দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
তারাবীর গুরুত্ব ও ফযীলত : তারাবীহ রমযানের রাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ আমল। এ মাসের অবারিত খায়র-বরকত, রহমত-মাগফিরাত লাভের ও ঘোষিত প্রতিদান প্রাপ্তির জন্য তারাবীর প্রভাব অপরিসীম। এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় তারাবীর নামায আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। [বুখারী:১/২২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা:৬/৯৮] অপর বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ,‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর ফরয করেছেন রমযান মসের রোযা আর আমি সুন্নাত করেছি তারাবীর নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে এবং তারাবীর নামায আদায় করবে, সে ঐ দিনের মত পবিত্র হয়ে যাবে, যেদিন সে মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’[সুনানে নাসাঈ: ১/২৩৯; মুসান্নাফে আবী শায়বা: ৫/২২৯-২৩০]
তারাবীর বৈশিষ্ট : তারাবীর নামায সুন্নাতে মুআক্কাদা হলেও তা অন্যান্য সুন্নাতের মতো নয়। এর জন্য ফরজ নামাযের মত জামাত বিধিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি এর জন্য আলাদভাবে ইমামও নিয়োগ দেওয়া হয়। সিংহভাগ মসজিদেই তারাবীতে পুরো কুরআন মাজীদ খতম করা হয় বিশেষ ইহতিমামের সাথে। এ থেকে বোঝা যায়, তাবাবীর গুরুত্ব সাধারণ নফলের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ভাবে প্রচার করছে যে, তারাবীর নামাযও অন্যান্য নফল নামাযের মতই। এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। তাই তারাবীহ না পড়লেও কোনো গুনাহ নেই। এদের প্রোপাগান্ডায় প্রবঞ্চিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া যাবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের তারাবীহ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীর জামাত নিয়মিত পড়াননি; বরং কখনো কখনো তারাবীর নামায জামাতের সাথে পড়িয়েছেন। আবার কখনো কয়েক রাকআত জামাতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন এবং বাকাী নামায একাকী পড়েছেন; বরং অধিকাংশ সময় তারাবীর নামায তিনি একাকীই পড়তেন। তবে সর্বাবস্থায় তিনি তারাবীহ ২০ রাকআতই পড়েছেন। যার আলোচনা পড়ে আসছে। তিনি নিজে কেন তারাবীর জামাতের নিয়ম করেননি তার কারণও উম্মতকে বলে গেছেন। সেই কারণ হলো, তিনি নিয়মিত জামাতের সাথে তারাবী পড়লে তা ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। আম্মাজান আয়েশা রা বলেন, রমযানের এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হয়ে মসজিদে গিয়ে তারাবীর নামায পড়া শুরু করলেন। ইতিমধ্যে কিছু সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে ইক্তিদা শুরু করলেন। সাহাবায়ে কিরামের মাঝে এ বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে পরদিন তারাবীতে আরো অধিক সংখ্যক সাহাবী তাঁর পেছনে ইক্তিদা করলেন। তৃতীয় দিন সাহাবায়ে কিরামের সংখ্যা আরো বেড়ে গেলো। ৪র্থ দিন মসজিদে আর জায়গায় সংকুলান হলো না। এ দিন তিনি ফযরের নামায আদায়ের পর সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, হামদ-সালাতের পর, তোমরা শোন, তোমাদের অবস্থা আমার অজানা নয়। কিন্তু আমার ভয় হয়, এভাবে চলতে থাকলে তোমাদের উপর তারাবীর নামায ফরয হয়ে যেতে পারে। তখন তোমরা তা আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়বে। [ফলে ফরয তরকের গুনাহে সকলেই জড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কায় সকলে মিলে জামাতে তারাবীহ পড়ার ব্যবস্থা আর করা হলো না।] তারাবীর নামায এ অবস্থায় রেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন। [বুখারী, হাদীস: ২০১২, মুসলিম, হাদীস: ১১০৪]
