পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের পণ্য ভারতে যাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। এ জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর, নৌপথ ও রাস্তাঘাট ব্যবহার করা হবে। এর নাম দেয়া হয়েছে ট্রানজিট। আসলে এটা ট্রানজিট নয়, করিডোর। এই করিডোর বা তথাকথিত ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে তেমন কিছুই পাবে না। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ধরনের যে ফি বাংলাদেশ পাবে, তাকে অকিঞ্চিতকর বললেও কম বলা হয়। যেমন, প্রতিচালানের জন্য প্রসেসিং ফি পাবে ৩০ টাকা, প্রতিটনে শিপমেন্ট ফি পাবে ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ১০০ টাকা, এসকট ফি ৫০ টাকা, কন্টেইনার স্ক্যান ফি ২৫৪ টাকা, অন্যান্য প্রশাসনিক ফি ১০০ টাকা। এইসঙ্গে ইলেক্ট্রক লক ও সিল ফি’ও আছে। আর সড়কপথ ব্যবহারের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ নির্ধারিত মাশুল আদায় করবে। ফি ও মাসুল শুধু নামকাওয়াস্তেই নয়, এর মধ্যে অস্পষ্টতা ও শুভংকরের ফাঁকি আছে বলেও অভিজ্ঞ মহল মনে করে। তথাকথিত ট্রানজিটের নামে ভারত তার মূল ভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূমি, বন্দর ও রাস্তাঘাট ব্যবহারের আবদার অনেক দিন ধরে করে আসছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতের সরকারগুলো এই ট্রানজিট দেয়াকে সমীচীন মনে করেনি। বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে এই অসম ও একতরফা সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে। ভারতীয় পণ্যের প্রথম ট্রায়াল রান আগেই হয়েছে। আরো ট্রায়াল রানের আয়োজন চলছে। আগামীতে কোনো এক সময় এই ট্রায়াল নিয়মিত রানে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট অভিমত, ‘ট্রানজিটে’ ষোলআনা লাভ ভারতের; একআনা লাভও পাবে না বাংলাদেশ। এমনকি, এ নিয়ে নানারকম খেসারতও তাকে দিতে হতে পারে। বাংলাদেশ হয়ে ভারতের পণ্য ভারতে গেলে ভারতের সময়, দূরত্ব ও খরচ অনেক কমবে। সেক্ষেত্রে ভারতের বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়িত অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যদি ভারত ফি-মাসুল ইত্যাদি বাবদ বাংলাদেশকে দিতো তবে বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতি স্বীকারের আশংকা থেকে অন্তত রেহাই পেতে পারতো। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে এরকম চুক্তি ও ব্যবস্থা অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না।
‘ট্রানজিটে’র আওতায় ভারতীয় পণ্যের নিয়মিত পরিবহন শুরু হলে বন্দর ও রাস্তাঘাটের অবস্থা কী রকম হবে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষক মহল চিন্তিতই শুধু নয়, বিচলিত ও উদ্বিগ্নও বটে। বন্দর ও রাস্তাঘাটের সক্ষমতা এত বেশি নয় যে, দেশের আমদানি-রফতানি ও পরিবহন চাহিদা পূরণ করার পর ভারতীয় পণ্যের জন্য অনুরূপ সুবিধা দেয়া সম্ভবপর হবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর সমান সক্ষম নয়। দেশের আমদানি-রফতানির তিন চতুর্থাংশ সম্পাদিত হয় চট্টগ্রামবন্দরের মাধ্যমে। বাকীটা হয় মোংলা ও অন্যান্য স্থলবন্দরের মাধ্যমে। ভারতীয় পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রামবন্দরকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কারণ, চট্টগ্রামবন্দর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পাওয়া সহজ। বরাবরই এমন কথা বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা পর্যাপ্ত পর্যায়ে না বাড়িয়ে ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া মোটেই সঙ্গত হবে না। দিলে দেশের আমদানি-রফতানি ব্যহত হবে, ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামবন্দরের সক্ষমতা খুব একটা বাড়েনি। অথচ পণ্যের চাপ বেড়েছে। বার্ষিক প্রায় ৩০ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার, সাড়ে ১০ কোটি টন খোলা সাধারণ মালামাল ও ৪ হাজার মার্চেন্ট জাহাজ হ্যান্ডেলিং সামাল দিতে বন্দরের রীতিমত শোচনীয় অবস্থা। কেবল তাই নয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে যে বিশাল অর্থনৈতিক তৎপরতা শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বাড়বে। এমতাবস্থায়, কীভাবে ভারতকে চট্টগ্রামবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া ও অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে? ওদিকে আমাদের রাস্তাঘাটের পরিমান ও সক্ষমতাও বেশি নয়। দেশের পণ্য পরিবহন করতে গিয়েই রাস্তাঘাটের অবস্থা কাহিল। এ অবস্থায় ভারতীয় পণ্য পরিবাহিত হলে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। পরিবহনব্যবস্থা সচল রাখতে হলে রাস্তাঘাট যেমন বাড়ানো ও মজবুত করার দরকার হবে তেমনি নিয়মিত সংস্কার ও মেরামতের প্রয়োজন হবে। এ কাজে বিপুল অর্থের যোগান কে দেবে? আরও একটি ক্ষতি বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্য সেখানে রফতানি হয়। ভারতের পণ্য ভারতে গেলে বাংলাদেশী পণ্য আর সেখানে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ তার পণ্যের একটি বর্ধনশীল বাজার হারাবে।
লোকে বলে, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। আমরা পাগল নই। কিন্তু পাগলের বুঝও আমাদের আছে কিনা, সেটাই প্রশ্ন। ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি, মিত্রতা সম্প্রসারণ ও সহযোগিতার বিকাশ আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু এ জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে হবে, জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে, এটা কখনোই সুবিবেচনার পরিচায়ক হতে পারেনা। লক্ষ্য করা যেতে পারে, ভারত বাংলাদেশের কাছে যা কিছু চেয়েছে, বাংলাদেশ অবলীলায় তা দিয়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের একটি চাহিদাও ভারত পূরণ করেনি। বাংলাদেশ তিস্তার পানি চায়, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা চায়, সীমান্তহত্যার অবসান চায়, অস্ত্র, মাদক ও পণ্যের চোরাচালান বন্ধ চায়, বাণিজ্য অসমতা কমাতে চায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের একটি চাওয়াও পূরণ করেনি। শুধু আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে কালক্ষেপণ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারের তরফে দু’ দেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের উচ্চতা নিয়ে গর্ব করতে দেখা যায়। কিন্তু শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না। অসম সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব টেকসই হতে পারেনা। ‘দেবো আর নেবো, মিলিবো মিলাবো’, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এটাই মূলকথা। যে কেউ লক্ষ্য করে থাকবে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বার্গেইন করার প্রায়ই সকল ইস্যুই খুইয়েছে। ফলে ভারত আর তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। অবস্থা বা পরিস্থিতির এই পটভূমিতে বাংলাদেশকে সচেতন হতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জাতীয় স্বার্থ আদায়ে আপোসহীন ভূমিকায় অবর্তীণ হতে হবে। যেহেতু ‘ট্রানজিটে’র কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ও অন্যান্য দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা প্রবল, সুতরাং ফি-মাশুল অবশ্যই বাড়াতে হবে। ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক ফি-মাশুল বাড়িয়েই তবে ‘ট্রানজিট’ কার্যকর করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।