Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রুখতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার মানুষের রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। কোটি কোটি অসুস্থ মানুষের রোগ নিরাময়ে তা যে ধন্বন্তরি অবদান রেখেছে, এ একটি ধ্রুব সত্য। পাশাপাশি আরেকটি সত্য হলো, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার মানব জাতির জন্য ইতিমধ্যে হুমকি হয়ে উঠেছে। যেসব দেশ এ হুমকির সামনের কাতারে বাংলাদেশ তার একটি। উন্নত দেশে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রির সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশে এটি অবারিত। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেয়ে নিজেই দোকান থেকে ওষুধ কিনে চিকিৎসা চালান এমন লোকের সংখ্যা এ দেশে অসংখ্য। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠেছে। স্বল্পোন্নত অনেক দেশেই রয়েছে অভিন্ন সমস্যা।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার কী ধরনের বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করছে তা ফুটে উঠেছে বৈশ্বিক প্ল্যাটফরম ‘ওয়ান হেলথ গ্লোবাল লিডার্স গ্রুপ অন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স’-এর যাত্রার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কো-চেয়ারের ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষ ও প্রাণীর জন্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরিণামদর্শী খাদ্য উৎপাদন আমাদের বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে; যা বিদ্যমান কভিড-১৯ মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিতে পারে। যুগের পর যুগ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অর্জিত সাফল্য ম্লান করে দিতে পারে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, ভুল ডোজ এবং সার্বিকভাবে দুর্বল সংক্রমণ প্রতিরোধব্যবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমল হেলথের উদ্যোগে গঠিত বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।

অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার মানবজীবনের জন্য এক পরম আশীর্বাদ। রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। রোগচিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার রোগীকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু পাশাপাশি এর অপব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকিরও বড় কারণ। বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা প্রবল। ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ফার্মেসি থেকে প্রায় সব ধরনের ওষুধ কেনা যায় সহজে। আবার চিকিৎসকদেরও অনেকেই রোগ নিরাময়ে যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শপত্র দিয়ে থাকেন। ফলে দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য তা অন্যতম প্রধান হুমকি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার পেছনে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং ওষুধবিক্রেতা ও ক্রেতার অসাবধানতা বড় ভূমিকা রাখছে। যেসব এ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে, সেগুলোর অনেক এ্যান্টিবায়োটিক আজ জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাবধানী না হলে খুব শীঘ্রই মানবজাতি জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাণরক্ষার যুদ্ধে পরাস্ত হবে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ-তে থাকা রোগীদের একটি বড় অংশের মৃত্যুর পেছনে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দায়ী, যাদেরকে এই ক্ষমতার জন্য ‘সুপারবাগ’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, এক দশক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি ব্যাকটেরিয়া ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।

দ্য টেলিগ্রাফের ‘সুপারবাগস লিঙ্কড টু এইট আউট অব টেন ডেথস ইন বাংলাদেশ আইসিইউ’স’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ৮০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগ দায়ী। বিষয়টি অত্যন্ত আতঙ্কজনক এক বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি শরীর প্রতিরোধ গড়ে তুললে সে অবস্থাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। এই প্রবণতার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াতে পারে এক কোটিতে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, পশুখাদ্য, মাছ এবং কৃষিতে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিতে, যা দেশে ব্যবহৃত মোট অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় অর্ধেক। ফলে খুব সহজেই কৃষিখাদ্যের মধ্য দিয়ে এই অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে ঢুকছে। এতে একদিকে যেমন অ্যান্টিবায়াটিকের কার্যকারিতা হারাচ্ছে, তেমনি শরীরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে সামান্য জীবাণুু সংক্রমণও এখন ব্যবহারকারীর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য যে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে তা উদ্বেগজনক। এই চিত্রের অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে জাতিকে এর চরম খেসারত দিতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশে যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের যে প্রবণতা রয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রুখতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি এক্ষেত্রে দ্রুত সুফল এনে দিতে পারে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আরকে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধ ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অ্যান্টিবায়োটিক


আরও
আরও পড়ুন