পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৬০টি পৌরসভার নির্বাচন গত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনিয়ম, সংঘাত, সংঘর্ষ ও খুনের মতো ঘটনা এ নির্বাচনে ঘটেছে। এতসব ঘটনার মধ্যে এ নির্বাচনে আলোচিত হয়েছেন নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভায় নির্বাচিত ক্ষমতাসীন দলের মেয়র ও দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা। নির্বাচনের আগেই সুষ্ঠু ভোট হওয়া এবং ভোটাধিকার হরণ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে তিনি দেশব্যাপী আলোচিত হন। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও তিনি মানুষের ভোটাধিকার নেই এবং সুষ্ঠু ভোট হলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবেন না বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। একের পর এক ভোটের অনিয়ম নিয়ে বক্তব্য দিয়ে তিনি ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনার পাত্রও হন। তার বক্তব্য দেশব্যাপী এতটাই আলোচিত হয় যে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। তিনি এ কথাও বলেছেন, আমার জীবনের ওপর হুমকি এলেও আমি ন্যায্য ও সত্য কথা বলা থেকে বিরত হবো না। অবশেষে তার আপসহীন ও সাহসী অবস্থানের কারণে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েও তিনি বলেছেন, তিনি তার এলাকায় দেয়া প্রতিশ্রæতি পূরণ না করা পর্যন্ত বিজয়ের মালা পড়বেন না।
আবদুল কাদের মির্জা, একটি পৌরসভার ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়ে মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে যে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন, তার মধ্য দিয়ে মূলত দেশের সার্বিক ভোটাধিকারের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। বহু বছর ধরেই দেশে এক ধরনের ভোটাধিকারহীন পরিস্থিতি চলছে। নির্বাচন কমিশন মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে বলে ইতোমধ্যে দেশের বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করেছেন। এ কথা সকলেরই জানা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে এক ধরনের ভোটারবিহীন নির্বাচনের অপসংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌর ও সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নজির স্থাপিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনকে তো বিশ্লেষকরা রাতের আঁধারের নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভোটের দিনের আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। এছাড়া প্রায় সব ধরনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার এবং নিজেদের মধ্যে নিজেদের প্রতিযোগিতা নিয়ে সংঘর্ষ ও মারামারি করে নির্বাচন করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এসব নির্বাচনে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও দলটির প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের পাত্তা থাকছে না। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা মাঠছাড়া করে নির্বাচন করছে। নির্বাচন কেন্দ্রে তাদের কোনো এজেন্ট থাকতে দেয়া হয় না। প্রভাব বিস্তার করে ভোট কেন্দ্র দখল করে নির্বাচন করে। এতসব অভিযোগ করে অনেকে ভোটের দিনই নির্বাচন বর্জন করে। যারা অংশগ্রহণ করে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, এমনকি অনেকের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। দলটির এমন অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন তা নয়। বাস্তবেও পত্র-পত্রিকায় ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার এবং নির্বাচনে জোর-জবরদস্তির খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত না হলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররাও জানে যে তাদের ভোটাধিকার বলে কিছু নেই। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখে তাদের অনেকের ভোট আগেভাগেই দেয়া হয়ে গেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মী ও সমর্থকও ভোট দিতে যায় না। কারণ, তারা জানে ভোট না দিতে গেলেও তাদের প্রার্থীর বিজয় সুনিশ্চিত। ভোটের সার্বিক এই চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। নির্বাচন নামকাওয়াস্তে, লোক দেখানো এবং ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ বা নিজেদের মধ্যকার নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ব্যবস্থা স্বৈর শাসনে দেখা গেলেও গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
গণতান্ত্রিক সরকারের সময় নির্বাচনে কিছু ত্রæটি-বিচ্যুতি দেখা গেলেও একেবারে ভোটারবিহীন ও একচেটিয়া নির্বাচন খুব কমই দেখা যায়। ত্রæটি-বিচ্যুতি বা কারচুপি হলেও দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি এবং এ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামও হতো। ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এক মাগুরার নির্বাচন কারচুপি হওয়া নিয়ে কী তোলপাড়ই না হয়েছিল। বিতর্কিত এই একটি আসনের উপনির্বাচন বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও ভূমিকা রাখে। অথচ জাতীয় নির্বাচনসহ বিগত প্রায় এক দশক ধরে অহরহই হচ্ছে। এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করলেও তাতে সরকার কর্ণপাত করছে না। বরং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হচ্ছে বলে বক্তব্য দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এই যে ধাপে ধাপে পৌর মেয়র নির্বাচন হচ্ছে, এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রাধান্য এবং বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করাসহ অনিয়ম, সহিংসতা ও খুনোখুনি হচ্ছে, তাতেও ক্ষমতাসীন দল সন্তোষ প্রকাশ করছে। নির্বাচন কমিশনও নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে বলে বক্তব্য দিচ্ছে। যদিও একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বরাবরই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে পুরো নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কিছু যায় আসছে না। একজন কমিশনারের বক্তব্যকে তারা আমলেই নিচ্ছে না। অথচ এই একজন কমিশনারের বক্তব্যের মধ্যেই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সচেতন মহলের মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। এ মতামতকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন থোড়াই কেয়ার করছে। তারা মনে করছে, যেভাবে যতটুকু নির্বাচন হচ্ছে, তাই যথেষ্ট এবং এতেই সন্তুষ্ট। তাদের এই সন্তুষ্টি দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকারকে কোন প্রান্তে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলা। আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোটাধিকারকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক অবস্থায় ফিরে আসবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এভাবেই কি দেশে নির্বাচন হতে থাকবে? ক্ষমতাসীন দল ও তার অনুগত নির্বাচন কমিশন যতই বলুক, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে, তা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য হলেও তারা ভাল করেই জানে এটা কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা নয়। তারা যেভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা সাজিয়েছে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না। এখন হয়তো তারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতার জোরে এ নির্বাচনী ব্যবস্থা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে যখন তারা ক্ষমতায় থাকবে না, তখন কি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার দায় তাদের উপর বর্তাবে না? কোনো দেশের সরকারই চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না। কোনো না কোনো সময় তাকে বিদায় নিতে হয়। যে সরকার গণতন্ত্র মনস্ক এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তার পরাজয় হলেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে পারে। যারা যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতার জোরে থাকে, তাদের বিদায় সুখকর হয় না। হয় অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনার মাধ্যমে তৃতীয় শক্তির দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়, না হয় জনআন্দোলনের মুখে নাস্তানাবুদ হয়ে বিদায় নিতে হয়। আমাদের দেশে এমন নজির রয়েছে। এরশাদ সরকার নয় বছর ক্ষমতায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার বিদায় সুখকর হয়নি। তেমনি গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে ওয়ান ইলেভেনের মতো সরকারও দেশে গঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকার যে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন, কোনো এক সময় যদি তাকে বিদায় নিতে হয়, তা কীভাবে হয়, তাই এখন দেখার বিষয়। কারণ হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জাও নির্বাচিত হওয়ার আগে এসব অপ্রীতিকর কথা বলেছেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন পৌর মেয়র যখন নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন তা সরকারের জন্য যতই বিব্রতকর হোক না কেন, তা জনমনে সৃষ্ট ধারণারই প্রতিফলন এবং তা অস্বীকার করারও উপায় নেই।
দেশে বহু বছর ধরে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী, তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বরং একটি অসুষ্ঠু ও জবরদস্তিমূলক নির্বাচনী অপসংস্কৃতির রূপ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থার অবসান কবে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবহ না করে এবং তাতে হস্তক্ষেপ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যত ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা নেয়া।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।