Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)

ঐক্যের প্রতীক ছিলেন

অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

আলহাজ্ব মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ছিলেন আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ একজন বড় মাপের আলেমেদ্বীন। তাঁর সমসাময়িক ঘনিষ্টজন যারা ছিলেন তারাই অনুধাবন করেছেন তার ইল্ম। সমসাময়িক বিষয়ের উপর ধর্মীয় জ্ঞান, কুরআন, হাদিস ও ফিক্হ শাস্ত্রের আলোকে যেকোন কঠিন বিষয়ে সু ফয়সালা দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা ছিল না। সাথে সাথে হক্কানী আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের প্রতি তাঁর ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।
সকল দল, মত ও চিন্তার উচ্চপর্যায়ের আলেমদের সাথে ছিল তাঁর আন্তরিকতা। দেশ বরেণ্য আলেম-ওলামা তাঁকে একজন মুরুব্বী হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) জীবনের শেষ বছরগুলো বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও মসজিদে গাউছুল আজমেই বেশি সময় কাটাতেন। গভীর রাত পর্যন্ত এখানে উচ্চপর্যায়ের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখসহ অনেকেই আসতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ছারছীনা দরবার শরীফের পীর সাহেব কেবলা মরহুম আবু জাফর মো. ছালেহ (রহ.), চরমোনাই দরবার শরীফের পীর মরহুম ফজলুল করিম (রহ.), ফুলতলী দরবার শরীফের পীর মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.), জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মরহুম মাওলানা ওবায়েদুল হক (রহ.), মাওলানা মুফতি ফজুলল হক আমিনি (রহ.), বিচারপতি আব্দুর রউফসহ বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ। আসতেন দেশের বিখ্যাত মাদরাসাসমূহের অধ্যক্ষ, মুফাসসির, মুহাদ্দীস, মুফতি। তাছাড়া জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দতো সবসময় তাঁর কাছেই থাকার চেষ্টা করতেন, যাদের মধ্যে মরহুম মাওলানা আব্দুস ছালাম বড় হুজুর, মাওলানা আব্দুস ছালাম মাদারীপুরী, মাওলানা আমিন উল্লাহ, মাওলানা হাফেজ আব্দুল জলিল, মাওলানা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী, মাওলানা আজিজুল হক আল কাদেরী, মাওলানা শামছুল হক, মাওলানা আলী হোসাইন, মাওলানা রুকন উদ্দীন, মাওলানা কাজী রইছ উদ্দীন প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য। আলেম ওলামাদাদের কাছে পেলে তিনি খুবই আনন্দিত হতেন। যথাযোগ্যভাবে সকলকে আপ্যায়ন করতেন। তাঁর আপ্যায়ন ছিল মনে রাখার মতো। জীবনে তিনি যাদের মেহমানদারী করিয়েছেন সকলেই তার শুকরিয়া করতেন, কখনো ভুলতেন না তাঁর আতিথেয়তা। আলেম-ওলামাদের কাছে পেলেই তিনি বিভিন্ন মাসয়ালা-মাসায়েল, কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা শানেনুযুল, বিভিন্ন হাদিস শরীফ ইত্যাদি নিয়ে পরস্পর মত বিনিময় করতেন। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী বিশেষ করে অবহেলিত মাদরাসার শিক্ষকদের বেতনভাতাদিসহ অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক ফেডারেশন গঠন করেছিলেন, যেখানে শুধু মাদরাসার শিক্ষকগণই নয় সরকারি-বেসরকারি সাধারণ শিক্ষকগণও ছিলেন। তখন তাঁর কাছে মরহুম অধ্যক্ষ শহিদুল্লাহ, মরহুম প্রফেসর আলি রেজা, মরহুম অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম, মরহুম আমানউল্লাহ, মরহুম অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ, মরহুম আজিজুল শাহ্, মরহুম নুরউল্লাহ, অধ্যক্ষ আজিজুল হক শাহ্, অধ্যক্ষ আসাদুল হক, অধ্যক্ষ কাজি ফারুক আহমেদসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণের যাতায়াত ছিলো। তাদের নিয়ে তিনি বেসরকারি শিক্ষকগণের ন্যায্য দাবি আদায় করেছিলেন। ইসলামি দুনিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশেষ করে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের করণীয় বিষয়ে অকপটে বলতেন। তিনি কথায় ও কাজে কোনো সময়েই আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের খাটো করে দেখতেন না। প্রায়ই তিনি বলতেন, আমি সব সময়ই খুশি হই যখন দেখি আলেম-ওলামাগণ অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছে কিংবা কোনো আলেম সুন্দর একটি বাড়ি করেছেন অথবা একটি গাড়ি কিনেছেন তখন আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। কারণ, আলেমগণ সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র, তাঁরা কখনো কারো মুখাপেক্ষী হতে পারেন না।
মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ছিলেন পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা তথা ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদদের ঐক্যের প্রতীক। তাছাড়া তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ রাজনিতিবিদ। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, ধর্ম মন্ত্রী ও ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি ও বিরোধীদল এসব নিয়ে কোনো সময় ভাবতেন না। তাঁর কাছে যারাই গিয়েছেন কিংবা কোনো বিষয়ে আবেদন করেছেন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সমান তালে সকলের উপকার করতে। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন অবহেলিত মাদরাসা শিক্ষকগণের সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য। কওমী, আলিয়া এসব আলাদা ভাবতেন না। তাঁর হাতেই নিয়োগ পেয়েছিলেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মরহুম মাওলানা ওবায়েদুল হক (রহ.)। অন্যদিকে প্রকৃত আল্লাহ প্রেমিকদের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতেন তিনি। দেশে-বিদেশে যেখানেই গিয়েছেন, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জিয়ারত করতে ভুলতেন না। ব্যস্ততার মাঝেও তিনি হাজির হতেন ওলীগণের মাজারে। আমার সুযোগ হয়েছে মরহুম হুজুরের সাথে দেশে-বিদেশে সফর করার। দেখেছি, প্রকৃত আল্লাহ প্রেমিকদের নমুনা। খুব সম্ভবত ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে জলোচ্ছ্সবা ও ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে বেশ কয়েক ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলসহ তিনি চট্টগ্রামে রওয়ানা হয়েছিলেন। পথিমধ্যে মীরসরায়ে বিখ্যাত সুফি ও মর্দে মুজাহিদ মরহুম নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.) এর মাজার। তিনি ছিলেন সুফি ফতেহ্ আলী (রহ.) এর পীর ও মুর্শিদ (যার অনুসারীরাই আজ বাংলাদেশের অধিকাংশ দরবার ও খানকা পরিচালনা করছেন)। পাকা রাস্তা থেকে অনেকটা কাঁচা এবং সরু রাস্তা দিয়ে যেতে হয়, অন্যদিকে আকাশে ছিল বৃষ্টি ও ঝড়ের লক্ষণ। সফর সঙ্গী সকলেই হুজুরকে অনুরোধ জানালেন এধরনের কাঁচা রাস্তায় না যেতে, কারণ, ততক্ষণে মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হুজুর তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, তিনি বললেন, আমরা যাচ্ছি আল্লাহর ওলীর জিয়ারতে, আমাদের জিম্মাদার অবশ্যই আল্লাহ নিজেই। বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম মহান সুফি নিজামপুরী (রহ.) এর সান্নিধ্যে। মন উজাড় করে সকলেই তাসবিহ্, তাহলিল, কোরআন মাজিদের অংশ বিশেষ তেয়াওয়াত করলেন। হুজুরের সাথে সকলেই দোয়ায় শরিক হলাম। লম্বা মোনাজাত করলেন এবং মোনাজাত শেষে মাগরীবের নামাজ আদায় করে রওয়ানা হলাম মূল রাস্তার দিকে। বৃষ্টি ও ঝড়ে রাস্তা ছিল খুবই খারাপ, মনে হচ্ছিল গাড়িগুলো আর যাবে না। গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালকদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের প্রিয় হুজুর একটুও বিচলিত হলেন না, বরং তিনি এ মহান সুফির জিয়ারত করতে পারায় খুবই আনন্দ উপভোগ করলেন।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তাঁর কাছের এবং প্রিয়জন অনেকেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। রয়েছেন আলহাজ্ব কবি রূহুল আমীন খান, মাওলানা নূর মোহাম্মদ খান (পটুয়াখালী), মাওলানা শামছুদ্দীন (বগুড়া), মাওলানা মো. ছালেহ্ (খুলনা), মাওলানা মো. ইউনুছ, মাওলানা আব্দুল বাতেন (ঢাকা), মাওলানা আব্দুর রহমান বেলাসী (গাজীপুর) সহ হাতে গোনা কয়েক জন। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) আজ পরকালে, সকলেরই যেতে হবে পরপারে। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর অতি শ্রদ্ধারপাত্র ছিলেন এ দেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামাগণ। তিনি সব সময় আলেম-ওলামাগণের উন্নয়নে সচেষ্ট থাকতেন। মাদরাসা শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিসহ অনেক দাবিতেই জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভা সমাবেশগুলোতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবি উপস্থাপন করতেন। অনেক দাবি পূরণ হয়েছে, আরো অনেক দাবি এখনও বাকি আছে। তাঁর ওফাতের পর তাঁরই বড় সন্তান আলহাজ্ব এ. এম. এম. বাহাউদ্দীন আলেম-ওলামাদের অনুরোধে জমিয়াতসহ অন্যান্য দায়িত্ব নিয়ে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বেশ কয়েকবার আলেম-ওলামাদের নিয়ে হাজির হয়েছেন এবং মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু দাবি উপস্থাপন করেছেন, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকতার সাথে শুনেছেন এবং পরবর্তীতে আলেম-ওলামার শতবছরের প্রাণের দাবি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরও অনেক দাবি পূরণ হয়েছে লিখতে গেলে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা লেখা যাবে। মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের কিছু সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, আশা করি, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় সেগুলো অচিরেই পূরণ হবে। আজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি। দেশে লক্ষ লক্ষ আলেম-ওলামা ও মাদরাসার শিক্ষকগণ রয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মাওলানা এম. এ. মান্নান সাহেবের সূচিত কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সাথে সাথে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের মধ্যেকার অনৈক্য ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করা। বিভিন্ন অনইসলামিক ও অসামাজিক কাজ থেকে জাতিকে মুক্ত করে একটি সুন্দর ইসলামী সমাজ কায়েম করা।
আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন আমিন।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)
আরও পড়ুন