Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্রের শত্রুরা জাতিগত-রাজনৈতিক বিভাজন ও সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের দোসর

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

বিদায় লগ্নে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন গণতন্ত্র, সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার ভিত্তিটাকে ভেঙ্গে দিয়ে চোরাপথে ক্ষমতায় টিকে থাকার এক ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী ভূমিকায় নেমেছেন। তার এই অবস্থান নতুন কিছু নয়। গত ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনের বহু আগে থেকেই ট্রাম্প নির্বাচনের রায়কে যেনতেন প্রকারে নিজের পক্ষে নেয়া, হেরে গেলে রায় না মেনে নেয়া এবং হোয়াইট হাউজ না ছাড়ার একটা প্রচ্ছন্ন ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে গণমাধ্যমে একটা জল্পনা ও আলোচনা চলে আসছিল, ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়তে না চাইলে কি কি করতে পারেন, কি কি ঘটতে পারে। মার্কিন প্রশাসন, নিরাপত্তারক্ষী ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি হতে পারে ইত্যকার বিষয়গুলো বেশ কয়েকমাস ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে। অবশেষে সব আশঙ্কা ছাপিয়ে মার্কিন ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনাটি সংঘটিত করলেন জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের দেশে দেশে নির্বাচন, ক্ষমতার পালাবদলে, রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভিন্নমত দমনে এরচেয়ে অনেক বেশি ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রায়শ ঘটে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন্ধনে। ইম্পেরিয়াল মনোপলি রক্ষার জন্য শত বছর ধরে বিশ্বের দেশে নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করা বা রিজিম চেঞ্জ’র এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী রাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এসব অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের কোনোটাই ধামাচাপা পড়েনি। কর্পোরেট পুঁজিবাদ প্রভাবিত গণমাধ্যমের মগজধোলাই প্রপাগান্ডা সত্তেও কোনো ঘটনাই মানুষের মনমগজ থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। পঞ্চাশের দশকে ইরান-গুয়াতেমালায় নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুতুল সরকার বসানোর কারসাজি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে বলিভিয়া-ভেনেজুয়েলার নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেখানে রিজিম চেঞ্জের ক্যুদেতা পর্যন্ত কোনো ঘটনাই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। শত বছর ধরে বিশ্বের দেশে দেশে এমন সব ঘটনা ঘটালেও মার্কিন গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। মার্কিন পুঁজিবাদি গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে একটি কাইনেসিয়ান যুদ্ধবাদী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে তা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন এক আত্মঘাতী রূপ ধারণ করে চলেছে। ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ ফলাফল অত:পর রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগের মধ্য দিয়ে তার ভঙ্গুর দুর্বল কাঠামো অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। তবে মার্কিন জনগণের বৃহত্তর অংশ এখনো তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পক্ষেই রয়েছে। এ কারণেই ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ট্রাম্পের বিদ্রোহের ইন্ধন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের স্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ফ্যাসিবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যাত হল। তবে গত কিছুদিনের নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে অনেকটা বুঝা যাচ্ছে, আমেরিকান ডিপ স্টেট এখনো ক্যাপিটল হিল দখলের সাথে জড়িত বিদ্রোহীদের পক্ষেই তাদের পরোক্ষ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে।

আমেরিকান গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে নির্বিঘেœ তার সাংবিধানিক স্বচ্ছতা এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ ট্রানজিশন নিশ্চিত রাখতে সক্ষম হলেও সেই আমেরিকান সিভিল ওয়ারের যুগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অব্যাহক রেখেছে। ঊনবিংশ শতকের একেবারে শুরুতে ১৮১১ সালে স্পেনিশ উপনিবেশ থেকে চিলির স্বাধীনতালাভের পর থেকেই সেখানে বার বার মার্কিন হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে মেক্সিকোর সাথে যুদ্ধ করে টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়ার উপর দখলদারিত্ব কায়েম করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত করা, বিশেষত স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধের পর সাবেক স্পেনিশ কলোনিয়াল রাষ্ট্র গুয়াম, পুয়ের্তিরিকো, ফিলিপাইন এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করে। কলোনিয়াল ও পোস্ট কলোনিয়াল যুগে সেটা খুব সাধারণ ঘটনা হলেও বিংশ শতকে পর পর দুইটি মহাযুদ্ধ পেরিয়ে এসে বিশ্ব সভ্যতা যখন মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছিল, তখন থেকে বিশ্বের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর মার্কিন হস্তক্ষেপ ও রিজিম চেঞ্জের এজেন্ডা বড় ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইরান, সিরিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এসব দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা আজকের বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে জনগণের উপর শাহের ডিকটেরশিপ চাপিয়ে দেয়া মার্কিন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, প্রশাসক ও নীতি নির্ধারকরা যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণœ রাখতে দৃঢ়সঙ্কল্প হলেও উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে যারা মার্কিন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিল, মূলত তাদের উপরই বশংবদ শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে নয়া বিশ্বব্যাবস্থার পুঁজিবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ভূ-রাজনৈতিক কলা-কৌশল জারি রেখেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই অন্ধকার দিকগুলো সম্পর্কে মার্কিন সাহিত্যিক দার্শনিকরা নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ও হেনরি নামে পরিচিত (উইলিয়াম সিডনি পর্টার) মার্কিন ফিকশন লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘বানানা রিপাবলিক’ নামে এক নতুন শব্দ সংযোজন করে গেছেন। হন্ডুরাসের উপর মার্কিন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পেছনে মার্কিন সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতার বিষয়টিকে ও হেনরি তুলে ধরেছিলেন। বিংশ শতকের শুরুতে হন্ডুরাসের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ইউরাইটেড ফ্রুট কোম্পানির প্রত্যক্ষ তৎপরতা এবং মার্কিন সরকারের নেপথ্য সমর্থনের চিত্র বেরিয়ে আসে। মূলত কলাচাষ ও কলা রফতানির সাথে জড়িত কোম্পানিগুলো কিভাবে ল্যাটিন ও ক্যারিবিয়া অঞ্চলের ক্ষুদ্র দেশগুলোর ভূমি, অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তারই প্রেক্ষাপটে এসব দেশ বানানা রিপাবলিক নামে অভিহিত হওয়ার সংজ্ঞা লাভ করে।

শত বছর ধরে বর্হিবিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ম্যানিপুলেশনের শিকার হচ্ছে। মার্কিন সংবিধানের রক্ষক, নীতি নির্ধারক ও রাষ্ট্রচিন্তকরা এ ধারাকে অনেকটা নীরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তার আত্মঘাতী প্রবণতার শিকার হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হাজার হাজার মানুষ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নেমে আসা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দেয়। তবে ট্রাম্পের ডেমোক্রেট দলীয় প্রতিদ্বন্দী অথবা সিটিং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিক্ষুব্ধ জনতার এসব অগণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার প্রতি সমর্থন না দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে অবিচল ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় টার্মে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বড় ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কাজটি করেছেন তা মার্কিন ইতিহাসে সত্যিই নজিরবিহীন। গত বছরের ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোট চুরির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের কোর্টে অর্ধশতাধিক মামলা করেছিলেন। কোনো মামলায়ই তিনি নিজের অনুকূলে রায় আদায় করতে পারেননি। কয়েকটি রাজ্যে স্থানীয় রিপাবলিকান এবং গভর্নরদের ফলাফল পাল্টে দিতে ট্রাম্পের নির্দেশনা ব্যর্থ হয়ে গেলে ক্ষমতা হস্তান্তর ঠেকাতে তার হাতে শেষ যে অস্ত্রটি ছিল তা হচ্ছে সোশ্যাল আনরেস্ট ও গণবিদ্রোহ। ৫ জানুয়ারীতে মার্কিন রাজধানীর ক্যাপিটল হিলে যে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দেখা গেছে, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেপথ্য ভূমিকায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বহুবার ঘটেছে, এখনো ঘটছে। দেশে দেশে এমন সব ঘটনা ঘটালেও নিজ দেশে যুক্তরাষ্ট্র যেন ধোয়া তুলসি পাতা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবার তা নিজ দেশে সংঘটিত করে মার্কির্নিদের বুঝিয়ে দিলেন দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তারা কিভাবে নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত বা রিজিম চেঞ্জ করেছেন। জানুয়ারীর ৫ তারিখ মার্কিন ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের হাজার হাজার সমর্থক সমবেত হওয়ার আগে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী মোটিভেশ, উস্কানি ও নির্দেশনা ট্রাম্প নিজেই দিয়েছেন। কংগ্রেস ও সিনেটের ভেতরে ঢুকে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে সারাবিশ্বের কাছে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঐতিহ্যকে ভুলুন্ঠিত করার পর ওয়াশিংটন পোস্টের পিনপোস্ট শিরোনাম ছিল ‘ডেমোক্রেসি ডাইজ ইন ডার্কনেস’। কিন্তু শত বছর ধরে মার্কিন সমর্থিত উস্কানি, ষড়যন্ত্র, ক্যুদেতা এবং বিশৃঙ্খলায় বিশ্বের দেশে দেশে শত শত কোটি মানুষের রায়, স্বপ্ন ও প্রত্যাশার অপমৃত্যু ঘটানো হয়েছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট গণমাধ্যম সামরিক বাহিনী এবং সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির প্রেসক্রিপশনে মতলবি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসেছে।

পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাকে ঊনবিংশ শতকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন (অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল এন্ড ফর দ্য পিপল) জনগনের জন্য, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার বলে অভিহিত করেছিলেন। বিশ্বের উপর মার্কিন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তা একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তি ও লক্ষ্য শুধুমাত্র পুঁজি লুণ্ঠনের উপর নিবদ্ধ হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পশ্চিমা কর্পোরেট স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার সুফল থেকে জনগণ বঞ্চিত হতে শুরু করে। পশ্চিমাদের দ্বারা প্রভাবিত, বশংবদ ব্যক্তিদের ক্ষমতায় বসিয়ে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের অবাধ সুযোগ সৃষ্টির নাম গণতন্ত্র হতে পারেনা। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের জিইসিভুক্ত তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে লুন্ঠনব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে নিজেদের অনুকূলে রাখতে সেখানকার রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও নিরাপত্তা দিয়ে নিরঙ্কুশ রাখা হচ্ছে। জাতিগত ও আঞ্চলিক বিরোধ ও ধর্মীয় মতভেদ উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক লেভেল এঁটে, কখনো দেশ দখল, বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের মিথ্যা প্রচারণা অথবা জাতিগত সংঘাতে ইন্ধন যুগিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্থিতিশীলতা ব্যহত করে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির সামরিক ফর্মুলা যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমানিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলের আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদী হুমকি ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে কোনে আঞ্চলিক সংঘাত, ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস বা সামরিক প্রতিযোগিতা না থাকলেও সেখানে একটি কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা হুমকি সৃষ্টি করে দেশ দখল ও হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য করার পন্থা গ্রহণ করেছে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মুনাফাবাজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ- স্টেট। সেই রাষ্ট্রাতিক শক্তি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নির্বাচন ব্যবস্থার ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন করে তোলার তৎপরতা দেখাচ্ছে। ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে গণতন্ত্র বিরোধী গণবিদ্রোহ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের উস্কানি তারই বাস্তব প্রতিফলন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের শুধু অভিসংশন নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, মার্কিন গণতন্ত্রের ঐতিহ্যের উপর কালিমা লেপনের জন্য তাঁকে অবশ্যই উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার দৃষ্টান্ত রাখা প্রয়োজন।

