পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আধিপত্যের জন্য বিশ্বজুড়ে কৌশলগত ও গোপন আদর্শিক লড়াই চলছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি, প্রতিবেশিনীতি এবং শিক্ষানীতির মধ্যে জাতিসত্তার প্রাচীন ঐতিহ্য ও নিজস্ব ধ্যান ধারণাকে নিজেদের ইচ্ছামত কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রকরা। তবে ইসলামের রাষ্ট্রদর্শণ এবং মদিনা সনদের শাস্ত্রীয় ভিত্তিকে নিজ ইচ্ছামত পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে বিশ্বের শীর্ষশক্তি আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান, তুরস্ক এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নানামুখী দ্বন্দ্ব ও ঠান্ডা প্রতিযোগিতা সক্রিয় রয়েছে। দেশগুলো যার যার অবস্থান থেকে কৌশলগত শত্রুমিত্র নির্বাচন করে নিজেদের নিরাপত্তা, হুমকি মোকাবেলা এবং শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে সাংস্কৃতিব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনের পরাশক্তি হওয়ার দৌড় শুরু হলেও প্রাচীন ইতিহাসে বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের অবস্থান অতি উচ্চ। সেই সাড়ে তিন হাজার বছর আগের চীনা সিল্করুট এখন চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ তথা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কানেক্টিভিটির অন্যতম মহাপরিকল্পনা। আর কমিউনিস্ট চীনের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও সমর নীতিতে রয়েছে প্রাচীন মরমী দার্শনিক লাওজি, কনফুসিয়াস এবং সানজুর প্রভাব। নব্বই দশকের শুরুতে ইরাকের কুয়েত আক্রমণকে পুঁজি করে আমেরিকা যখন ইরাক দখলের সামরিক অভিযান শুরু করে তখন শোনা যাচ্ছিল, যুদ্ধমান মার্কিন সেনাবাহিনী এবং ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনী প্রাচীন চীনের সমর বিশারদ সান জুর যুদ্ধনীতি অনুসরণ করছে। তখন দেশে দেশে গণমাধ্যমে সানজুর যুদ্ধনীতি বা ‘আর্ট অব ওয়ার’ নিয়ে বেশ আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রমানিত হল, আধুনিক বিশ্ব তার সামরিক কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করতে প্রাচীন চীনা দার্শনিকদের নীতিকেই বেছে নিয়েছিল। শান্তির সময় যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধের সময় শান্তির প্রস্তুতি সানচুর যুদ্ধনীতির অন্যতম ভিত্তি বলে গণ্য করা হয়। সেই সাথে একজন দক্ষ সেনানায়কককে রাষ্ট্রের অন্যতম পিলার বলে গণ্য করা হয় ‘আর্ট অব ওয়ার’ গ্রন্থে।
একবিংশ শতকের এসে যুদ্ধের সংজ্ঞা ও কলা-কৌশল অনেকটাই বদলে গেছে। বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে রাষ্ট্রীয় ভূ-খন্ড দখল এখন আর যুদ্ধের মূল লক্ষ্য নয়। এককেন্দ্রিক পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সামর্থ্য, সম্ভাবনা ও নীতি কৌশলগুলো নিজেদের আয়ত্তে ও নিয়ন্ত্রণে রাখাই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, বোমা, কামান, ট্যাঙ্ক ও সমরাস্ত্রই যুদ্ধের হাতিয়ার নয়। রাষ্ট্রের গণমানুষের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনা, বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক প্রত্যাশা ও অঙ্গিকার এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি, শৃঙ্খলা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বার্থ ও হস্তক্ষেপের যে কোনো আশঙ্কা এখন অনিয়মিত যুদ্ধের অন্যতম কৌশলগত বিষয়। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো তাদের পেরিফেরি, হিন্টারল্যান্ড বা সোর্স কান্ট্রিগুলোর উপর আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক কৌশল বাস্তবায়নে গণমাধ্যম, গণপ্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার উপর প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। আমরা যদি প্রাচীন চীনা দার্শনিক-সমরবিদদের দশর্ন ও নীতিমালাকেই গ্রহণ করে যুদ্ধজয়ের কৌশল অবলম্বন করি, তাহলে প্রথমেই আমরা পরাশক্তিগুলোর মধ্যে চীনকে এগিয়ে রাখছি। চীনা দার্শনিকদের শিক্ষা আয়ত্তের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে চীনারা এগিয়ে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। জনসংখ্যা ও মানব সম্পদের ডেমোগ্রাফিক অবস্থান, বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিবেচনায় চলমান পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার কৌশলগত লক্ষ্য আবর্তিত হচ্ছে মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে। সাবেক আমলে ঠান্ডা লড়াইয়ের মূল পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখন দক্ষিণ এশিয়ার চীন ও ভারতকে ঘিরে একটি উত্তেজনাকর ও উত্তপ্ত আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে। শতকোটি মানুষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের পাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ততোধিক জনসংখ্যার কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের পাশে রাশিয়া এখন নতুন ঠান্ডা লড়াইয়ের মূল কুশীলবে পরিনত হয়েছে। এদেরকে ঘিরে আছে ইরান, তুরস্ক, কোরিয়া, জাপানসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে যারাই প্রতিবেশীদেরকে আস্থায় রাখতে পারবে, বিশেষ সময়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাশে পাবে আগামী বিশ্বের সামরিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্ব তাদের হাতেই থাকবে।
