পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৩ নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের গোয়ার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমেরিকায় জনগণের ভোটাধিকারের শক্তি এবং গণতন্ত্রের বিজয় সমন্নুত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ নিয়ে অ্যাকাডেমিক বিতর্কের সুযোগ এবং মার্কিন গণতন্ত্রের কাঠামোগত ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও মার্কিন গণতন্ত্রের বাহ্যিক স্বচ্ছতা এখনো অটুট রয়েছে বলেই প্রবল প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তার কোনো চেষ্টাই কাজে লাগেনি। জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই একটি জল্পনা দানা বেঁধেছিল, নির্বাচনে হেরে গেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সহজে হোয়াইট হাউজ ছাড়বেন কিনা। অতীতে আর কখনো মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়া এবং হোয়াইট হাউজ ছাড়ার প্রশ্নে এমন সন্দেহের উদ্ভব হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। গণমাধ্যমে যখন এ নিয়ে প্রশ্ন এবং বিতর্ক চলছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প তা অপনোদন করেননি। তিনি বলেননি, নির্বাচনের ফলাফল তার বিপক্ষে গেলেও তিনি তা মেনে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এ প্রশ্নে তার নীরবতাই সব জল্পনার ডালপালা বাড়িয়েছে। মার্কিন নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের নিয়মাবলী বাস্তবায়িত হয় সেখানকার ব্যুরোক্রেটিক সিস্টেমের মধ্যে। এই সিস্টেম অনেকটাই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে হোয়াইট হাউজের স্টাফ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদেই রাজনৈতিকভাবে প্রেসিডেন্ট তার বিশ্বস্ত ও পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাই করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে তিনি তার প্রত্যাশিত সুযোগ পাননি। আদালতে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েও কোনো আদালতে একটি অভিযোগেও নিজের পক্ষে রায় আদায় করতে পারেননি। এমনকি কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের গর্ভনরদের তিনি সরাসরি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তনের খায়েশ প্রকাশ করে বার্তা দিয়েও কোনো সুফল পাননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে ক্ষমতায় আকড়ে থাকার এমন নজির আর কখনো দেখা যায়নি।
নির্বাচনের আড়াই মাস পর আগামী ২০ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বা ট্রানজিশন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে দেড় মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ডোনাল্প ট্রাম্প এখনো নির্বাচনের হার (কনসিড) স্বীকার করেননি। ২০ জানুয়ারী ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করবেন কিনা, তা নিয়ে এখনো দ্বিধাদ্ব›েদ্ব রয়েছেন হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা। গত ১৮ ডিসেম্বর একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন অ্যাডভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ছাড়তে এখনো প্রস্তুত নন। রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ইতিমধ্যে জো বাইডেনের বিজয় মেনে নিয়ে তার্ক অভিনন্দিত করেছেন। নিজ দলের ভেতর ট্রাম্প ক্রমে একা হয়ে পড়লেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক অভূতপূর্ব গোয়ার্তুমির ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে পপুলার ভোটে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্র্থী হিলারি ক্লিন্টন থেকে লাখ লাখ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া এবং অনলাইন হ্যাকিংসহ ইলেকশন ম্যানিপুলেশনের দৃশ্যমান অভিযোগ সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসার পরও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বা হিলারি ক্লিন্টন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। এখন পপুলার ও ইলেক্টোরাল ভোটে অনেক বড় ব্যাবধানে হেরে যাওয়ার পর বিভিন্ন আদালতে নির্বাচনী কারচুপি ও জালিয়াতির কোনো তথ্যপ্রমান ছাড়াই তিনি অভিযোগ দায়ের করে মামলায় হেরে যাওয়ার পরও ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ না ছাড়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। ট্রাম্পের মত ব্যক্তির মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং চার বছর ধরে বিশ্বকে একপ্রকার সার্কাস দেখানোর পর নির্বাচনে হেরে নতুন তামাশার জন্ম দেয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর নৈতিক অবক্ষয় ও অধ:পতনের করাল ছায়া প্রক্ষিপ্ত করেছেন।
পশ্চিমা আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা হয়েও গত শতাব্দীর শুরু থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক গোয়েন্দা কার্যক্রম বিস্তার করে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই তাদের আধপত্যবাদী জাল বিস্তার করেছে সেসব দেশের মধ্যে যেখানে ভেতরে জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিরোধ করে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব তৈরী হয়েছে, সেখানেই একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি-রাষ্ট্র গড়ে উঠতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া, ইরান. কিউবা এবং ভিয়েতনাম উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের রাজনৈতিক বিভক্তির জেরে ইউরোপে জার্মানী, এশিয়ায় কোরিয়া দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে দুই জার্মানী একীভূত হলেও মার্কিন প্রভাব ও হস্তক্ষেপে দুই কোরিয়া এখনো শত্রæতা-বৈরীতা জারি রেখেছে। একইভাবে মার্কিন প্রভাবে জাপান এখনো অনেকটা সেটেলাইট সেটেলমেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিকভাবে যত উন্নত ও শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের পরনির্ভর উন্নয়ন অত্যন্ত ক্ষণভঙ্গুর ও দুর্বল। অন্যদিকে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ কোরিয়ার আস্ফালন উত্তর কোরিয়াকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রত্যয় শিখিয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে জাপানী ইম্পেরিয়াল শক্তির অধীনে থাকা কোরিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্যে ফিরে যেতে চেয়েছিল। উত্তর কোরিয়ান নেতা কিম ইল সুং একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুই কোরিয়ার সব বিভেদ মিটিয়ে একীভূত করার যে উদ্যোগ চল্লিশের দশকের শেষ দিকে গ্রহণ করেছিলেন তাতে সম্ভবত দক্ষিণ কোরিয়ান নেতাদের কোনো দ্বিমত ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বুঝতে পারল, কোরিয়ায় নির্বাচন হলে কিম বিজয়ী হবে এবং সেখানে বামপন্থীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, অতএব নির্বাচন ভন্ডুল করে দিতে হবে। সিআইএ নির্বাচন হতে দেয়নি, উপরন্তু কোরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আঞ্চলিক যুদ্ধের ইতিহাসে এক ভয়ংকর গণহত্যা ও ট্রাজেডির জন্ম দেয়া হয়। সে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। বিশ্বযুদ্ধে প্রথম পারমানবিক বোমা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যত বিশ্বব্যবস্থায় নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের আওতায় একটি অন্তহীন যুদ্ধের রূপরেখা নির্ধারণ করেছিল। সেখানে নতুন নতুন বিদ্ধংসী সমরাস্ত্র উদ্ভাবন এবং উৎপাদনের মাধ্যমে সামরিক প্রযুক্তি অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে ইম্পেরিয়াল পাওয়ার ধরে রাখাকেই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সৈন্যরা সরাসরি কোরীয় যুদ্ধে নেমে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নতুন সমর প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্রগুলো উত্তর কোরিয়ার জনগণের উপর পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়ে সেগুলো প্রয়োগ করে। কোরীয় যুদ্ধে কয়েক বছর ধরে অত্যাধুনিক কনভেনশানাল সমরাস্ত্রের পাশাপাশি রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা হলেও শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ও কৌশলগত পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সম্প্রসারণ ঠেকাতে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে ¯œায়ুযুদ্ধের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যা কিছু করণীয় তার সবই করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপে গণতন্ত্রের বদলে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও স্থায়ী বৈরীতা চাপিয়ে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই ঘটনা ঘটেছিল ভিয়েতনামে। মার্কিন গোয়েন্দারা জানতো, সেখানে নির্বাচন হলে হো চি মিনের দল শতকরা ৮০ ভাগ ভোটে নির্বাচিত হত। অতএব নির্বাচনের বদলে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়াকেই তারা নিজেদের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করেছিল। প্রায় দুই দশকের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ফলাফল হচ্ছে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিনীদের চূড়ান্ত সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয়। এর আগে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ইরাণে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ইঙ্গ-মার্কিন গোয়েন্দা ষড়যন্ত্রে ক্যু’র মাধ্যমে বরখাস্ত করে সেখানে পশ্চিমা তাবেদার শাহের শাসন পুণ:প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোরিয়া, ইরান এবং ভিয়েতনামের গণতন্ত্র প্রায় একইভাবে মার্কিন হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এসব দেশে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ কোনো কাজ করেনি। বিশেষত: উত্তর কোরিয়া এবং ইরান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভিত্তি গড়ে তুলেছে। উত্তর কোরিয়ার সার্বভৌম অস্তিত্বকে হুমকির মুখে রাখতে স্নায়ুযুদ্ধকালে কোরীয় উপদ্বীপে দেড়শতাধিক পারমানবিক ওয়ারহেড প্রস্তুত রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই পারমানবিক হুমকি মোকাবেলায় উত্তর কোরিয়া সোভিয়েত সমর্থন নিয়ে নিজস্ব পারমানবিক অস্ত্র প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সেই প্রকল্প এখন মার্কিনীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বার বার সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দিয়েও তার অস্ত্র কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি মার্কিনীরা। গত অক্টোবরে নর্থ কোরিয়ার ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে সামরিক বাহিনী যে মহাদেশীয় পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রদর্শণ করে তা আমেরিকার মূল ভূ-খণ্ডের যে কোনো প্রান্তে আঘাত হানতে সক্ষম। নাকের ডগায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের প্রভাব এবং মার্কিন ঘাটিতে থাকা শতাধিক পারমানবিক বোমা এবং ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলা করেই উত্তর কোরিয়া তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পারমানবিক সক্ষমতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও অব্যাহত হুমকি মোকাবেলা করেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান শিক্ষা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামরিক শক্তি হিসেবে সবচেয়ে অগ্রসর শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও সক্রিয় হুমকি না থাকলে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন এবং মানবাধিকার সংরক্ষণসহ প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এসব দেশ নি:সন্দেহে আরো বহুদূর অগ্রসর হতে পারত।
