তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
ইবনে বতুতার মতো মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তাঁর কর্মময় জীবনে অসংখ্য বার বিশ্বের বহু দেশ সফর করলেও তাঁর সফরনামা, এমনকি কোন একটি সফরের বিবরণও তিনি লিপিবদ্ধ করেননি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিদেশ সফরে তাঁর সফর সঙ্গী থাকতেন। তিনি নিজ উদ্যোগে অনেককে হজ্ব ও উমরা করিয়েছেন। বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে বিশাল বিশাল প্রতিনিধি দল তাঁর নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছে, প্রত্যেক সমাবেশ-সম্মেলনে তিনি ভাষণ প্রদান করে দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরেছেন, সুনাম-খ্যাতি বৃদ্ধি করেছেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসে নানা পেশা ও শ্রেণির লোক বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেছেন, যা ছিল অতুলনীয়। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ছিল তাঁর ব্যাপক বিচরণ। এর দ্বারা তিনি ব্যক্তি শোহরত বা সুনাম খ্যাতির পাশাপাশি মুসলিম জাহানে স্বাধীন বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল করেছেন। বিশেষত: মধ্যপ্রচ্যের আরব দেশগুলোর মধ্যে সর্বত্র মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর নাম ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল।
২০০২ সালে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের বাংলাদেশ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব’ নামক গ্রন্থে মুনশী আবদুল মাননান মাওলানা এম এ মান্নান এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রসঙ্গে লিখেছেন: ১৯৬৫ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিশেষ দূত হিসেবে বিশে^র প্রায় সকল মুসলিম দেশ সফর করেন। (পৃ: ৬৩)
এতে জানা যায় যে, মাওলানা এম এ মান্নান জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হওয়ার বহু পূর্বেই রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে মুসলিম বিশ্বে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আরবি ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় তাঁর প্রতি আরবদের দৃষ্টি বিশেষভাবে নিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে এ দেশ সম্বন্ধে বিশেষ মহলের নানা বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তাঁর জমিয়াত সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে যে ভ‚মিকা রাখেন, তা অবিস্মরণীয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষত আরবদের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ দৃঢ়করণে এ ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী।
তৎকালীন পাকিস্তানের বিশেষ দূত হিসেবে মুসলিম বিশে^র প্রায় সকল দেশ সফর করেন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সে কথা আগেই বলা হয়েছে। এদিকে তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ইসলামী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং ঢাকায় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন, যার বিশদ বিবরণ রয়েছে ঢাকা সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল ইয়াকুব শরীফের এক প্রবন্ধে। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘকালীন সেক্রেটারি মাওলানা উবায়দুল হকের (ফেনী) ইন্তেকালের পর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কে উক্ত সংগঠনের সর্ব সম্মতিক্রমে প্রথম সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৬২ সালে রাজনীতিতে পদার্পণ হতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর বিভিন্নমুখী কর্ম তৎপরতা দেশের বাইরে মুসলিম জাহান পর্যন্ত সুপরিচিত করে তুলে। আরবদের সাথে অনর্গল আরবিতে কথা বলতে পারায় তিনি তাদের নিকট অত্যন্ত সম্মানের অধিকারী হন, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের যোগাযোগ সম্পর্ক উন্নয়ন ও জোরদার করার ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নানের গঠনমূলক ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) এর নামে মনোরম স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে রাজধানীর বুকে ‘মসজিদে গাউসুল আজম’ প্রতিষ্ঠা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর এক অনন্য অবদান। এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বিশেষত: ইরাকী মাশায়েখ-উলামা ও নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। এ দৃষ্টিনন্দন বিশাল মসজিদ কায়েম করে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামপ্রিয় মোমেন মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এটি এখন বাংলাদেশের শিক্ষক-ছাত্রসহ মাশায়েখ-উলামা এবং ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যার সংলগ্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের স্থায়ী ‘কমপ্লেক্স’, সেখানে ইসলামের নানা বিষয়ের উপর গবেষণারও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তাই বলা যায়, মসজিদে গাউসুল আজম ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্বেষণের এক অপূর্ব ইয়াদগার হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর স্মৃতিধণ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দন্ডায়মান।
সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আন্তর্জাতি অঙ্গণে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁকে সে সময় ‘দূত পুল’ সদস্য করা হয় এবং বহু মুসলিম দেশে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভায় তাঁকে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সংসদ নির্বাচনে তাঁর নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পুনরায় সদস্য নির্বাচিত হন এবং গঠিত মন্ত্রিসভায় তাঁকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী করা হয় এবং পরে তাঁকে একই সঙ্গে ত্রাণমন্ত্রীও করা হয়। এরপর একসময়ে ইরাকে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ধর্ম ও ত্রাণমন্ত্রী হিসেবে ঔষধসহ নানা প্রকারের মানবিক সাহায্য প্রেরণ করেন। তাঁর গৌরবজ্জ্বল ভ‚মিকার বিশদ বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। শুধু দেশের সর্বত্র ত্রাণ সামগ্রী দ্রæত নিরাপদে বিতরণের জন্য তাঁরই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ইরাক সরকারের কাছ থেকে সাময়িকভাবে ৭টি হেলিকপ্টর আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশেষত: মুসলিম বিশে^ আলহাজ¦ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কত জনপ্রিয় ও সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন, তা বর্ণনাতীত।
