পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একটি খবরের প্রতি সম্মানিত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই সচিত্র খবরটি ফেসবুক থেকে নেওয়া। ‘ইনকিলাবে’ আমার সহকর্মী আনোয়ারুল হক আনোয়ার ফেসবুকে নিয়মিত স্ট্যাটাস দেন। ইসলাম এবং মুসলিম জাহানের যেখানে যা ঘটছে তিনি তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে আনেন এবং ফেসবুকে দেন। গত ২১ এপ্রিল তার এমনই একটি স্ট্যাটাসে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তার স্ট্যাটাসের শিরোনাম হলো, ‘লকডাউনে মাহাথির মোহাম্মদের গাড়ি চেক করছে কর্তব্যরত পুলিশ।’ তিনি লিখেছেন, ‘করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে লকডাউনের মধ্যে জরুরি কাজে বের হলেন, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। কর্তব্যরত পুলিশ সড়কে বের হওয়ার পাস আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখছেন। ড. মাহাথির কর্তব্যরত পুলিশকে কাগজপত্র দেখাচ্ছেন। অথচ আমাদের দেশ হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো!’ এই স্ট্যাটাসে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে সেটিকেই ইনকিলাবে ইনসেট হিসাবে দিলাম।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সেদিনের ঘটনাটি দেখুন। সরকারের তথাকথিত ‘কঠোর লকডাউন’ ইনকিলাবের প্রধান সংবাদের লাল কালির শিরোনাম ছিল, ‘লকডাউন না তামাশা’। প্রায় সমস্ত জাতীয় দৈনিক তাদের রিপোর্টে অনুরূপ কথাই লিখেছে। দ্বিতীয় পর্বের লকডাউন আরো ছ্যারাব্যারা। যাই হোক, প্রথম লাকডাউনের দ্বিতীয় দিনে রাস্তায় বের হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাইদা শওকত। রবিবার ১৮ এপ্রিল পুলিশ এলিফ্যান্ট রোডে একটি গাড়ি থামায় এবং আরোহিনীর পরিচয়পত্র দেখতে চায়। আরোহিনী ছিলেন এক নারী ডাক্তার। আর নিউমার্কেট থানা পুলিশের সহযোগিতায় সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসের সহকারী সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মামুনুর রশিদ। ডা. সাইদা শওকতের ডাক নাম জেনি।
ম্যাজিস্ট্রেট ডা. জেনির কাছে জানতে চান যে তার কাছে কোনো পরিচয় পত্র বা মুভমেন্ট পাস আছে কিনা। ডাক্তার বলেন, তার কাছে পরিচয় পত্র বা মুভমেন্ট পাস নাই। তিনি অকস্মাৎ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘ডাক্তারের আবার মুভমেন্ট পাস? আমি আইডি কার্ড সাথে আনিনি।’ তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে তুই তোকারি করেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমি বীর বিক্রমের মেয়ে।’ তখন ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আপনি আমাকে ধমক দিচ্ছেন কেন?’ জবাবে ডাক্তার বলেন, ‘১০০ বার দেব। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বলেই তোমরা পুলিশ হয়েছো।’ তখন সেখানে দায়িত্বরত নিউমার্কেট থানার এক অফিসার বলেন, ‘আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। তাতে কী হয়েছে? আপনার বাবা একা যুদ্ধ করেন নাই। আপনি কেন তুই তুই করে কথা বলছেন?’ তখন ম্যাজিস্ট্রেট ডা. জেনিকে বলেন, ‘আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’ জবাবে জেনি বলেন, ‘করোনায় জীবন গেছে কয়জন ডাক্তারের? আর আপনারা কয়জন মরেছেন? আমার কাছে আবার চান মুভমেন্ট পাস। ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আমি পিজি মেডিকেলের প্রফেসর।’
পরে পুলিশের আরেক সদস্য বলেন, ‘আপা, আপনাকে তো হয়রানি করা হচ্ছে না। আপনার কাছে পরিচয়পত্র চাওয়া হচ্ছে।’ পুলিশের আরেক সদস্য বলেন, ‘আপনি আমাকে তুই তুই করে বলতে পারেন না।’ তখন ডাক্তার জেনি বলেন, ‘আমি কে, সেটা এখন তোদের দেখাচ্ছি হারামজাদা।’ এই কথা বলে এক মন্ত্রীকে ফোন করেন তিনি। বলেন, তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। অতঃপর তিনি কথা বলার জন্য ঐ পুলিশের হাতে ফোন তুলে দেন। ডাক্তার এ কথাও শুনিয়ে দেন যে, তিনি জয়েন্ট সেক্রেটারী পদ মর্যাদার একজন অফিসার।
এই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি কী? পরিণতি হলো, ঘটনার তিন দিন পর সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ঢাকা বিভাগ থেকে বরিশাল বিভাগে বদলী করা হয়েছে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো? লকডাউনের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের কাজ হলো মুভমেন্ট পাস বা আইডি চেক করা। তার জবাবে, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, হারামজাদা, মন্ত্রীকে ফোন’- এত কথার কী প্রয়োজন ছিল? সাইদা শওকত নিজেকে জয়েন্ট জয়েন্ট সেক্রেটারি র্যাঙ্কের বলে দাবি করেছেন। আর ওইখানে মাহাথির মোহাম্মদ? একটানা ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই তো দেড় দুই বছর আগেও দুই বছরের জন্য দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মাহাথির মোহাম্মদ শুধুমাত্র মালয়েশিয়াতেই শ্রদ্ধার পাত্র নন, সারা দুনিয়ায় শ্রদ্ধার পাত্র। অনুন্নত দেশের উন্নয়নের রোল মডেল তিনি। তাঁর মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব গাড়ি থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখান। আর বাংলাদেশে একটি সরকারি হাসপাতালের ইমেজিং ও রেডিওলজির সহযোগী অধ্যাপকের মুভমেন্ট পাস দেখতে চাওয়ার অপরাধে(?) একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’ হয়। এর পরও কি আর কোনো অফিসার সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে?
