কীর্তিতে ভাস্বর তিনি
আজ মাওলানা এম এ মান্নানের ইন্তেকাল দিবস। বিষাদময় এই দিনটি এলেই সর্বত্র তাঁকে নিয়ে বিশেষভাবে
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতারে সম্প্রাচারিত হতো : ওলীআল্লাহর বাংলাদেশ/শহীদ গাজীর বাংলাদেশ/রহম করো, রহম করো, রহম করো আল্লাহ। মূলত বাংলাদেশ পীর আওলিয়ার দেশ, অসংখ্য খানকা দরগাহ, মক্তব-মাদরাসার দেশ, তিন লক্ষাধিক মসজিদের দেশ, এই দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম। হযরত উমর রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহুর খিলাফতের মধ্যভাগে অর্থাৎ ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এখানে ইসলাম প্রচারের ব্যাপকতা ঘটে। তাসাওউফ চর্চার প্রাণকেন্দ্র এই পূতভ‚মিতে শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী সংস্থাপনে বিপ্লবী অবদান রাখেন পীর ও ওলামায়ে কেরাম। আলহাজ্জ মাওলানা এম এ মান্নান এই ধারার একজন মহান পুরুষ ছিলেন। সুফী মননের অধিকারী এই মহান পুরুষ ছিলেন একজন অনন্য সংস্কার সংগঠক এবং শিক্ষাবিদ। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তদানীন্তন চাঁদপুর মহকুমার কেরুয়া গ্রামের এক মশহুর সুফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এখন ঐ জনপদের নান ইসলামপুর। তার আব্বা হুজুর শাহ মুহম্মদ ইয়াসীন ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান আমীরুশ শরীয়ত মাওলানা শাহ্ সুফী আবু বকর সিদ্দিকীর (রহ.)-এর খলীফা। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান লেখকের আব্বাহুজুর আলহাজ্জ মাওলানা শাহ্ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ.)ও ছিলেন মুজাদ্দিদে যামান-এর অন্যতম প্রধান খলীফা। স্বভাবতই মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর সঙ্গে বর্তমান লেখকের রুহানী সম্পর্ক ছিল।
মাওলানা এম এ মান্নান জনদরদী নেতা ছিলেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়নে এবং মাদরাসা শিক্ষকদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রভূত অবদান রেখে গেছেন। জমিয়াতুল মুদার্রেছীন নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে যে ঐক্য সাধন করে গেছেন তা এখনও শিরাধার্যরূপে বিদ্যমান। তিনি গাউসুল আজম মসজিদ কমপ্লেক্স স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে আহলে সুন্নাতুল জামায়াতে সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। ইরাকের মহান প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে বন্যাকালে দুর্গতদের মধ্যে দ্রুত রিলিফ সামগ্রী পৌঁছে দেবার জনা তাঁর চেষ্টায় ইরাক সরকার আটটি হেলিকপ্টার দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য ইনকিলাব নামে একটি জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই দৈনিক জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক জগতে এক নয়া দিগন্তের সূচনা করে, যা আজও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে। মাওলানা এম এ মান্নানের বলিষ্ঠ চেষ্টায় অনেক সংস্কার সাধিত হয়, যেমন- রেডক্রসকে রেড ক্রিসেন্ট করা, মাদরাসার শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত করা, আলেমদের মধ্যে রেষারেষি দূর করা, তাসাওউফ চর্চায় নবদিগন্ত উন্মোচিত করা ইত্যাদি।
মাওলানা এম এ মান্নান সদালাপী ছিলেন। মেহমানদারিতে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তিনি ছিলেন সুবক্তা ও দক্ষ সংগঠক। তিনি ফরিদগঞ্জে শাহ আব্দুল মজিদ মাদরাসায় এক সময় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ছাত্রদেরকে বুখারী শরীফ শিক্ষা দিতেন। শর্ষীনা দারুসসুন্নাত মাদরাসার ব্যাপক সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল। তাঁর উদ্যোগে বেশ কয়কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তিনি তাঁর আত্মজীবনী লেখার উদ্যোগে নিয়েছিলেন, যা মুলফুযাত হিসেবে গণ্য। তিনি কয়েকবার মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ধর্মমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়। তিনি তাঁর সমলোচনার দিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। বরং সমালোচকদের কাছে টেনে নিতেন। ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশর আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন ঢাকার পল্টন ময়দানে।
পাকিস্তান আমলে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণয়নে বিরোধিতা করেছিলেন মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী এবং মাওলানা এম এ মান্নান।
এক সময় মাওলানা এম এ মান্নান ঢাকার বংশাল রোডে হাজী মইনুদ্দীন সাহেবের বাসায় জায়গীর থাকতেন। হাজী মইনুদ্দীন ছিলেন বর্তমান লেখকের আব্বা হুজুর খাস মুরিদ। এখানে লেখকের আব্বা হুজুরের সঙ্গে মাওলানা এম এ মান্নানের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় গেলে মাওলানা এম এ মান্নান সময়-সুযোগ বুঝে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তাঁর বড় ভাই মাওলানা আবদুস সালামও আসতেন। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ রোগভোগের পর এই মহাপুরুষ ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। জাতিয়তাবাদী চেতনা ধারণকারী এই মহান মাওলানা ছিলেন বাংলাদেশের আলেম সমাজের দরদী অভিভাবক। আজও তাঁর কথা স্মরণ করে আলেম সমাজ কাঁদে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানে ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের বিপ্লবী সিপাহি-জনতা ভারতবর্ষের আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছিল। সুবাস বসুর আজাদহীন ফোজের স্লোগান ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ। মাওলানা এম এ মান্নান সে ইনকিলাব ধরে রেখে গেছেন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার মাধ্যমে। এই পত্রিকার ফিচার এডিটর একুশে পদকপ্রাপ্ত এই পত্রিকা বাংলাদেশের পত্রিকার জগতে এক বিপ্লবী ধারার পতাকা ধারণ করে চলেছে।
লেখক : পীরসাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউনন্ডেশন বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।