১৯৭৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জমিয়াতের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সংগঠন ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং স্মারকপত্র হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে তা প্রকাশ করেন। সে সময় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আরব দূতাবাসগুলোতে তা প্রেরণ করেন, যাতে আরবরা বাংলাদেশ ও জমিয়াত সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। ঢাকাস্থ আরব দূতাবাসগুলোর সাথেও মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর যোগাযোগ সম্পর্ক বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশ করে মাওলানা সাহেব আরব ও আলমে ইসলামীর সম্পর্কে আরো একটি মাত্রা যোগ করেন এবং পত্রিকার মাধ্যমে আরব ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। মাওলানা সাহেব ব্যক্তিগতভাবে এবং তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের ওপর সর্বদা গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়াতও আরব মুসলমানদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে থাকে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) স্বাধীন বাংলাদেশকে আরবদের কাছে পরিচিত করার জন্য ঢাকাস্থ আরব দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জমিয়াতের পক্ষ হতে দাওয়াত করতে থাকেন। সউদি আরব, মিশর, লিবিয়া এবং ইরাক প্রভৃতির নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আবর বিশে^র সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, শ্রমশক্তি রফতানি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বহুমাতৃক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার সাথে সাথে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর সংগঠনের পরিচিতিও আরব বিশ^ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আরব জাহানের নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত বহু ইসলামী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনও আমন্ত্রিত হতে থাকে; এসব সম্মেলন, মহাসম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে বৃহদাকারের বহু প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ হতে যোগদান করেন, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক সময় তাঁর সফরসঙ্গীরা অবাক হয়ে যেতেন, এসব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি বর্গের সাথে মাওলানা এম এ মান্নানের ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করে। তাদের মধ্যে রাষ্ট্র প্রধানসহ সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন অনেকেই থাকতেন। তাঁর সফরসঙ্গী এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, তারাই তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর বহির্বিশে^ এরূপ প্রভাব, মর্যাদাকে রীতিমত বিস্ময়কর বলা যায়।
বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এসব সম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব আরব নেতার ভ্রান্ত ধারণা ছিল, তা নিরসনে সফল হন। তাঁর সফরসঙ্গীদের রচনাবলীতে বিক্ষিপ্ত কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো একত্রিত করলেও জানা যাবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে এবং এদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করতে তাঁর বলিষ্ঠ ভ‚মিকা ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, এখানে আমরা মাওলানা সাহেবের এক সফর সঙ্গীর একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। এ প্রবীণ সফরসঙ্গী দেশের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর বর্তমানে অবসরে আছেন। এ জেড এম শামসুল আলমের কথাই বলছি।
আলহাজ¦ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর প্রথম ইন্তেকাল বার্ষিকী (০৬/০২/২০০৭) উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় ইনকিলাবে ‘মাওলানা এম এ মান্নান’ শিরোনামের লেখায় মাওলানার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে সফর প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি মরক্কো, তিউনিশিয়া, জর্দান এবং তুরস্কে তার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিন সদস্য বিশিষ্ট এই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মাওলানা এম এ মান্নান। তিউনিশিয়ায় পাগড়ি ও দাড়ি প্রসঙ্গে মাওলানা এম এ মান্নানের বক্তব্য শুনে ‘শরীয়া’ কলেজের মুরব্বী ও উস্তাদগণ স্বীকার করলেন, দাড়ি আল্লাহর রসূল (সা.) এর সুন্নত। তারা মাওলানা এম এ মান্নানকে তার বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানান। অতঃপর জর্দানের ‘আম্মান’ গমনের পর যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, লেখক তারও উল্লেখ করেছেন। আম্মান বিমান বন্দরের কথা লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী: ‘জর্দানের আম্মান ইয়ারপোর্টে আমাদের তিন জনের প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দু’জন সরকারি প্রটোকল কর্মকর্তা এসেছিলেন। একজন মাওলানা এম এ মান্নানকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি মুসলিম কি না। মাওলানা এম এ মান্নান প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জর্দানী অফিসারের করা প্রশ্নের জবাব দিলেন। তিনি হাসি মুখে আমাদের জর্দানী অভ্যর্থনাকারীকে বললেন, ‘আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি মুসলিম কিনা! এই প্রশ্নটি আপনার আমাকে জিজ্ঞাসা করা নয়, বরং আমারই আপনাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল।’ সাহেবী পোশাকে সজ্জিত জর্দানী প্রটোকল অফিসার হতচকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন, কেন? আপনার আমাকে এ প্রশ্ন করা কেন যথাযথ হত? কি কারণে সঙ্গত হত?’