দুই
এর মধ্যে করোনা নিয়ে দেশে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। করোনার প্রথম ঢেউ, অর্থাৎ গত বছর বাংলাদেশকে যতখানি কাবু করেছিল, দ্বিতীয় ঢেউ, অর্থাৎ এ বছরের দ্বিতীয় ঢেউ তার চেয়ে অনেক বেশি পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রথম দিকে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে আঘাত হানে বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট। টেকনিক্যাল পরিভাষা ব্যবহার না করে বলছি, বিলাতি করোনা। সেটি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই মার্চে দেখা দিল সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার করোনা। এটি বড় অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক এবং চতুর। এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে একটু টেকনিক্যাল কথা না বললেই নয়। বললে বরং পাঠক ভাইদের বুঝতে সুবিধা হবে।
আসলে করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক নিয়মে রেপ্লিকেট (জবঢ়ষরপধঃব) করে। অর্থাৎ প্রতিলিপি সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টির সময় মাঝে মাঝে প্রতিলিপির ধরন কিছুটা এধার ওধার হয়ে যায়। মিউটেশনের (গঁঃধঃরড়হ) প্রক্রিয়ায় এটা হয়। বাংলাদেশে বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয় ৬ জানুয়ারি। আর সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। ৩ মাস আগে বৃটিশ এবং ২ মাস আগে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হওয়ার পরেও কেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সময় মতো নেওয়া হলো না, সেটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার। এর মধ্যে আবার ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টও সনাক্ত হয়েছে। বৃটিশ ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে সাউথ আফ্রিকান এবং ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন আরও বেশি ডেঞ্জারাস তথা ভয়াবহ। এরা অ্যাস্ট্রাজেনেকা তথা করোনার টিকা সৃষ্ট ওসসঁহব ঝুংঃবস বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পাশ কাটিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে। তবে যাদের করোনার টিকা নেওয়ার পর ৪ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের অসুখ ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে যায় না। অল্পতেই সেরে যায়। এর আগে আমি এই কলামে বলেছি যে, আমাদের পরিবারের ১০ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে ৯ জনই সুস্থ হয়েছেন। আরেক জন, অর্থাৎ আমার মেয়ের জামাই সুস্থ হওয়ার পথে। এদেরকে অক্সিজেন দিতে হয়নি বা রেমডিসিভির ইঞ্জেকশন দিতে হয়নি।
তিন
কিন্তু গত ৫/৭ দিন ধরে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাউথ আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ছাড়াও দেশে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট নামে নতুন ধরনের করোনার প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যেই ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে গেছে। ভারতে করোনা এখন ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। দৈনিক গড় সংক্রমণ ৩ লক্ষ ৩৭ হাজার। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সাউথ আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয় ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। গত শনিবার ২৪ এপ্রিল ডেইলি স্টারের খবর থেকে জানা যায় যে, ইন্ডিয়ান ভাইরাসের রয়েছে ডাবল মিউটেশন। ভারতে ইতোমধ্যেই ১ কোটি ৪০ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন এবং শনিবারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিন স্থল, বিমান, পানি ও রেলপথে লক্ষ মানুষ বিভিন্ন কারণে যাতায়াত করেন। ফলে এই বিধ্বংসী ভ্যারিয়েন্ট গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভারতের এই ভয়াল ভাইরাস যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তাই অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতো প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ সহ প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞ এক কণ্ঠে বলেছেন যে, অবিলম্বে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করতে হবে এবং এই সুদীর্ঘ নাজুক সীমান্তের (চড়ৎড়ঁং নড়ৎফবৎ) অলিগলি, ঘুপচিতে কঠোর চেকপোস্ট বসাতে হবে।
কিন্তু আফসোস, সীমান্ত বন্ধের পরিবর্তে বরং উল্টাটাই করা হলো। দোকানপাট তো বন্ধ হলোই না। বরং পরশুদিন, অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল সব কিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে। জানি না, আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা কপালে কি লিখে রেখেছেন।
এই লেখাটি মেইলে দেওয়ার পর জানা গেল যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ রোধ করার জন্য স্থল সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু স্থল সীমান্ত বন্ধ করলে হবে না। নৌ, রেল ও বিমান পথও বন্ধ করতে হবে। ৩/৪ দিন আগে ভারতীয় হাই কমিশনার দোরাই স্বামী বলেছিলেন যে, শীঘ্রই ভারতীয় কোভিশিল্ডের একটি চালান দেশে আসবে। ২৫ এপ্রিল মানবজমিন পত্রিকার অনলাইন এডিশনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কোভিশিল্ডের ২১ লক্ষ ডোজ বাংলাদেশে এসে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে একই তারিখ, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল ভারতীয় হাই কমিশন চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে কাঁচামালের সংকট ও ভারতে বিপুল অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে বাংলাদেশ শীঘ্রই কোভিশিল্ডের টিকা পাচ্ছে না। অন্যদিকে একই তারিখ, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিলের ‘বাংলা ট্রিবিউনে’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন যে, বেক্সিমকোকে টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন টিকা আনার দায়িত্ব তাদের। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কারো সাথে কারো কোনো সমন্বয় নাই।
এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ২/১ দিনের মধ্যেই ঢাকা আসছেন।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।