ঔপনিবেশোত্তর বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের পুরনো কৌশল মার খেয়েছে বলেই প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যবস্থা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এখন কোনো প্রশ্নবিদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের সরকার তার রাজনৈতিক সহযোগিতার নিরীখে প্রতিবেশী দেশের সরকার বা সরকারি দলের সাথে আঁতাত বা চুক্তিকে দেশের সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখে না। গণতন্ত্র যদি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণধর্মী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়, তাহলে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি বলতে বোঝায় জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক ও সামাজিক-রাজনৈতিক মেলবন্ধনের ঊর্বর ক্ষেত্র। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও কূটনৈতিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় পিপল টু পিপল রিলেশন। প্রতিবেশীদের সাথে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষপাতশূন্য, বিশ্বাসযোগ্য, আস্থাপূর্ণ ও স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে পিপল টু পিপল সম্পর্ক ও যোগাযোগ সম্ভব হয় না। কোনো প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান সমরাভিযান ছাড়াই একটি পুরো দেশ দখল করে নিতে হলে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়েই আস্থায় নিতে হয়। আড়াই হাজার বছর আগে চীনা সমরবিদ সান জু তার আর্ট অব ওয়ার গ্রন্থে এ কথা লিখে গেছেন। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে বা তার কিছু পরে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক পন্ডিত ও সমাজতত্ত্ববিদ চানক্য ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যেসব নীতি কৌশলের কথা বলে গেছেন, সেখানে অনেক ভাল কথা ও সৎ পরামর্শ থাকলেও ভারতীয় রাজনীতিকরা চানক্যের নেতিবাচক ও দ্ব্যর্থবোধক কৌশলগুলোকেই প্রতিপালন ও বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিবেশী নীতিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-চীনের মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারতের অতি নিকটতম প্রতিবেশীরাও তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রকারান্তরে চীনের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। তাদের অনসৃত চানক্যনীতি অনুসরণে প্রতিবেশীদের সম্পদ লুন্ঠন ও বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নিতে পারলেও বিপদের সময় তারা কাউকে পাশে পাচ্ছে না। একপাক্ষিক স্বার্থ হাসিলে প্রতিবেশীদের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নিরসনে প্রায় সবাইকে ‘না’ বলার নীতি এখন ভারতের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠেছে। চীন, পাকিস্তান তো বটেই, নিকটতম প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল এমনকি ভুটান পর্যন্ত বিপদের সময় ভারতকে আঙুল তুলে কথা বলতে ছাড়ছে না।
চানক্য পন্ডিত ব্যক্তির বিকাশ, সাফল্য ও সমৃদ্ধির জ্ঞান, বিদ্যা, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কূটচাল, স্বার্থপরতা এবং প্রতিবেশীদের উপর সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণের যে ফর্মুলা তিনি দেখিয়েছেন ভারতীয় রাজনীতিকরা সেসব নেতিবাচক নীতিগুলোকেই তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অনুসরণ করছেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এই নীতিকে সামনে রেখে প্রতিবেশীদের সাথে আস্থাপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি তার অভিষেক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কথায় তো আর চিড়া ভিজে না, আস্থাপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে যে ছাড় দিতে হয়, প্রতিবেশীদের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো নিয়ে রাজনৈতিক চাতুরতা ও একদেশদর্শিতা পরিহার করতে হয়। সেটা তারা বরাবরই ভুলে যান। ফলে যা হবার তাই ঘটে চলেছে। ছোটবড় কোনো প্রতিবেশীর সাথেই আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি ভারত। চীনের সাথে লাদাখ সীমান্তে টানাপোড়েনের মধ্যে ক্ষুদ্র প্রতিবেশি ভুটান এবং কালাপানি সীমান্ত নিয়ে নেপালের হঠাৎ শক্ত অবস্থান নেয়া এবং কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চলকে নেপালের রাজনৈতিক মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করার পরও ভারত কোনো