পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাঙ্গালী লড়াকু জাতি। ইতিহাস এমন নেই যে, তারা খুশি মনে কোন বহিঃশক্তির অধীনতা মেনে নিয়েছে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের পদানত হওয়ার পর সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আন্দোলন, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা বারে বারে পরাধীনতার জিঞ্জির খুলে ফেলার মরিয়া প্রয়াস চালিয়েছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে যে স্বাধীন, স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্জিত হয়েছিল, তার প্রধান রসদ বাংলার মুসলিমরাই জুগিয়েছিল। ১৯৩৭ সাল ও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলায় অর্জিত সাফল্যই সেদিন মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন পাকিস্তানে খুব শিগগির তারা বুঝতে পারল, বাঙ্গালীদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয়নি।
কি ছিলো এ জনপদের মানুষগুলোর চাওয়া-পাওয়া? কেন তাদের একবারের উপর দু›বার স্বাধীন হওয়া লেগেছিল? কেন তাদের নিজেদের গড়া পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল? বাঙ্গালীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তা, কৃষ্টি-কালচারের প্রতি অবজ্ঞা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য পাকিস্তানের পরিকাঠামোতে তাদের নিজেদেরকে অবহেলিত ভাবতে বাধ্য করেছিল। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, ৬০-এর দশকের শেষ পাদে এসে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা স্বশাসনের দাবিতে রূপ লাভ করে। ৭০-এর নির্বাচনে জনতার দেয়া ম্যান্ডেট মেনে নিতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের অস্বীকৃতি আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে। স্বশাসনের দাবি স্বাধীনতার দাবিতে উন্নীত হয়। ৭১-এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স মাঠে হুংকার দিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়েও এ জনপদের মানুষ বুঝে নিয়েছিল, তাদের এতদিনকার সংগ্রাম একটি সিদ্ধান্তকারী পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সমঝোতার পথে পা না বাড়িয়ে নিরস্ত্র জনতার উপর পাকিস্তানী বাহিনীর ক্র্যাকডাউন স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলে। ৯ মাসের যুদ্ধে চুড়ান্তভাবে হেরে গিয়ে পরে পাক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল, তারা দু-একটি রাজনৈতিক দল বা তাদের কর্মীবাহিনী নয়, একটি সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
সেদিন তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমার অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এ অভীষ্ট সহজে অর্জিত হবে না, অনেক রক্ত ঝরাতে হবে। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। আরও বুঝতে পেরেছিলেন, সামনে যে কঠিন সময় আসছে, তাতে তিনি নিজে হয়তো নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।› তবে, একজন শান্তিপ্রিয় জননেতা হিসেবে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং ভুট্টো সাহেবের হঠকারিতা সত্তে¡ও রক্তক্ষয় এড়ানোর প্রচেষ্টায় তিনি আন্দোলনের চাপ অব্যাহত রেখে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য, ইয়াহিয়া খানদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি।
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে গুলি চালায়। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানের পুলিশ, ইপিআর ও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী সদস্যরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হল। যোগ দেয় দেশের ছাত্র-জনতা, তরুণ-যুবারা। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে অবশেষে পাক বাহিনী পরাস্ত হয়। শেষ মুহূর্তে ভারতীয় বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বিজয়কে তরান্বিত করে বটে, তবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীকে ইতোমধ্যেই কোনঠাসা করে ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে সামনে রেখে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ এই চেতনায় পরিচালিত এ যুদ্ধ ছিল এক জনযুদ্ধ, যাতে দেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শামিল হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে এ যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর বিজয় ও গণ-বিচ্ছিন্ন পাক বাহিনীর পরাজয় অবধারিত ছিল।
অগুণতি শহীদানের আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে দেশ স্বাধীন হল। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর মধ্যে ফিরে এলেন। দেশ এখন একটি নতুন অথচ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল। এ চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার, স্বাধীন এ দেশটিকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার। অনেকের হাতে অস্ত্র ছিল, সেগুলো দ্রুততম সময়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা জরুরি ছিল। যুদ্ধের কারণে দেশের সর্বত্র রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সহ সব ধরণের অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছিল, বহু লোক ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল, বহু কৃষকের চাষবাসের জন্য হালের বলদ কিংবা লাঙ্গলের সংস্থান ছিল না। দুর্বৃত্তরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অফিস-আদালত, কল-কারখানার আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি লুটপাট করছিল। পাকিস্তানিরা দেশের অর্থব্যবস্থা ফোকলা করে দিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের শেষের দিকের দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে: পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এর ব্যাঙ্ক হিসাবে ঠিক ১১৭ রুপি (১৬ ডলার) রেখে গিয়েছিল। অর্থনীতির পাশাপাশি খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ সব খাতকেই মেরামত করে নতুন করে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ হাতে নিতে হয়েছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে তুলে ধরে সারা বিশ্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য ছিল। এ বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বঙ্গবন্ধু তার দুঃখজনক হত্যাকান্ডের আগ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময় পেয়েছিলেন। তিনি কতটুকু সফল হয়েছিলেন, সে বিচার ইতিহাস করবে। তবে, এটা অস্বীকার করার জো নেই, যেটুকু সাফল্য এসেছিল তা তার বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণেই সম্ভবপর হয়েছিল।
দেশ আজ অনেক এগিয়েছে। কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ি এখন দক্ষিণ এশিয়ায় (ভারতের পরে) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অধিকারী (৪৩, ৮২৩ মার্কিন ডলার/ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)। আইএমএফের মতে, ২০১৯ সালে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১,৯০৬ মার্কিন ডলার, জিডিপি ৩১৭ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন দেশে কর্মরত সোয়া কোটি প্রবাসীর রেমিট্যান্স এবং রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মূল যোগানটা আসছে। একদিকে যখন শ্রমজীবী মানুষেরা দেশে-বিদেশ হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দেশের কোষাগারে যোগান দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তখন কিছু লোক ব্যস্ত সময় কাটায় দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ লুটে-পুটে কিংবা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা কিংবা অন্যবিধ ফাঁদে ফেলে তাদের হাতের পাঁচ কেড়ে নিয়ে ভিন দেশে অর্থ পাচারে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) -এর এক প্রতিবেদন অনুসারে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা৷ এই অর্থ বাংলাদেশের দু›টি বাজেটের সমান৷ এ সময় কালে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে৷ (অর্থ পাচারের ইতিবৃত্ত । ডয়চে ভেলে, ২২ মে, ২০১৭)
এদেশের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল খাদ্য শস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। বিগত ৫০ বছরে এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে যেখানে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৪ কোটি ৫৩ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও-এর বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাধীনতাপরবর্তী ৪৯ বছরে দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। তবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্যের কারণে দেশের বেশ কিছু মানুষ এখনো খাদ্য সংকটে ভুগছেন। অন্যদিকে, খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাবিধ ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে থাকেন, যার ফলে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য প্রাপ্তি অনেক ক্ষেত্রেই দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে দেশে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর সময়ে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তদীয় সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে এখন ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। স্বাক্ষরতার হার ৭৪.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৪ শতাংশ ছিল মেয়ে। ২০১৮ সালে এসে তা ৫০.৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিকে মোট ছাত্রছাত্রীর প্রায় ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৫৪ শতাংশের বেশি এবং এইচএসসি পর্যায়ে ৪৮.৩৮ শতাংশ। ১৯৭১ সালে যেখানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেখানে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে ৫৭টি সরকারি এবং ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে ১৬টি সাধারণ, ৫ টি প্রকৌশল, ৯টি কৃষি, ১৭টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ৫টি মেডিকেল এবং ৩টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নামে দুটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।) এছাড়াও ৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ৬টি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে। তবে, স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের শিক্ষাঙ্গনসমূহ, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে, ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি যে বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে এবং সময় ও ক্ষেত্রভেদে যেভাবে হানাহানিতে রূপ নেয়, তা শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের জন্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পঠন-পাঠন ও জ্ঞান-গবেষণার চেয়ে পদ-পদবি অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে এবং ফলে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনসমূহে বিশ্বমানের জনবল থাকা সত্তে¡ও উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে সে ধরণের কালচার গড়ে উঠছে না।