স্পেনিশ ইনভেডার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরাধিকার সূত্রে গড়ে ওঠা মার্কিন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে দেশে দেশে বানানা রিপাবলিক গড়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশিত হওয়ার আগেই মার্কিন দার্শনিক-রাজনীতিবিদ রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসন মার্কিন মানসের আত্মার সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন। সিভিল ওয়ারের সময় দেশব্যাপী ভ্রমণ ও বক্তৃতা করে এমারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের আদর্শিক ভিত্তি নির্মানের কথা বলেছিলেন। ১৮৪১ সালে প্রকাশিত তার একটি বক্তৃতা সিরিজের শিরোনাম ছিল ‘দ্য ওভার সওল’। মার্কিন আত্মার অনুসন্ধান, সংরক্ষণ, মানুষে মানুষে সমমর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানের মধ্যদিয়ে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এমারসন। এমারসনের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তি মার্কিন শিল্লী সাহিত্যিকরা তাদের রচনায় মার্কিন মানসচেতনার একটি স্পিরিট তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতায় সে প্রতিফলন দেখা গেছে। এমারসনের স্বপ্নের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম ব্যক্তিটি সম্ভবত ১৮৬১ সালে নির্বাচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বমানবতার যে শত্রæরা আব্রাহাম লিঙ্কনকে বাঁচতে দেয়নি, তাদের উত্তরসুরিরা এখন ক্যাপিটল হিল দখল করে মার্কিন গণতন্ত্রের উপর কালিমা লেপন করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভবিষ্যতকে আস্তাকুঁড়ে অথবা অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। যে শক্তি দিল্লীতে রায়ট বাঁধিয়ে ভারতের গণতন্ত্র ও মানবিক সহাবস্থানের নিরাপত্তাকে পদদলিত করতে চায়, যে শক্তি কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন ও বিশেষ মর্যাদা ভূলুন্ঠিত করে ভারতের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অনিরাপদ নাগরিকে পরিণত করতে চায়, তারাই মার্কিন অস্বেতাঙ্গ, আফ্রো-আমেরিকান, এশীয়, হিস্পানিক ও মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণবাদের হিং¯্রতার মধ্যে ঠেলে দিতে চায়। ৫ জানুয়ারি মার্কিন ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ ও আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে মার্কিন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার স্পর্ধা দেখিয়েছে। এদের প্রেতাত্মা ও সুবিধাভোগী দোসররা বিশ্বের সব প্রান্তে সব দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদেরকে জনগণের কাছে চিহ্নিত ও পরিত্যাজ্য করে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য ও শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে এখন সরাসরি গ্রাস করতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিথ্যা প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট, ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ইত্যাদি শ্লোগান তুলে মূলত শে^তাঙ্গদের একচেটিয়া সমর্থন নিজের পক্ষে রাখার নামে আমেরিকাকে বিভাজিত করার চেষ্টা করেছেন। এটি জায়নবাদী ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। ভারতীয় উপমহাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠিকে বিভাজিত করতেও হিন্দুত্ববাদিরা একই ফর্মূলা প্রয়োগ করছে। সমাজে বৈষম্য বাড়িয়ে, সম্পদ লুন্ঠনের পথ প্রশ্বস্ত করে টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। ক্যাপিটল হিল দখলের নেপথ্য নায়ক ট্রাম্প ধরা পড়ে গেছেন। এখন তাকে মার্কিন আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল কর্তব্য। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ একটি সংঘাতময় অনিশ্চিত অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই ‘গুজরাটের কসাই’ নামে খ্যাত নরেন্দ্র মোদি ও তার হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করা এ উপমহাদেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের বড় দায়িত্ব। বর্ণবাদ, শ্রেষ্ঠত্ববাদ, সন্ত্রাস ও বিভাজনের রাজনীতিকে দৃঢ়ভাবে ‘না’ বলতে না পারলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দাসত্ব ও শৃঙ্খলিত অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। যারা শত শত বছর ধরে আমাদের ঔপনিবেশিকতার শেকলে আবদ্ধ রেখেছিল, তারা আমাদের সমাজ মানসের স্বরূপটি ধরতে পেরেছিল। ভারত-বাংলাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগের শেষ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টিন চার্চিল ১৯৩৮ সালে দেয়া এক রেডিও ভাষণে বলেছিলেন, ‘পিপল অব এশিয়া ওয়ের স্লেইভস, বিকজ দে হ্যাড নট লার্নড হাউ টু প্রোনাউন্স দ্য ওয়ার্ড ‘নো’। এই কমেন্টের সার কথা হচ্ছে, এশিয়ার জনগণ যথা সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তিকে ‘না’ বলতে পারেনি বলেই তাদেরকে দাসত্ব বরণ করতে হয়েছিল।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন