পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আইরেসের তিগ্রে এলাকায় নিজের বাড়িতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল লিজেন্ড দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা। গত ২৫ নভেম্বরে মাত্র ৬০ বছরেই জীবনাবসান ঘটে তার। এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার ব্রেনে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ায় একটি সার্জারি হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে বিশ্রাম ও চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ঘটে গেলো বিয়োগান্তক ঘটনা। অভিযোগ করা হচ্ছে, বুয়েন্স আইরেসের টিগ্রেতে বাসায় হার্ট অ্যাটাক করার পর যথাযথ জরুরি চিকিৎসা পাননি ম্যারাডোনা। এমনকি হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পেতেও অনেক সময় ক্ষেপন হয়েছে বলে ম্যারাডোনার ঘনিষ্ট বন্ধু ও ব্যক্তিগত আইনজীবী অভিযোগ করেছেন। তিনি পুরো বিষয়টির একটি সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি করেছেন। ম্যারাডোনার আইনজীবী বন্ধুর এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে ম্যারাডোনার মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসকের অবহেলা অথবা কোনো বড় শক্তির হাত থাকতে পারে। ল্যাটিন আমেরিকার(দক্ষিণ আমেরিকা) দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা অ্যাংলো আমেরিকার(উত্তর আমেরিকা) দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। সেই স্পেনিশ ও বৃটিশ ঔপনিবেশোত্তর যুগে আমেরিকা অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির যে আকাঙ্খা জেগে উঠেছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের মত ল্যাটিন আমেরিকারও ফাউন্ডিং ফাদার রয়েছে। ভুলে যাওয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চলমান সমাজবাস্তবতায় সাইমন বলিভারের সেই স্বপ্ন এখন আর কেউ উচ্চারণ করতেও সাহস পাননা। তবে কোনো মহৎ স্বপ্ন ও রাজনৈতিক কর্মতৎরতা একটি নির্দ্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নি:শেষিত হয়ে যায় না। ম্যারাডোনার বিশ্বজোড়া আকাশচুম্বি খ্যাতি, জনপ্রিয়তার ধারবাহিক উত্তরণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও ভ’মিকা থেকে ল্যাটিন আমেরিকা এবং অ্যাংলো আমেরিকার ঐতিহাসিক বিভেদ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টার কথাই যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
উত্তর আমেরিকায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে হটিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের আগেই দাসপ্রথাসহ কিছু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে সুস্পষ্ট মতপার্থক্যের প্রেক্ষাপটে ইউনিয়নিস্ট ও কনফেডারেটদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধে ইউনিয়নিস্টদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মিত হওয়ার দুই দশকের মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকায় ভেনিজুয়েলার সেনানায়ক সাইমন বলিভারের নেতৃত্বে স্পেনিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। ভেনিজুয়েলার দক্ষ সেনানায়ক সাইমন বলিভারের সাহসী ও সুযোগ্য নেতৃত্বে একে একে ভেনিজুয়েলা, পেরু, কলাম্বিয়া, বলিভিয়া ও ইকুয়েডরের স্বাধীনতা লাভ করে। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ জা জ্যাক রুশো, জন লক, টমাস হবস , ভল্টেয়ার এবং মন্টেস্কুর মত রাষ্ট ও সমাজবজ্ঞিানীদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন সায়মান বলিভার। স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতার দীর্ঘ জাল, নিষ্ঠুর দমনপীড়ন এবং স্বদেশী ক্ষমতাধরদের গোপন আঁতাতের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একেকটি দেশ স্বাধীন করে দক্ষিণ আমেরিকায় একটি বৃহত্তর কনফেডারেশন বা ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সাইমন বলিভার। সেই থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিই সাইমন বলিভারের স্বপ্নের দক্ষিণ আমেরিকা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রো থেকে হুগো শ্যাভেজ, ভেনিজুয়েলার মাদুরো বা মেক্সিকোর আন্দ্রেস লোপেজকে ঘিরে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে তা’ দুই আমেরিকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও বিভক্তিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় প্রত্যেক রাজনীতিক, অ্যাকাডেমিশিয়ান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এর দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কলাম্বিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক গার্সিয়া মার্কেজ থেকে শুরু করে ম্যারাডোনা বা লুইস সুয়ারেজ পর্যন্ত এই ভেদবুদ্ধির শিকার হয়েছেন। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই তার বঞ্চনার ঘটনা বা ইতিহাসের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বচ্ছ ভূমিকার একটি চিত্র উঠে আসা স্বাভাবিক। বলতে গেলে ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের দু’টি খেলায় অংশগ্রহণের পর ডোপ টেস্টে ব্যর্থ হয়ে ম্যারাডোনাকে বিদায় নিতে হয়। যদিও ম্যারাডোনা কোনো মাদক গ্রহণ করেননি, তিনি একটি নাসাল ড্রপ ব্যবহার করেছিলেন আর সেই ড্রপের ক্যামিকেল রি-অ্যাকশন ডোপটেস্টে ধরা পড়ার কারণেই তিনি নিষিদ্ধ হন। তবে সেই ডোপটেস্টের ছুঁতোয় প্রায় সারাজীবনই ম্যারাডোনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হওয়ার মত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বার বার চেষ্টা করেও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাননি।
মার্কিন সংবিধান নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রেসিডেন্টসহ সরকারের সমালোচনা করার স্বাধীনতা দিয়েছে। এ কথা মানতেই হবে যে, কোনো দেশের সরকার এবং রাষ্ট্র সমার্থক নয়। ল্যাটিন আমেরিকার নেতারা সব সময়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির তুখোড় বিরোধী। জর্জ বুশ বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত আগ্রাসনপ্রিয় ও বর্ণবাদী শাসকদের সমালোচনা করা মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাধিতা নয়। দিয়েগো ম্যারাডোনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তীব্র সমালোচক ছিলেন। আর এ কারণেই তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাননি। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই যখন ট্রাম্প নাগরিকদের তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন ,সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন পুতুল শাসক বলে প্রতিপন্ন করার কারণে ম্যারাডোনার ভিসা আটকে দেয়া হয়েছে। এমনকি তার মৃত্যুর পর একটা কনডোলেন্স টুইট পর্যন্ত করেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ম্যারাডোনার স্থলে ম্যাডোনার মৃত্যু সংবাদে ট্রাম্পের কথিত কনডোলেন্স টুইট বার্তাটি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হলেও এটি আদতে একটি ভুয়া বার্তা ছড়ানো হয়েছে বলে জানা যায়। দেয়েগো ম্যারাডোনা শুধু ল্যাটিন আমেরিকার সম্পদ নন, বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সেরা তারকাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আর আগে ল্যাটিন আমেরিকার আরেক ফুটবলার ব্রাজিলিয়ান তারকা পেলে (এডসন আরান্তেস নাসিমেন্তো) সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেলিলেন। আমাদের সময়ে পেলে ও ম্যারাডোনার বেড়ে ওঠা, তারকা হয়ে ওঠাসহ তাদের বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রময় জীবনকাহিনী বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতি দরিদ্র, বঞ্চিত, বস্তির জীবনে জন্ম নিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করার মত তারকা হয়ে ওঠার এই অনুপ্রেরণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরা কিভাবে গ্রহণ করছে তা এখন আমাদের জন্য কৌতুহলের বিষয় হয়ে উঠেছে। ম্যারাডোনার অকাল মৃত্যুতে সারাবিশ্বের গণমাধ্যম এবং আমজনতা যখন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরবতা বিশ্বের কাছে বড় রকমের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা ও মিডিায়াগুলোও কি মার্কিন ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে? আমরা যখন দেখি একজন আফ্রো-আমেরিকান গল্ফার টাইগার উডকে নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের কী মাতামাতি! টাইগার উডের মাদক ও নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় অস¦াভাবিক মিডিয়া কাভারেজ দেখা গেলেও বিশ্বে তার চেয়ে শতগুণ প্রভাব ও জনপ্রিয়তা নিয়েও ল্যাটিন আমেরিকান পেলে বা ম্যারাডোনা তার সিকিভাগ কাভারেজও পাননি। তবে ম্যারাডোনার মৃত্যুতে বুয়েন্স আইরেস থেকে লন্ডন, নিউইয়র্ক, মিলান বার্সেলোনা বা ঢাকা-কলিকাতায় কোটি মানুষের মধ্যে যে শোকের ছায়া ও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা নজিরবিহীন। অনেকের কাছে তিনি ফুটবলের ঈশ্বর। রাষ্ট্রীয় প্রেসিডেন্সয়াল প্যালেস থেকে