পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় একদিনের সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকসহ নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তার এই সফরের উদ্দেশ্য, আগামী ২৬ ও ২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করা। নরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য হলেও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে দুই দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের সাথে ভারতের অমিমাংসিত তিস্তাচুক্তি, সীমান্তহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও উঠে আসে। নতুন বিষয় হিসেবে ভারতের তরফ থেকে যুক্ত হয়, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে কার্যকর সংযুক্তির মধ্য দিয়ে ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যত রচনা করা। এর সাথে জাপানকে রাখার প্রস্তাব আছে ভারতের। বাংলাদেশের জন্য জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা তিস্তাচুক্তি ও সীমান্তহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আলোচনায় এলেও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারতের তরফ থেকে সেই পুরনো ও গতানুগতিক বক্তব্যই দেয়া হয়েছে। ভারত যেভাবে আশ্বাস ও দেখব-দেখছি নীতি অবলম্বন করে চলেছে, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধ নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু দুঃখ প্রকাশ এবং তিস্তাচুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে বক্তব্য দিয়েই ভারত দায় সারছে।
গত প্রায় ছয় মাসে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব এবং বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিএসএফ পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার খবরে দেশের মানুষ উৎসুক হয়ে উঠেন। তাদের দৃষ্টি বৈঠকগুলোর দিকে থাকে। আশা করে, তিস্তাচুক্তি, সীমান্তহত্যা এবং ভারসাম্যহীন বাণিজ্যিক সমস্যাসহ বাংলাদেশের দাবীগুলো পূরণে ভারত হয়তো কার্যকর উদ্যোগ নিবে। দেখা যায়, এসব বৈঠক থেকে সংবাদ সম্মেলন বা বিবৃতি দিয়ে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়, তাতে আশ্বাস ছাড়া কোনো উদ্যোগের কথা থাকে না। এস জয়শঙ্করের এবারের সফরেও তাই দেখা গেছে। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের তিস্তাচুক্তি ও সীমান্তহত্যা সম্পর্কে সেই পুরানো কথাই বলেছেন। বরং সীমান্ত হত্যা নিয়ে একধাপ এগিয়ে একে ‘হত্যাকান্ড’ না বলে কৌশলে ‘মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেছেন। এ কথাও বলেছেন, সীমান্ত হত্যা প্রকৃতপক্ষে ভারতের ভূখন্ডে হয়ে থাকে। তার এ কথা থেকে প্রতীয়মাণ হয়, ভারত সীমান্ত হত্যাকে তার আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে গণ্য করছে। প্রকারন্তরে এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ ক্ষীণ করে দেয়া হয়েছে। অথচ সীমান্ত হত্যাকান্ড শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই দেশ একমত হয়ে চুক্তি করেছে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। জয়শঙ্কর যখন বলেন, সীমান্তে মৃত্যু ভারতের ভূখন্ডের অভ্যন্তরে হয়, তখন এ চুক্তির ভিত্তি থাকে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ংকর সীমান্ত হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চিহ্নিত হয়ে আছে। এ সীমান্তে যত হত্যাকান্ড ঘটে বিশ্বের আর কোনো সীমান্তে তা ঘটে না। ভারতের সাথে অন্য যে পাঁচটি দেশ চীন, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না। কেবল বাংলাদেশের সীমান্তেই ভারত ভয়ংকর। এই সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশী খুন হচ্ছে। তিস্তাচুক্তি বিষয়ে এস জয়শঙ্করের বক্তব্যে তার দেশের পুরনো অবস্থানই উঠে এসেছে। আলোচনা চলছে-চলবে বলেই বক্তব্য শেষ করেছেন তিনি। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয়, তিস্তাচুক্তির আশু সুরাহা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পুরো উত্তরাঞ্চলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। খরায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরু অবস্থায় পরিণত হয়। তিস্তা, গঙ্গা-কপোতাক্ষের মতো বৃহৎ সেচ প্রকল্প অকার্যকর হয়ে পড়ে। তিস্তার পানি হাঁটু সমান হয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় এসব অঞ্চলে পানির হাহাকারের চিত্র প্রকাশিত হয়। পানির অভাবে কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে। এক তিস্তাচুক্তি বাস্তবায়িত হলে এসব অঞ্চলে পানির এমন হাহাকার দেখা যেত না। দুঃখের বিষয়, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো বক্তব্য এবং পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এবারের বৈঠকেও বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে নতুন সংযুক্তি বা কানেক্টিভিটির প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। কানেক্টিভিটির আর কি বাকী আছে? কানেক্টিভিটির নামে চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্রবন্দরসহ নৌবন্দর, সড়ক-মহাসড়ক ব্যাবহার করে ভারত তার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে নামমাত্র শুল্কে মালামাল নেয়ার সব দাবীই বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে। পক্ষান্তরে ভুটান, নেপালের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগে সড়ক ব্যবহার করতে দেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো সহযোগিতা করছে না ভারত। এখন আবার সংযুক্তির নামে বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের যে উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে সীমান্তের ওপারে আশ্রিত সন্ত্রাসীদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিচ্ছে, এ অভিযোগ জানানোর পরও ভারত নিশ্চুপ রয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশের যেকোনো পর্যায়ের বৈঠকের আল্টিমেট ফলাফল সম্পর্কে দেশের মানুষ আগে থেকেই জানে। তারা জানে, বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের দাবী-দাওয়ার বিষয়গুলোই উচ্চকিত হয়। বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্য ন্যায্য দাবী আদায়ের বক্তব্য শোনা যায় না। বাংলাদেশের ভাব দেখে মনে হয়, দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, এটাই যেন অনেক কিছু। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সোনালী অধ্যায় ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার থাকছে না। সম্পর্কের নতুন বিশেষণ হিসেবে জয়শঙ্কর ৩৬০ ডিগ্রীর কথা বলেছেন। এর চেয়ে উঁচু সম্পর্ক আর কিছু হতে পারে না। দুই দেশের সম্পর্কের এসব বিশেষণ এখন কথার কথায় পরিণত হয়েছে। ভারতের মনে রাখা উচিৎ, শুধু কথায় চিরা ভিজে না। ভারতের এই একতরফা আচরণ বাংলাদেশের মানুষ দেখতে দেখতে বিরক্ত। তারা এখন আর বন্ধুত্বের কথামালার ফুলঝুরি চায় না। তারা চায়, বাংলাদেশের ন্যায্য দাবীগুলো ভারত পূরণ করুক। এসব দাবী ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশের কাছ থেকে সব স্বার্থ হাসিল করে নেয়ার ফন্দি-ফিকির বন্ধ হোক। আমরা আশা করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আসন্ন বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অথচ উপেক্ষিত বিষয়গুলো নিয়ে অর্থবহ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। এস জয়শঙ্কর তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর কোনো সমস্যা সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে করা উচিৎ। তাঁর এ বক্তব্যের যথার্থতা ভারত অনুধাবন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।