শক্ত জবাব দিতে পারেনি। এর কারণ নেপাল বা ভুটানের সাথে চীনের সীমান্ত এবং এসব দেশের প্রতি চীনের আস্থাপূর্ণ সহযোগিতামূলক মনোভাব। এ থেকে ভারতসহ বিশ্বশক্তিগুলো তাদের প্রতিবেশী নীতি ও ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সাথে আচরণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। সত্তুর বছরেও ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশ কিউবাকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বা করায়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিউবান জনগণের বিপুল সমর্থনপুষ্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো আদর্শিক অভিজ্ঞ ও যোগ্য নেতা থাকলেই জাতীয় ঐক্য ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশ যত বড় বা শক্তিশালী হোক না কেন, জাতীয় ঐক্য ও জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া শক্তি অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রশক্তিহীন দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয়, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ উস্কে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে পপুলিস্ট রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করলে সে জাতি ভেতর থেকে দুর্বল হবেই। প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলো সে দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করবে। ভারতের দুর্বলতার সুযোগে চীন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনৈক্য ও ও দুর্বলতার সুযোগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার বেপরোয়া মনোভাব দেখানোর সাহস পাচ্ছে।
চীন-ভারত যখন সান জু এবং চানক্য নীতির উপর ভর করে নিজেদের যুদ্ধ কৌশল ও পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করছে, তখন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখনো মেকিয়াভেলির দর্শনকে ভিত্তি করেই তাদের বিদেশ নীতি সাজাচ্ছে। তবে আমরা যদি প্রশ্ন করি, ইউরোপীয় রেঁনেসার অগ্রদূত বলে কথিত মেকিয়াভেলির দার্শনিক গুরু কে বা তিনি কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? এর নানা রকম জবাব আসতে পারে। প্রথম ম্যাকিয়াভেলিবাদের বৈষয়িক-অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা ও দ্বিচারিতার নীতিকে আধুনিক কৌটিল্যবাদ বা চানক্যনীতি বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকারের ধারণা, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক এনলাইটেনমেন্টে ম্যাকিয়াভেলিসহ তার সমকালীন ইউরোপীয় দার্শনিক শিল্পীদের লেখা ও শিল্পকর্মে উঠে এসেছে অনেকাংশেই আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অন্যতম পুরোধা পন্ডিত ইবনে খালদুনকেই তাদের গুরু বলে স্বীকার করতে হয়। ইতালীয় দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির জন্মের প্রায় দেড়শ বছর আগে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে ১৩২৩ সালে ইবনে খালদুন জন্মগ্রহন করেন। আর ম্যাকিয়াভেলির জন্ম ১৪৬৯ সালে ফ্লোরেন্সে। ইবনে খালদুনের লেখা আল মুকাদ্দিমা যে কোনো বিচারে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রচিন্তা ও অর্থনৈতিক দর্শনের আকর গ্রন্থ। ইবনে খালদুন মূলত ইতিহাসের গবেষণা, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তার সাথে রাজনৈতিক সংগঠনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশের পথ সম্পর্কে লিখেছেন। তার সাথে ধর্মীয় চিন্তাধারাগত মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তবে ম্যাকিয়াভেলি বা চানক্যের নীতির খারাপ দিকগুলোর মত খালদুনের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিন্তায় তেমন দ্বিচারিতা বা ফাঁক-ফোঁকর নেই। ইতিহাস লেখা, গবেষণা ও সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে জনগণের কল্যাণকর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের ইবনে খালদুনের নির্দেশনাগুলো মানতে হবে। বিশেষত যুগে যুগে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসকে নিজেদের ইচ্ছামত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মিথ্যা কল্প-কাহিনী সৃষ্টি করা হয় তাতে ইতিহাসের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করে। আল মুকাদ্দিমার শুরুতেই ইতিহাস রচনা ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ইবনে খালদুন ৭টি ভ্রান্তির পথ পরিহারের নির্দেশ করেছেন। এগুলো হচ্ছে, নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা মতবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, তথ্যের উৎস সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝার ব্যর্থতা,সত্য সম্পর্কে ভুল বিশ্বাস , কোনো ঘটনাকে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপণের অক্ষমতা, উচ্চ পদস্থ বা রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা করে তাদের আনুকুল্য লাভের চেষ্টা, এবং মানব সমাজের অগ্রগতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা। আজকের ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা এবং ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদেরকে ইবনে খালদুন কথিত এসব ভ্রান্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে জাতিগত ও রাজনৈতিক বিভেদ সমাজ ও রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।
