Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)

| প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৫ এএম

আজ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সমাজসেবক, সাবেক মন্ত্রী এবং দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর দ্বাদশ ইন্তেকাল বার্ষিকী। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে এই মনিষীর জীবনের অবসান ঘটে। আজকের এইদিনে আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি। আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ১৯৩৫ সালে চাঁদপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রপূর্ণ জীবনের অধিকারী দেশের এই কৃতী সন্তান আমত্যু দেশ ও মানুষের খেদমতে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর জীবন পরিসরে তিনি এত কাজ করেছেন, জাতীয় ও জনকল্যাণে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন যে, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তার বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। দেশ ও জনগণ এবং ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধের প্রচার-প্রসার এবং তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস শ্রম-সাধনা, ধ্যান-জ্ঞান, উদ্যোগ, বাস্তবায়ন যেমন মাইলফলক হয়ে রয়েছে, তেমনি অনুসরণীয় হয়ে রয়েছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি দেশ, জাতি, শিক্ষা ও ইসলামের সেবায় অতিবাহিত করেছেন। যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা মহৎ কর্মে, নানা পরিচয়ে তিনি নিজেকে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর করে গেছেন। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মাদরাসার একজন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে জাতির একজন অপরিহার্য শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্র সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, শিক্ষকদের আদর্শ ও অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন মাদরাসা শিক্ষকদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এবং বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলোর সমন্বয়কারী ও শীর্ষ নেতা। ছিলেন দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত দৈনিক ইনকিলাবের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকার মহাখালীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দেশের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্স। তার এসব কীর্তি অবিস্মরণীয় ও অমোচনীয়। তার কীর্তির চেয়েও তিনি ছিলেন মহান।

আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশে আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর অবদান ব্যাপক ও অপরিসীম। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের পদমর্যাদা, নিরাপত্তা ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে শিক্ষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী, আধুনিক এবং এর মান-মর্যাদা বৃদ্ধির যে ক্রমবর্ধমান প্রয়াস চলছে, তা তাঁর দূরদর্শী চিন্তারই ফসল। তাঁর প্রদর্শিত পথরেখা অনুযায়ীই সরকার মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কাজ করে চলেছে। তিনি নিজে যেমন স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানকেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। যে ইসলামী-আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা তার মানস চিন্তারই ফসল। মাদরাসা শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার মূলধারায় নিয়ে আসার একক উদ্যোক্তা এবং পুরধা এই ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব। এ লক্ষ্যে তিনি জমিয়াতুল মোদার্রেছীন পুনর্গঠিত করে আত্মনিবেদিত হন। শুধু তাই নয়, দেশ ও জনগণের কল্যাণের বহুমুখী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, জাতীয় সংস্কৃতি, ইসলাম, মুসলিম বিশ্ব এবং দেশ-জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন মিডিয়া হাউস। এই হাউস থেকে প্রকাশ করেন দেশের জনপ্রিয় দৈনিক ইনকিলাব, আধুনিক ধারার সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ও ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ। পত্রিকাগুলোতে তিনি দেশের খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের সমাবেশ ঘটান। চলমান সময়ে গণমাধ্যমের সংকোচন এবং আত্মনিবেদিত হয়ে কাজ করার অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সংকটের মধ্যেও তার প্রকাশিত জননন্দিত দৈনিক ইনকিলাব দেশ, জাতি ও ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং খেদমতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে দৈনিক ইনকিলাব আপসহীন ও সোচ্চার ভূমিকায় উন্নতশির। বৃটিশ আমলে মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ প্রকাশ করে যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, স্বাধীনতার পর আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে একই দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীন তাঁর আদর্শ ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে দৈনিক ইনকিলাব ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী হয়ে ইসলাম ও রাসুল (স.)-এর আদর্শ প্রচার ও প্রসারে যুগের পর যুগ ধরে যে কাজ করে চলেছেন, এ কাজকে আরো সংগঠিত ও ফলপ্রসূ করার জন্য আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক সহবস্থান বিরাজমান, এক্ষেত্রে তাঁর অনন্য ভূমিকা রয়েছে। দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে তিনি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কীর্তিময় অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা, ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৮৮ সালে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা ও দুর্যোগের সময় তিনি ধর্ম এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেন।

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মতো বিদ্বান, দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও কর্মীপুরুষ বাংলাদেশে খুব বেশি জন্মাননি। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তার মতো সর্বদর্শী ও দেশ-জাতিপ্রেমী মানুষ এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, দেশ সব দিক দিয়েই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজনীতি, ধর্মনীতি, সাংস্কৃতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। সর্বত্র বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপসংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় শাসন-বারণ উপেক্ষিত হচ্ছে। এক অস্থির ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কবলে পড়েছে দেশ। মানুষ হতাশ-দিশাহারা। এ প্রেক্ষিতে, আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মতো বিচক্ষণ, প্রজ্ঞাবান ও কর্মনিষ্ঠ মানুষের খুবই প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁর মতো এমন উদ্যোগী ও উদ্যমী মানুষ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে, আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর কথা আমাদের বিশেষভাবে মনে পড়ছে। জীবদ্দশায় তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে যেভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে গেছেন, তা অনুসরণীয়। তিনি নেই এবং তার অভাব পূরণ হবার নয়। তবে তার আদর্শ ও কর্ম চিরজাগরুক ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজকের এ দিনে আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

 



 

Show all comments
  • রোমান কবির ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৩ এএম says : 0
    রোজ কেয়ামত পর্যন্ত যেন মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাবের এই সিলসিলা জারি থাকে- মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে সেটাই প্রার্থনা করি।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal Pasha Jafree ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৩ এএম says : 0
    সামগ্রিক আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নানকে মাদ্রাসা শিক্ষায় তার চির স্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে পরকালে যথাযথ জাজায়ে খায়ের নসিব করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • Jahangir Alam ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৪ এএম says : 0
    দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ হজরত মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহঃ) যেভাবে এ দেশের ইসলাম, মুসলমান ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন ঠিক একইভাবে তার সুযোগ্য সন্তান এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবেও কাজ করছেন। এজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি, এই পরিবার ও তাদের সকল কর্মকাণ্ডের প্রতি তিনি যেন রহমত ও বরকত দান করেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Ikbal Lst Ikbal ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৪ এএম says : 0
    দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সকল মুসলমানদের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Khorshed Gazi ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ইসলামী চেতনাভিত্তিক ইনকিলাবের ন্যায় পত্রিকার সফলতা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং অপ্রত্যাশিত। মাওলানা আবদুল মান্নান এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। সর্বগ্রাসী হতাশার দিগন্তে ইসলামী চেতনাসম্পন্নদের নিকট মাওলানা আবদুল মান্নান উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন