পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিউটের সহকারী অধ্যাপক বিষ্ণু কুমার অধিকারীকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৮ ফেব্রুয়ারী শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০৪তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন সিন্ডেকেট অধ্যাপক আবদুল আলিম। তিনি জানান, সহকারী অধ্যাপক বিষ্ণু কুমার অধিকারীর বিরুদ্ধে যে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল, সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটে ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে ছয় বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এই ছয় বছরে তিনি কোন ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা নিতে পারবেন না। বেতন-ভাতা, প্রমোশন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এই ছয় বছরে তিনি নিষিদ্ধ থাকবেন। ২০১৯ সালের ২৫ ও ২৭ জুন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক বিষ্ণু কুমার অধিকারীর বিরুদ্ধে দুই শিক্ষার্থী উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর ২ জুলাই অভিযোগ আমলে নিয়ে ইনস্টিউটের সব একাডেমিক কার্যক্রম থেকে ওই শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বর্তমান সময়ে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণকান্ড সমাজের সকল স্তরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। নারী যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক শুধু তাঁরাই নন, আজকাল অতি অল্প বয়সের শিশুকন্যাদেরও যৌন অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে। শিশু ও নারীদের বর্তমানে গ্রাম ও শহরে সর্বত্র প্রতিদিন নানাভাবে এই রকমের যৌন লাঞ্ছনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে গোটা দেশের মানুষ আজ উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে দেশের রাজধানী ঢাকাতেই শুধু নয়, দেশের আনাচে-কানাচেও। কিন্তু তাতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। একটা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবাদী আন্দোলন জোরদারভাবে চলাকালীন সময়ে অন্য নতুন ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসছে। মানুষ তাতে নিশ্চিতভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারছে না, সম্ভবও নয়।
তবে মাঝে মধ্যে কিছু পন্ডিত প্রবর (?) ব্যক্তিত্বের বিরূপ বেসুরো মন্তব্যও আসছে সংবাদমাধ্যমে। যদিও বা এদের সংখ্যা নিতান্ততই কম, তথাপি ভাববার বিষয় হল- এরা যা বলতে চান বা চাইছেন সেই বক্তব্য ধর্ষণকে সমর্থন জোগাবে। প্রকারান্তরে সহায়কও হতে পারে, এ কথা বললে উত্যুক্তি করা হবে না। এটা বলাই বাহুল্য, যে কোনও কাজের পিছনে সমাজের কোনও না কোনও অংশের সমর্থন না থাকলে তা বেশিদিন বার বার ঘটবে কীভাবে? তাই বাস্তবতা হল, এ অংশ এখনও মোটামুটি শক্তি নিয়েই সমাজে বিদ্যমান রয়েছে।
এরা কারা হতে পারে? এরা কোন দর্শনে বিশ্বাসী হতে পারে? প্রথমত, যারা নারীকে শুধুমাত্র ভোগের বিষয় হিসেবে গণ্য করে কিংবা তাকে কেবল সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ার যন্ত্র মনে করে এবং নারীকে বাজারের অন্য পণ্যসামগ্রীর ন্যায় পণ্য সাব্যস্ত করে, তারাই এই নীতির প্রতিনিধি। মূলত সামন্তবাদী চিন্তাধারা এটা। সুতরাং বলাৎকার-ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এদেরও বিরুদ্ধে সচেতন প্রচার অভিযান না করে সফল হবে না।