মাওলানা এম এ মান্নান তখন জর্দানী অফিসারকে ধীরে ধীরে বললেন; ‘আপনি আপনার চেহারা প্রত্যেক দিন আয়নায় দেখেন, আমার চেহারার দিকে তাকান, আমার মুখে দাড়ি আছে, মাথায় টুপি আছে, আমার চেহারায় আমার নবীর সাহাবীদের ন্যায় সুন্নত আছে। আপনার চেহারায় বর্তমান যুগের ইহুদী ও নাসারা খান্নাসদের ছাপ আছে, আর আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি মুসলিম কি না!’
মাওলানার সফরসঙ্গী এ লেখক আরো উল্লেখ করেছেন: ‘মাওলানার জবাব ও কণ্ঠস্বরে বেচারা ভড়কে গেল, হয়ত ভয়ও পেল, আমরা তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করি কিনা। মাওলানা এম এ মান্নান হাসিমুখে তার পিঠ চাপড়ালেন, আশ^স্থ করলেন। তাকে বললেন, আপনাদের সাথে আমাদের তুলনা হয় না। আপনাদের ধমনীতে কত নবী, সাহাবায়ে কেরামের রক্ত প্রবাহিত।’
শামসুল আলম সাহেব আম্মানে অবস্থানকালের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ব্যক্তিত্ব তথা এদেশের ভাব, মর্যাদার সাথে জড়িত। মাওলানা এম এ মান্নান সে দিন যে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন তা লেখকের বর্ণনায় শোনা যাক। তিনি আম্মানে একটি ডিনার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আম্মানে আমাদের সফরের দ্বিতীয় রজনীতে আমাদের সম্মানার্থে পঁচিশ-ত্রিশ জন লোকের একটি ডিনার পার্টি দেওয়া হয়েছিল। অথিতিদের মধ্যে জর্দানের প্রধান বিচারপতিও ছিলেন। তার উপস্থিতিতে আমরা সম্মানিত অনুভব করলাম। ডিনারের জন্য চেয়ারে বসার আগেই একজন জর্দানী আমাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। হয়ত তিনি দাওয়াত মৌখিক পেয়েছিলেন। আর একজন জর্দানী আরবীতে জবাব দিলেন, মুজিবের দেশের লোক। মুজিব শব্দের সঙ্গে একটি রূঢ় বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন, যা তাদের জন্য স্বাভাবিক এবং আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। চেয়ারে বসার পর আমি সুস্পষ্ট কণ্ঠে মাওলানা এম এ মান্নানকে বললাম, ‘আপনি ঐ যে মুজিবের দেশের লোক, যে অপ্রিয় শব্দটি দুজন তাদের কথা-বার্তায় ব্যবহার করেছিল আমি গালি বা অভিশাপের মতো শব্দটি রিপিট করে সবাইকে জানিয়ে দিলাম।’ মাওলানাকে বললাম, ‘এবার আপনি শান্ত, শিষ্ট এবং কড়া ভাষায় একটু কড়া জবাব দিতে চেষ্টা করুন।’
মাওলানা আমার কথাটি ভুলেননি, তিনি এদিক-সেদিক দু’চার কথা বলে আসল কথায় আসলেন। তিনি বললেন; ‘মুসলিম বিশে^ এ শতাব্দিতে কয়েকটি ফেরাউনের আবির্ভাব হয়েছিল। এ ফেরাউনদের পরিচিতি তিনি একজন করে বয়ান করলেন। তারা হলেন, তাঁর মতে ... প্রমুখ।’ ঐসব নাম ও তাদের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আরব যুবকদের প্রসঙ্গে বলেন; ‘ওরা কারো কারো নমরূদ, ফেরাউনের ন্যায় পূজা করে, যেমন করে কেউ কেউ শয়তানকে।’ এ কড়া জবাব উল্লেখ করার পর লেখক বর্ণনা করেন, ‘এদের তুলনায় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনেক ভালো লোক। তিনি রোজা রাখতেন, নামাজ পড়তেন এবং উলামাদের ইজ্জত করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলাম বিরোধী ছিলেন না।’
অতঃপর আরবগণ তাদের একজনের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর সত্য ভাষণ একদিকে যেমন তাঁর সৎ সাহসের পরিচয় করে, তেমনি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে এমন চিন্তা ভাবনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
তাঁর ইন্তেকালে দেশের উলামা-মাশায়েখ ছাড়াও রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ও সর্বস্তরের লোকের শোকবার্তার পাশাপাশি মুসলিম বিশে^র বহু মুসলিম ব্যক্তিত্বর শোকবাণী তাকে স্মৃতিময় করে রেখেছে। তাঁর ওফাত দিবসে আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।