জাতীয় ঐক্য, জনগণের সংহতি, দৃঢ় ও সঠিক নেতৃত্ব এবং শত্রæ-মিত্র চিনে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারলে যে কোনো জাতি আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক যে কোনো পরাশক্তিকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারে। উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও ইরান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সত্তুর বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির সব ধরণের অপপ্রচার, অবরোধ ও বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম সামরিক পরাশক্তিতে পরিনত হয়েছে। এশিয়া পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন পশ্চিমা রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ এ বি আব্রামস। গত বছর প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থ ‘পাওয়ার অ্যান্ড প্রাইমেসি’তে সে ইতিহাসের বিশদ বিবরণ ও ফিরিস্তি উঠে এসেছে। ক্লারিটি প্রেস থেকে এ বছর প্রকাশিত এ বি আব্রামস’র নতুন গ্রন্থের নাম ‘ইমমোরেবল অবজেক্ট:নর্থ কোরিয়া’স সেভেনটি ইয়ার্স অ্যাট ওয়ার উইথ আমেরিকান পাওয়ার। এই গ্রন্থে যে বিষয়টি পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে পরিষ্কার হয়েছে তা হল, এতদিন ধরে উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যম যে ধারণা তুলে ধরেছে তা সর্বৈভ ভ্রান্ত ও মিথ্যা। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকার ওর্য়াল্ড অর্ডার ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের নিরীখে প্রচারিত প্রপাগান্ডার মূল টার্গেট হল দেশে দেশে নিজেদের অনুগত শাসকশ্রেণী গড়ে তোলা এবং সেখানে গণতন্ত্রায়ণের যে কোনো সম্ভাবনা সমূলে নির্মূল করা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে পশ্চিমা বশংবদ রাজপরিবারগুলোকে সমর্থন দেয়া এবং জনগণের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার দমনে পশ্চিমারাই মূল ভূমিকা পালন করছে। ইরানে গণতন্ত্র ধ্বংস করে রেজা শাহ পাহলভিকে ক্ষমতার সর্বেসর্বায় পরিনত করার পর থেকেই সেখানে পশ্চিমা বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল বলেই ইমাম খামেনির নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের কাছ থেকে বাকি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রশক্তি এবং পশ্চিমা ও এশিয়ার আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে, প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান্তরাল ও সমান বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটি যেমন পদার্থবিদ্যার ডায়ন্যামিক্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, একইভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। সাড়ে সাত দশক ধরে ইঙ্গ-মার্কিনীদের সব রকম প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়েও জবরদখল করে গড়ে তোলা ইসরাইল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি, অন্যদিকে কোরিয়া এবং ইরান শুরু থেকেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তোপের মুখে থেকেও এশিয়ার অন্যতম সামরিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ইরান ও কোরিয়ায় যে ধরণের সরকার ব্যবস্থা চালু আছে তা নিয়ে হয়তো আমাদের দ্বিমত থাকতে পারে, তবে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা সে সব দেশের জনগণের। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া রিজিম অথবা সামরিক শক্তি বলে রিজিম চেঞ্জ করে কোনো দেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। জনগণের সম্পদ লুন্ঠন অব্যাহত রাখতে হলে প্রথমে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের অধিকার হরণ করতে হয়। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ এখন গণতন্ত্রহীন, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধানের নামে হাইব্রিড গণতন্ত্র চর্চা চলছে, তার প্রতিটির পেছনেই কোনো না কোনো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। কোরীয় যুদ্ধে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত খন্ডিত উত্তর কোরিয়া যেমন আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের প্রতিরক্ষাকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ কি তার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শত্রæ-মিত্র চিনতে পারছে? এ ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। বাংলাদেশের স্থায়ী কোনো শত্রু-মিত্র নেই। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে যারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে যারাই সামরিক শাসন ও হাইব্রীড রিজিমকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে তারাই আমাদের জনগণের মূল প্রতিপক্ষ।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।