দ্বিতীয়ত, সর্বস্তরের জনগণের দাবি, নারীদের নিরাপত্তাসহ ধর্ষণ রোধে ধর্ষণকারীদের কঠোরতম শাস্তিদানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন জরুরি। একটা কথা উল্লেখ করা উচিত যে, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, অন্যান্য আমলা বাহিনী ও সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতা-জনপ্রতিনিধি কেউ আজ বাদ নেই এই ধর্ষণ তালিকা থেকে। কর্কট রোগের ন্যায় দ্রুত বিস্তার লাভ ঘটছে সমাজের সকল ক্ষেত্রে। নির্যাতিত মহিলার বয়ান থানায় নথিভুক্ত হয় না। অপরদিকে, থানার ভিতরেই ধর্ষণ হয় এইরূপ অজস্র উদাহারণ পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, গণধর্ষণ এবং তার বীভৎস রূপ সংবাদ মাধ্যমে যখন দেখতে বা পড়তে পাওয়া যায় তখন গা শিউরে উঠে। ঘটনা ঘটার পরে রাজনৈতিক নেতাদের সংকীর্ণ স্বার্থে সেটা আড়াল করার চেষ্টা অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে সামনে আসছে।
এখন দেখা যাক, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির অন্য একটি দিক। বলাৎকার বা ধর্ষণ শব্দগুলোর অভিধানিক অর্থ হল বলপূর্বক নারীর উপর যৌন অত্যাচার। এটা নারীর উপর পুরুষের দ্বারা নির্যাতন। বলা হচ্ছে শারীরিক দিকের শক্তি বিবেচনায় নারীর তুলনায় পুরুষ শক্তিশালী। অতএব একজন পুরুষ দ্বারা একজন নারীকে শারীরিক নির্যাতন করা সম্ভব, কিন্তু একজন নারীর ক্ষেত্রে তা প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা হল, বলাৎকার শব্দের অর্থ শুধু নারীর উপর পুরুষের বল প্রয়োগ বোঝায় না। কোনও ইচ্ছা, অভিব্যক্তি, কামনা-বাসনা বা সিদ্ধান্ত কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়ার নামও বলাৎকার। সেটা যদি সত্যি হয়, বর্তমান সরকার বা গোটা শাসকশ্রেণি এমন বহু সিদ্ধান্ত প্রতিদিন জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে যা অধিকাংশ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তারা তা সমর্থন করে না, কিন্তু সরকার জোর-জবরদস্তি করে সেগুলো জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অতএব সেগুলোও নিঃসন্দেহে বলাৎকারই। গণতান্ত্রিক দেশে এইরূপ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক মানুষের উপর জবরদস্তিমূলক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার প্রভাব জনগণের উপর, ভিন্ন ভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে প্রকার ভেদে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সরকার মানুষের আন্দোলনের ভাষা বুঝতে চাইছে না। প্রশাসন মানুষের পক্ষে কাজ করছে না, অর্থ দিয়েই সবকিছুই কেনা যায়, বড় বড় আমলা বা রাজনৈতিক নেতা হলে কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করেও দিব্যি রেহাই পাওয়া যায়, এই ধারণা সমাজে ক্রমেই বদ্ধমূল হচ্ছে। লাভ ও মুনাফার নীতি মানুষের শুভবুদ্ধির উপর বসানো হচ্ছে। সুনীতি ন্যায়ের সামাজিক বা সামগ্রিক স্বার্থের জায়গায় কেবল ব্যক্তিস্বার্থের দিকে সমস্ত কাজের অভিমুখ তৈরি করা অর্থাৎ আমার কর্মের ফলে সমাজের ক্ষতি কী হল সেটা বিচার করার নৈতিক কোনও দায়িত্ব এখন বিবেচ্য থাকছে না। ব্যক্তির স্বার্থই প্রধান ও শেষ কথা। ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে বাজার। এই সামগ্রিক অবস্থাও উদ্বেগের জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। তাই নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বা সামাজিক নির্যাতন এইসব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এখানে একটাকে বাদ দিলে চলে না। এই নীতি যত বেশি গভীরভাবে চালু হচ্ছে তত ব্যাপক হচ্ছে দুর্নীতি আর সেটা শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারীই নয়, ধর্ষণ-বলাৎকার সবকিছুই এতে আছে।