তারাবীর জামাত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে, ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর রা. এর শাসনামলে এবং উমর রা. এর শাসনামলের শুরুতে এক ইমামের পিছনে ফরয নামাযের মত তারাবীর নামায জামাতের সাথে আদায় করার ইহতিমাম ছিলো না। পরবর্তীতে রমযানের কোনো রাতে হযরত উমর রা. মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখলেন মসজিদের বিভিন্ন স্থানে তারাবীর খন্ড খন্ড জামাত হচ্ছে। কেউ বা আবার একাকী তারাবীহ আদায় করছে। এ অবস্থা দেখে তিনি চিন্তা করলেন সকলকে এক ইমামের পেছনে একত্রিত করে দিলে অনেক উত্তম হবে। এরপর তিনি এক ইমামের পিছনে তারাবীর জামাত পড়ার নির্দেশ জারি করলেন এবং সাহাবী উবাই ইবনে কাবকে রা.কে তারাবীর জামাতের ইমাম বানিয়ে দিলেন। [বুখারী, হাদীস: ২০০৯, ২০১০]
তারাবীর রাকআত সংখ্যা : হালে সালাফী ও আহলে হাদীস নামধারী এক শ্রেণীর মানুষ বলে বেড়াচ্ছে যে, তারাবীর নামায ২০ রাকআত নয়; বরং এর রাকআত সংখ্যা ৮। এটা মূলত বিভ্রান্তি। মনে হয় মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই তাদের আসল লক্ষ্য। নতুবা শক্তিশালী দলিলের দ্বারা প্রমাণিত দেড় হাজার বছর যাবত পালিত একটি আমলের উপর তারা এভাবে ইতিরাজ করতে পারতো না। তারাবীহ মূলত ২০ রাকআতই। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস, সাহাবায়ে কিরামের ইজমা, পরবতী সকল তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, মুজতাহিদ ইমামগণের আমল ও ইজমার দ্বারাই প্রমাণিত। [দেখুন, আল মুগনী, ইবনে কুদামা:২/১২৩] সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানে তারাবীর নামায ২০ রাকআত পড়তেন এবং বিতর আলাদাভাবে পড়তেন। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস:৭৬৯২, ৭৬৮০-৭৬৮৪; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী, হাদীস:৪২৯০-৪২৯২; আল মুজামুল কাবীর, তবরানী, হাদীস:১২১০২] ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. ছিলেন প্রথম সারির একজন বিখ্যাত তাবেঈ, হাদীস, ফিকহ ও তাফসীরের ইমাম। তিনি ২০০ সাহাবীকে সরাসরি দেখেছেন। [দেখুন, তাহযীবুল কামাল:১৩/৪৯] তিনি বলেন, আমি সাহাবা ও প্রথম সারির তাবেয়ীগণকে দেখেছি, তাঁরা ২০ রাকআত তারাবীহ ও ৩ রাকআত বেতর পড়তেন।[মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস:৭৬৮৮] সাহাবী উবাই ইবনে কাব রা.কে তারাবীর ইমাম নিযুক্ত করার পর থেকে মসজিদে নববীতে তিনি প্রকাশ্যে ২০ রাকআত তারাবী পড়াতেন। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস:৭৬৮৪] সেই জামাতে উমর রা., উসমান রা., আলী রা. সহ মদিনায় উপস্থিত সকল সাহাবীই অংশ গ্রহণ করতেন। আর তখন প্রায় সকল সাহাবীই মদিনায় উপস্থিত ছিলেন। কোনো কোনো সাহাবী মদীনার বাইরে থাকলেও মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ায় তার সাথে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমতাবস্থায় কোনো সাহাবীই ২০ রাকআত তারাবীর বিরোধীতা করে ৮ রাকআতের কথা বলেননি। তাহলে দেড় হাজার বছর পর আজকে যারা তারাবীহ ৮ রাকআত বলছেন তা তারা কোথায় পেলেন? তাই বিদূরিত হোক তারাবীহ নিয়ে সকল বিভেদ-বিভ্রান্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কিরাম ও সলফে সালেহীনগণের আদলে হোক আমাদের তারাবীহ। এতেই রয়েছে উম্মাহর মু্িক্ত।
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।