চীন-ভারত বিরোধ এবং ভারতের প্রতিবেশী নীতি পুরো উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ডাইমেনশন সৃষ্টি করেছে। ইবনে খালদুন ইতিহাস লেখা ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে সব অজ্ঞতা ও পক্ষপাতমূলক বিষয়কে পরিহারের কথা বলেছেন। এখনকার রাষ্ট্র পরিচালকরা সে সব পরিত্যাজ্য বিষয়গুলোকে শুধু ইতিহাসেই নয় রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছেন। এখন ইতিহাসবিদরাই শুধু নয়, এমনকি সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি নির্দিষ্ট ধর্ম ও রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ পক্ষপাতমূলক অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে বিরোধি সব পক্ষকে এন্টাগনিজমের ফর্মুলায় ফেলে নির্মূল বা নিস্ক্রিয় করতে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করছে। হিটলারীয় কায়দায় রাষ্ট্র, সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার পার্থক্য ঘুঁচিয়ে দিয়ে সবকিছু একাকার করে দিতে চাওয়া অনেক বড় আত্মঘাতী ও বিপর্যয়কর বর্বরনীতি বলে গণ্য হতে পারে। ভারতের জাতীয় রাজনীতি এখন যে পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে বিগত হাজার বছরেও তা হয়নি। বিদেশি ও ঔপনিবেশিক শাসকরা যদি এমন পক্ষপাত করতেন, তবে ভারত কখনোই ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করতে পারত কিনা সন্দেহ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় সংস্কৃতি গবেষক-ইহুদি পন্ডিত শেলডন পোলক বলেছেন, মুসলমান শাসকরা যদি চাইতেন, আটশ’ বছরে ভারতে একজনও হিন্দু থাকতো না। তারা বরং ভারতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিচর্যা ও উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। প্রায় একহাজার বছর মুসলমান ও ইংরেজদের দ্বারা ভারত শাসিত হয়েছে।
বৃটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রোল’ নীতির কথা বাদ দিলে এ সময়ে দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও বিকাশে রাজশক্তি কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিভক্ত ও খন্ডিত ভারত শাসনের ভার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে পড়ার ৭০ বছরের মধ্যেই ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ চরমভাবে দূষিত ও অনিরাপদ হয়ে গেছে। এখন তারা কোনো একক দেশে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠি ভারতীয় মুসলমানদেরকে নির্মূল, রাষ্ট্রহীন অথবা দুর্বল দ্বিতীয় শ্রেণীর সিটিজেনে পরিনত করার ষড়যন্ত্রমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। নিজ দেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ভারত তার ভ্রান্ত নীতি প্রয়োগ করে চলেছে। তারা ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে’ ভরে যে রাজনৈতিক বাণিজ্য করার চেষ্টা করছে তা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে উঠতে বাধ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী দ্বিপাক্ষিক কয়েকটি ইস্যুতে যে মতামত দিয়েছেন, তা সত্যিই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ড বন্ধে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিসহ শীর্ষ ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে এ সম্পর্কের কথা বলেছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামে গিয়ে রাষ্ট্রদূত দোরাইস্বামী সীমান্ত হত্যাকান্ড সম্পর্কে ভারতের আগের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রী পিছনে গিয়ে বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষিরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয় বলে সর্বৈব মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। এই মন্তব্যের কয়েক দিনের মাথায় ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস পরিদর্শনে গিয়ে দোরাইস্বামী নাকি বলেছেন, আওয়ামীলীগে যদি তাদের বন্ধু না থাকে তবে বাংলাদেশে তাদের কোনো বন্ধু নেই। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের, জনগণের সাথে জগগণের সম্পর্কের সম্ভাবনাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার এই রাষ্ট্রনীতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ভবিষ্যতে কোথায় নিয়ে যাবে, তা ভেবে দেখতে হবে। প্রতিবেশিদের সাথে সমস্যা জিইয়ে রেখে এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়া যায়না। এটা ভারতীয় নেতা ও কূটনীতিকদের বুঝতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।