সম্রাটোচিত মর্যাদায় তার যে ফিউনারেল অনুষ্ঠিত হয়, সত্যিই তা তুলনাহীন। ল্যাতিনদের প্রতি মার্কিনীদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি যদি স্বচ্ছ হতো তাহলে হয়তো ফুটবল স¤্রাটের মৃত্যুর পর পশ্চিমা গণমাধ্যমের কভারেজটা আরো গভীরতর ও জৌলুসময় হত। এরপরও ২৬ নভেম্বর ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদটি সারাবিশ্বের সব গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম ছিল। এটা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে নিয়ে কোনো শোকবাণী প্রকাশ না করলেও ল্যাটিন আমেরিকাসহ বাকি দুনিয়ার সব নেতা ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে এটা বুঝতে কষ্ট হয়না যে, তিনি বিশ্বের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে প্রভাব মোটেও কমে যায়নি, বরং আরো বেড়েছে। মৃত ম্যারাডোনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কিভাবে তেজোদীপ্ত পদক্ষেপে পুরো দলকে একাই বিজয়ের মাল্যে ভূষিত করা যায়। কিভাবে একজন ক্রীড়াবিদ তার দেশ, জাতি ও অঞ্চলের জন্য অনন্য সাধারণ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারেন। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের দ্বারা বার বার আক্রান্ত হয়েও নিজেকে পাথরের মত অটল এবং বজ্রের মত গতিময় রেখে বিজয়ের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে যাওয়া যায়।
ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের মওসুমে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে মূলত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে দেখা যায়। এর একভাগ আর্জেন্টিনার পক্ষে আরেকভাগে ব্রাজিলের। দুটিই ল্যাটিন আমেরিকার দেশ। আমাদের মত অনগ্রসর সমাজে যেখানে ফুটবলের আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো দূরের কথা, আঞ্চলিক মান অর্জন করতেও ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানেও ফুটবল বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকায় শহর ও গ্রামের বাড়ির ছাদ-ঘরের চালা ছেয়ে যেতে দেখা যায়। এমনকি বহুতল ভবনকেও আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়ে তুলতে দেখা যায়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার প্রতি আমাদের ফুটবল ভক্তদের এই প্রগাঢ় সমর্থন ও ভালবাসা ওইসব দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কারণে নয়, পেলে ও ম্যারাডোনার মত ফুটবল তারকারাই দেশ ও মহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে তাদের দেশের জন্য এই অস্বাভাবিক ভালবাসা, সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। গতানুগতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচারবোধের দ্বারা এমন সমর্থন ও সমীহ আদায় করা অসম্ভব। ম্যারাডোনার মত তারকা যারা তারকা থেকে সম্রাট বা ঈশ্বরে পরিনত হন, তারা এক সময় সমকালের সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক বিষয়ে রোল মডেল হয়ে ওঠেন। ম্যারাডোনা কোনো রাজনৈতিক নেতা নন, তবে ফিলিস্তিন সংকটের মত বিষয়গুলোতে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য রাজনীতিবিদ হতে হয় না। ম্যারাডোনা আমৃত্যু ফিলিস্তিনি কজের উপর অবিচল থেকে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। রাজনীতিবিদ ডোনাল্ড ট্রাম্প ম্যারাডোনার জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হলেও ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর দেয়া শোকবানীতে বয়েসে ২০ বছরের সিনিয়র ব্রাজিলিয়ান ফুটবল লিজেন্ড পেলে ম্যারাডোনাকে তার অকৃত্রিম বন্ধু বলে স্বীকার করেছেন এবং পরজগতে একদিন আকাশে দুইবন্ধু ফুটবল খেলার অলৌকিক ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এখানেই ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারকা খেলোয়াড়দের সাথে পশ্চিমা রাজনীবিদদের চেতনা ও মননশীলতায় বিশাল পার্থক্য ধরা পড়ে।
দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনিশ ও পতুর্গিজ ভাষাভাষী দেশগুলোই মূলত ল্যাটিন আমেরিকা হিসেবে পরিচিত। স্পেন ও পর্তুগালের ঔপনিবেশিকদের দ্বারা শত শত বছর ধরে শোষণের শিকার হওয়া ল্যাটিন আমেরিকা লড়াই করে স্বাধীন হলেও কখনো ইম্পেরিয়াল পাওয়ার হওয়ার চেষ্টা করেনি। তারা সব সময় একটি বৃহৎ ও সাম্যবাদী আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছে। এক সাক্ষাৎকারে কলাম্বিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক গাব্রিয়েলা গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, সাইমন বলিভারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি জীবন দিতেও প্রস্তুত। কিউবা, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা, কলাম্বিয়া, মেক্সিকোর শাসকরা কখনো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে আপস করেনি। তবে ব্যতিক্রমও আছে, পানামার স্বৈরশাসক নরিয়েগা ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপক্ষে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেই সুবাদেই তিনি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে পানামার ক্ষমতা দখলের সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে গেলে মার্কিন সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ল্যাটিন আমেরিকার শাসকরা জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হলে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। তারা আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হলেও ফুটবল এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক সাম্যের ভিন্ন এক মেলবন্ধন রচনা করতে সর্বদা সচেষ্ট। অতি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা পেলে, ম্যারাডোনা বা সুয়ারেজের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার নজির শুধু ল্যাটিন আমেরিকার। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে কামড়ে দেয়ার জন্য উরুগুয়ের স্টাইকার লুই সুয়ারেজকে বহিষ্কার করে ফিফা কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে ম্যারাডোনা যে শক্ত অবস্থান ও বিবৃতি দিয়েছিলেন তা’ সত্যিই মানবিক এবং অনুসরণীয়।
ল্যাটিন আমেরিকা এবং অ্যাংলো আমেরিকার মধ্যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে তা এখন মূলত একটি সাংস্কৃতিক ঠান্ডা লড়াইয়ে পরিনত হয়েছে। বাণিজ্য, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে ল্যাটিন আমেরিকা পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে অ্যাংলো আমেরিকা কখনোই ল্যাটিন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো সব সময় পারস্পরিক সহযোগিতার এবং সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে একটি আঞ্চলিক সংহতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাইমন বলিভার থেকে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বা চেগুয়েভারার রাজনৈতিক সংগ্রাম, গার্সিয়া মার্কেজ থেকে পাওলো কোয়েলহো এমনকি ফুটবল বিশ্বের পেলে, ম্যারাডোনা বা লুই সুয়ারেজ পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে ল্যাটিন তারকারা কেউই একদেশদর্শী সংকীর্ণ চিন্তার দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকেননি। প্রত্যেকেই যেন নিজের মত করে ল্যাটিন আমেরিকাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে বাঘের মত ওত পেতে থাকা বৃহত্তম শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের কাছে ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খা যেন জিম্মি হয়ে আছে। তবে রক্তচোষা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে আপস না করে টিকে থাকার লড়াই জারি রাখা ল্যাটিন জনগণের মজ্জাগত অনুপ্রেরণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কিউবা সত্তর বছর ধরে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। আর এখন এক নজিরবিহিন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার পরও হুগো শ্যাভেজের সুযোগ্য উত্তরসুরিরা ভেনিজুয়েলাকে মাথা নিচু হতে দেননি পশ্চিমারা বিশ্ব অলিম্পিক গেমসকে নিজেদের জন্য একটা মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করে থাকে এবং সেই মর্যাদা ধরে রাখতে বছরে শত শত কোটি ডলার খরচ করে থাকে। কিন্তু ফুটবলের বিশ্বকাপে তারা ল্যাটিন আমেরিকার কাছে দাঁড়াতে পারে না। সেখানে বস্তিতে অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় তারকারা ইউরোপের অভিজাত ফুটবল ক্লাবগুলোর মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠতে দেখা যায়। তবে ফুটবলের বিশ্বকাপে তারা নিজ নিজ দেশের হয়ে লড়াই করে ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে বা কলম্বিয়ার পতাকাকেই বিশ্বের সামনে উঁচুতে তুলে ধরেন। এক ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে জন্য যতটা সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন, কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা তা অর্জন করা অসম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।