পুলিশ ও প্রশাসনের আমলাদের পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে যে কোনও বড় অপরাধ করা, যেমন ড্রাগমাফিয়া, ভেজাল ওষুধ বাজারে ছাইয়ে দেওয়া আজ আর নতুন কোন চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা নয়। হামেশাই এসব ঘটে চলেছে। শেষে হয়তো ২/১টি ক্ষেত্রে মিডিয়ার দৌলতে প্রকাশ পায় এবং কয়েকদিন বা সপ্তাহব্যাপী চিৎকার-হই-হুল্লোড় হয়। ওই যা, চাপা যায় আস্তে আস্তে। কয়েকদিন পর আবার আরেকটি নতুন ঘটনা প্রকাশ পায়। এ সকল দেখতে দেখতে একদল মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার জন্ম হয় বা বাড়ে। এতে আশ্চর্য হবার কী থাকতে পারে! এই অবস্থায় চিন্তার বিষয়, কঠোর আইন করে সমাজ থেকে নারী নির্যাতন বা যৌন অপরাধ দমন সম্ভব হবে কি? এ প্রশ্ন নিয়ে যে কোনও লোকের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু দয়া করে শাসক শ্রেণী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করবেন না। কারণ তা হলে যে কারোরই বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় অপরাধীরা আরো সুযোগ পাবে। বিষয়টির উপর সুধিমহল এবং দেশের শান্তি প্রিয় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অপরাধীর সাজা না হলে অপরাধ বাড়বে, এটি সহজবোধ্য। ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না-হওয়া তার অন্যতম প্রধান কারণ। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। কারণ ধর্ষণকারী অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ ও প্রভাবের কারণে আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারে।
আমাদের দেশে বহুমাত্রিক অপরাধের সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। ৫ বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিশ্বের বহু দেশে ধর্ষণ সংঘটিত হলেও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার নজির খুব একটা নেই। অথচ আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেহ শিশু ধর্ষণের সংবাদ পাওয়া যায়। এছাড়া ধর্ষণের পর খুন তো আছেই। কারও মনে যৌন লালসা জাগ্রত হলে অনেকে পশুত্ব জেগে উঠেছে বলে থাকেন, যৌন নির্যাতনের মাত্রা বোঝাতে ‘পাশবিক’ শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ধর্ষককে ‘নরপশু’ বলে থাকেন। অথচ প্রাণী জগতের মধ্যে ধর্ষণ শুধু মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। এমনকি শিশুপশুদের প্রতি কোনো যৌন লালসাও পশুদের মধ্যে দেখা যায় না। অথচ এদেশে কী হচ্ছে? পত্রিকার পাতা খুললেই এ ধরণের সংবাদ দেখা যায়। এরা নিশ্চয়ই পশু নয়, কারণ এক্ষেত্রে পশুত্ব মনুষ্যত্বের চেয়ে ঢের উন্নত। মহিলারা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধান করলে ধর্ষণের শিকার হন বলে অনেকে বলতে চান। কিন্তু দেখা যায় অনেক দেশে সংক্ষিপ্ত পোশাক পরলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না। মুসলিম দেশ ছাড়া পাশ্চাত্যসহ এশিয়ার অনেক উন্নত দেশের মেয়েরা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধান করতে অভ্যস্ত। অথচ সেখানে ধর্ষণের ঘটনা তেমন ঘটেই না।
আফ্রিকার কঙ্গো, সোমালিয়া ও সোয়াজিল্যান্ডসহ কয়েকটি গৃহযুদ্ধজনিত কারণে বিধ্বস্ত দেশে ধর্ষনের ঘটনা খুব বেশি। সম্প্রতি সোয়াজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ মহিলাদের স্বল্পবসন বা যৌন উত্তেজক পোশাক পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের প্রণীত নতুন এই আইনে মিনিস্কার্ট, খাটো জিন্স বা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা মেয়েদের আটক করার বিধান রাখা হয়েছে। সাজা হিসেবে কমপক্ষে ছয় মাস জেলে থাকতে হবে।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা অহরহই ঘটছে। ধর্ষণের সংবাদ মিডিয়ায় এলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বার বার আশ্বাস প্রদান করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের কথা শতবার উচ্চারিত হলেও প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আসলে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তাই ধর্মীয় মূল্যবোধকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কঠোর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলে এ সমস্যাটির সমাধান হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।