দু’একটি কথা বলে যেভাবে মুখে কুলুপ এটেঁ বসে থাকেন, তাতে স্বাভাবিক কারণেই জনমানুষের দুর্গতি বাড়ছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সাধারণ ক্রেতাদের আর্তনাদ যেন কোনো কাজেই আসছে না। এদিকে দেশে বিরোধী দল বলতে যে কিছু আছে তাও মেনে নেয়া যায় না। কারণ, বিরোধীদলের প্রতিবাদ করা মিছিল করা দূরের কথা, কথা বললেই শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। তাদের প্রতিবারের ক্ষমতা প্রায় নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের যদি আমজনতার সঙ্গে সংযোগ থাকত, অসহায় মানুষের কথা তারা যদি অনুধাবন করতে পারতেন, তাহলে এটা তাদের না জানার কথা ছিল না যে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে না পেরে দেশের কোটি কোটি মানুষের পক্ষে জীবনধারণ দুরুহ হয়ে উঠেছে। সরকার গরিবদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করে আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা করতে পারে; কিন্তু বাস্তবে এর সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লুটেরাদের পকেটকেই ভারি করছে। বিপন্ন মানুষের ক্রন্দনরোল শোনার মতো কেউ যেন নেই এ মুহূর্তে।
দেশে প্রত্যেকটি নির্বাচনের পরই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম কিছুটা হলেও বেড়ে যায়। কিন্তু গত নির্বাচনের পর এ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভোটের আগে তো কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বড় বড় মজুতদার, শিল্পপতি তথা বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর কাছে থেকে মোটা অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করার কথা বহুচর্চিত। বাস্তবের কষ্টিপাথরে বিষয়টিকে মোটেই হাল্কা করে দেখা যায় না। কার্যক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ অর্থ রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলে ঢালেন, সুদে-মূলে এর কয়েকগুণই উসুল করার সংকল্প তারা গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ীরা জনগণের পিঠে বড় রকমের বোঝা চাপিয়ে দিলেও তাবড় তাবড় নেতারা তা হজম করতে বাধ্য। অনেকে বিষয়টিকে উপভোগও করেন। নিজেদের জনদরদী হিসাবে তুলে ধরতে লম্বা-চওড়া কথা বলে বাজারমাত করতেও মাঠে নামেন অনেকে।
সরকারি কর্মচারীরা যে মাইনে পান সেটা নিয়ে এ মুহূর্তে অসন্তোষের কথা প্রায় শোনাই যায় না। তারপরেও অনেক কর্মচারীর পক্ষেই অত্যধিক ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সাযুজ্য বজায় রাখা যে কঠিন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও মাসান্তে তাঁদের একটা প্রাপ্তি থাকছে। কিন্তু দেশের অজস্র মানুষ যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠনে চাকরি করেন, দিনমজুরি থেকে শুরু করে যারা নানা কাজ বা ছোট ব্যবসা করে দিন এনে দিন খান, অত্যন্ত নিম্নআয়ের সে মানুষের জীবন আজ অতলান্ত অন্ধকারে নিমজ্জিত। দুঃখ-দুর্দশায় তারা আজ বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। চরম অপুষ্টিতে ভুগে নানা রোগের শিকার তারা। ভোট আসে, ভোট যায় গড্ডালিকা প্রবাহে মানুষও ভাসে। কিন্তু তাদের জীবনে কোনো আশার আলো নেই, উপরন্তু দুর্ভিক্ষের বেষ্টনিতে তারা ক্রমশ ক্ষত-বিক্ষত। অনাহারে, অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিনিয়ত যে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এ হিসাব রাখার মতো কেউ যেন নেই! এটা তো স্বাভাবিক মৃত্যু! বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, অথবা মহামারিতে মানুষ মারা গেলে বড় খবর বেরোয়, ছবি ছাপা হয় কিন্তু না খেয়ে মৃত্যু হয়েছে, এ সংবাদে কারো কাছেই যেন তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কারণ, দেশ নাকি এগোচ্ছে প্রগতির পথে?
বাংলাদেশ একদিকে বিলাস-বৈভবের স্বর্ণশিখরে, অন্যদিকে তার হতদরিদ্র চেহারা ক্রমশ আরো বেশি পরিস্ফুট হচ্ছে। অন্ধকারের এ দিকটা আড়াল করে কতদিন এ দেশের দণ্ডমুন্ডের কর্তারা নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে রাখতে পারবেন, সেটা বলা কঠিন। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা বিভিন্ন সরকারি পদে আসীন রাজনীতিকদের উপার্জন তো অনেক বেশি। অসুখ-বিসুখ থেকে শুরু করে তাদের সবরকম খরচের দায়িত্ব রাষ্টের উপর অর্পিত। সাধারণ মানুষের দুঃখের কাহিনী তাই তাদের মনকে আর নাড়া দেয় না। ভুলে যান জনগণ প্রদত্ত করের অর্থেই তারা পুষ্ট। নিষ্ঠাবান বহু সরকারি আধিকারিক এক সময় গরিব মানুষের দিকে দৃষ্টি দিয়ে স্ব-স্ব কর্তব্য সম্পাদন করে তৃপ্তি পেতেন। বর্তমানে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ক্ষমতাবান আধিকারিরাতো নেতাদের হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই নন। ভাগ-ভাটোয়ারার অঙ্কে অনেকেই এখন যারপর নাই করিৎকর্মা।
অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির দাম যেভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা অচিরে রোধ করা না গেলে হয়তো আর একটা মন্বন্তরই অপেক্ষা করে আছে এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য। দেরি না করে নিজেদের অধিকার আদায়ে পথে নামা ছাড়া গত্যন্তর কোথায়? বিলাস-বৈভবে মত্ত ক্ষমতার ধ্বজাধারীরা কবে দেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন; এটা যখন অনিশ্চিত, তখন বিকল্প কোনো পথ বেছে নেওয়া ছাড়া করার আর কি-ইবা আছে সাধারণ মানুষের?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।