মেডিকেল এডুকেশন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমাদের অর্জন নেহাত মন্দ নয়। ১৯৭১ সালে আমাদের মাত্র ৬টি মেডিকেল কলেজ ছিল। এখন সেখানে ৩৬টি সরকারি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া, আধুনিক মানদন্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি ও উচ্চতর মেডিকেল গবেষণার জন্য ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল রিসার্চ (আইপিজিএমআর)-কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আরও ৪টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়েছে। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব হাসপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ বিশেষ রোগের চিকিৎসায় বেশ কিছু বিশেষায়িত হাসপাতাল কাজ করে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার আইডিয়া থেকে সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার হাজারে ১৯৯০ সালে ১৪৩.৮ জন থেকে ২০১৯ সালে ৩০.৮ জনে এবং মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৯৯০ সালে ৫৭৪ জন থেকে ২০১৭ সালে ১৭৩ জনে নেমে এসেছে। ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করছে। তবে, দেশে এখন পর্যন্ত জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল - প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য মাত্র ৫.২৬ জন। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। যথাযথ পলিসি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মেসি পেশাজীবিরা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারছে না।
বঙ্গবন্ধু ‹সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়› নীতিতে যে পররাষ্ট্র নীতির সূচনা করে গিয়েছিলেন, অদ্যাবধি স্বাধীনতা-উত্তর সব সরকারই কম-বেশি সেটাই অনুসরণ করে আসছে। বঙ্গবন্ধু একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ কারণে তিনি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার শর্তে। সেদিনকার বাস্তবতায় এটা ছিল একটি কঠিন সিদ্ধান্ত, তবে তাঁর এ দূরদর্শী সিদ্ধান্তের সুফল আজ বাংলাদেশ ভোগ করছে। সেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরব সহ তাদের অনেকেই আজ বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিগড়ে আবদ্ধ এবং এ দেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
আজকের বাংলাদেশে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল টানা-পড়েনগুলো চলছে দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সাথে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতার সুবাদে ভারত আমাদের আজন্ম বন্ধু। ভারতের সাথে আমাদের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো দু› দেশের মধ্যে বহমান নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি। এছাড়া মাঝে মধ্যেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশীরা হত্যাকান্ডের শিকার হন। আন্তঃদেশীয় বানিজ্যে বাংলাদেশের বিশাল ঘাটতিও সুখদায়ক নয়। এদিকে অন্য প্রতিবেশী মিয়ানমার ১৯৭৮ সাল থেকে রাখাইন স্টেটের রোহিঙ্গা মুসলমানদের দফায় দফায় উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদি মানবিক সমস্যা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ দু’ প্রতিবেশীর সাথে এসব সমস্যা ক‚টনৈতিকভাবে সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফলাফল খুব আশাব্যঞ্জক নয়। অনেকে মনে করেন, এসব সমস্যার সুরাহা করতে হলে বাংলাদেশকে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দৃঢ় জাতীয় ঐক্য ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোরালো জনমত তৈরি করতে হবে, যাতে প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্র চাপ অনুভব করে এবং তাদের মধ্যে এ অনুভূতি তৈরি হয় যে, এ ইস্যুগুলোর সমাধান না হলে তারা বড় ধরণের লোকসানের মুখোমুখি হতে পারেন।
দেশ শাসনের প্রশ্নে এ দেশের মানুষ বরাবর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে চেয়েছে। এ কারণে সামরিক শাসন বা অন্য কোন ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখানে স্থায়ী ভিত্তি গড়তে পারেনি। সত্যি বলতে, ১৯৭১ সালে পাক সেনানায়কেরা ৭০-এর নির্বাচনে জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট উল্টে দেয়ার চেষ্টা করার কারণেই এ দেশের জনগণকে সেদিন স্বাধীনতার জন্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোন রকম মতানৈক্য না থাকলেও দেশ গত ৫০ বছরেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী কালচার গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদ্ব›দ্বী দল-উপদলসমূহের অসহিষ্ণু ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পেশীশক্তি আস্কারা পাচ্ছে এবং রাজনৈতিক কানেকশন ব্যবহার করে অনেকেই নিজেদের পদ-পদবির জোরে জনগণের অর্থ আত্মসাত করছে। বিজ্ঞজনদের মতে, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক দলসমূহের পরষ্পরের মধ্যে আস্থা, সম্মান ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একে অপরের কাছে নিরাপদ বোধ করে। তাহলেই কেবল দেশ ও দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা মতলববাজ পেশীশক্তি ও আমলাতন্ত্রের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।