পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনার মধ্যেও আলোচনার বিষয় ছিলো ঢাকা ওয়াসা গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বাড়াবে। পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসাবে ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেছিলেন, ওয়াসাকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান থেকে উনারা উদ্ধার করতে চান। সেকারণে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির চিন্তা করা হচ্ছে। যদিও পরবর্তীতে বোর্ড সভায় প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা হয়। করোনা মহামারির এ কঠিন সংকটে ওয়াসা বোর্ড সদস্যরা সাধারণ ভোক্তাদের সমস্যার কথা বিবেচনা করায় তাদেরকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধিই কি একমাত্র সমাধান, নাকি আরও অনেক উপায় তাদের হাতে আছে?
পানি প্রতিটি নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে রাষ্ট্র তার নাগরিগকদের অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাগুলি নিশ্চিত করবে। সে আলোকে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় জনগণের অত্যাবশ্যকীয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসাকে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানিও সরবরাহ করতে পারে না ওয়াসা। এছাড়া পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। তবুও নিয়মিতই মুনাফা করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপরও গত অর্থবছর পানির মূল্য বাড়ায় ঢাকা ওয়াসা। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেকর্ড লোকসান করেছে এ সংস্থাটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া ঢাকা ওয়াসার আর্থিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওয়াসা মুনাফা করেছিল প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৯৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসানের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, পরিচালন তথা বেতন-ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রয় ও বিতরণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এছাড়া সরকার থেকে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরও ওয়াসা লোকসান করবে বলে প্রাক্কলন করেছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রাহকদের কাছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৩ হাজার ৮৩৪ কোটি ৯৬ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। এতে ওয়াসার রাজস্ব আয় হয় এক হাজার ৪১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৩৫২ কোটি ২৬ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করেছিল ঢাকা ওয়াসা। এতে ওয়াসার রাজস্ব আয় হয়েছিল ৯৮০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর পানি সরবরাহ খাতে ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আয় বেড়েছে ৬১ কোটি ১২ লাখ টাকা। আবার গত অর্থবছর সংস্থাটির পানি অপচয় হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংস্থাটির পানির অপচয় হার দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ হার ছিল ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এদিকে গত এপ্রিলে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ১১.৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪.৪৬ টাকা নির্ধারণ করে ঢাকা ওয়াসা। এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট পানির দাম ৩৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দাম বাড়ে প্রায় আট শতাংশ। এর মাত্র ৯ মাস আগে অর্থাৎ গত অর্থবছর জুলাইয়ে পানির দাম পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি করে ওয়াসা। তবে করোনার মাঝে পানির দাম বৃদ্ধি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
ঢাকা ওয়াসা সমস্যার মূল সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিত্য নতুন প্রকল্প নিতে বেশি আগ্রহী। পানি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহারে ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ঘটনো হলেই লোকসান কমানো সম্ভব। কারণ, ঢাকা শহরে যেখানে পানি আছে, সেখানে প্রচুর পানি অচপচয় হচ্ছে, আর যেখানে নেই সেখানে শুধু হাহাকার। কয়েকদিন পূর্বে পুরো পানি সরবরাহ লবণাক্ত ও ঘোলাটে হয়ে পড়েছিলো। ওয়াসার নীতিনির্ধারকদের হাতে সে খবর ছিল না। পরে পত্র-পত্রিকায় লেখা লেখির কারণে কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়। এটাতে প্রমাণিত হচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাযক্রম তদারিক ও কাজের গুণগত মান উন্নয়নে যথাযথ তৎপরতা নেই। আর অবৈধ সংযোগ, সিস্টেম লস গিলে খাচ্ছে ওয়াসাকে। অনেক জায়গায় ওয়াসার পানির পাইপ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি নিঃসরন হয়ে সোয়ারেজ লাইনে চলে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো খবরই রাখে না। ওয়াসা চলমান প্রকল্পগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কাজে তদারকিতে অনিহা দৃশ্যমান। এছাড়াও ভোক্তাদের মাঝে পানির অপরচয় রোধে সচেতনতা বাড়ানো, পানির লাইনে নিয়মিত নজরদারি ও লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ করা, পানি চুরি ও অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা গেলে বর্তমান উৎপাদিত পানি দিয়ে নগরবাসীর পানির সমস্যা সমাধান সম্ভব। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ওয়াসার কোন সুনির্দিষ্ট পানি বিতরণ পরিকল্পনা নেই। সবগুলি সেবা সংস্থারই সংকট বা আপদকালীন একটি পরিকল্পনা থাকে। যদি কোনো স্থানে পানির সাময়িক সংকট হয়, সেটা ওয়াসা কীভাবে সমাধান করবে তা নিয়ে কোনো ভাবনা তাদের নেই।
এছাড়াও ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদে ভোক্তাদের কোনো সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬ অনুসারে ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, ইনষ্টিটিউট অব চার্টাড একাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি, সিটিকর্পোরেশনের প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি এবং পানি ব্যবহারকারীগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবার বিধান রাখা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিনিধি তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন কর্তৃক মনোনীত হলেও পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃর্তক তাঁরই পছন্দের ব্যক্তিকে মনোনীত করে থাকেন। বর্তমান ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানও একই প্রক্রিয়ায় মনোনীত। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক মনোনীত বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যান যে-ই হোক না কেন, তার পক্ষে তার মনোনয়নদানকারীর কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব? আইনের মার প্যাঁচে বলা আছে, পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি। একজন ব্যক্তি কীভাবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী হতে পারেন? সেটা নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা হতে পারে। তবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি হতে হলে তাকে ভোক্তাদের সাথে সংযোগ থাকতে হবে। আর সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করেছেন। যেখানে ধারা নং ৫ এর ১৬ উপ-ধারায় বলা আছে, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তারই ধারাহিকতায় ক্যাব সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা র্স্বাথ সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণী ও কমিটিগুলিতে প্রতিনিধিত্ব করে এলেও ঢাকা ওয়াসায় তা মানা হয়নি।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো, শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের অভাব। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সকল জনগণ বলা হলেও বর্তমানে শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সকল পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। এ জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়। যেখানে অনেকগুলি খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ীরাই নীতি নির্ধারণ করে থাকেন। অথচ, এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এই সেবা সার্ভিস তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এ পদগুলিও সমাজের উপরতলার লোকজন দখল করে নেন। এই সব বিষয় নিয়ে নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যার জন্য এই সেবা বা বিধান তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না।
তাই শুধুমাত্র গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর চেয়ে সরকারি সেবা সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অনেক বেশি জরুরি। একই সাথে গণশুনানীর আয়োজন করে ভোক্তাদের মতামত নিয়ে সেবার মান ও দাম নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, ওয়াসা রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। জনগণের করের টাকায় এর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। সে কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধসহ নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে পানির দাম বাড়ানোর ঠুনকো যুক্তি থেকে বের হয়ে এসে সেবা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনার মান, পানি ব্যবহারকারীদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ, কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা কাটানো সম্ভব।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।