পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সংবাদপত্রের পাতা খুললে বা টিভির পর্দায় চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত খবর। দেশের মানুষ এ সংক্রান্ত খবর দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এ দেশে ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যায় না দু’বছরের শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধাও। ‘ধর্ষণ’ সাধারণত এক ধরনের যৌন আচরণ। একজন ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলাই হচ্ছে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানী। ধর্ষণ বিভিন্নভাবেই হতে পারে, যেমন- বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, ভয় দেখিয়ে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা সম্মতি দিতে অক্ষম এমন ব্যক্তির সাথে ইত্যাদি। যে কোন পন্থা, যে কোন সময় বা যেভাবেই হোক ধর্ষণ নিঃসন্দেহে একটি বর্বরতম অপরাধ। তবে ধর্ষণের শীর্ষে থাকা দেশ আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশেও বোধ করি আমাদের দেশের মতো এতো বর্বরতার সাথে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা যেনো সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে। একজন ধর্ষণকারীর ধর্ষণ করার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এখন যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো রাজনৈতিক প্রভাব। অর্থের কারণে যে কেউ নেতা বনে যাচ্ছে। আর এর ফলেই গড়ে উঠছে ভয়ঙ্করসব বাহিনী। একটা স্বাভাবিক সমাজে কারো ঘরে গিয়ে এভাবে কেউ কাউকে নির্যাতন করতে সাহস পাবে না। এগুলো করতে পারে রাজনৈতিক আশ্রয়ে গড়ে ওঠা বাহিনীরাই। আশ্রয় এতই মজবুত যে তারা ধর্ষণ করে সেটার ভিডিও বানায়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করে। কতটা অমানবিক, কতটা পাশবিক, কতটা পশুত্বে পরিণত হলে একজন ব্যক্তি এ ধরনের কাজ করতে পারে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এ সমাজ কতটা বিচারহীনতায় ভুগছে তা এসব ঘটনা থেকেই আঁচ করা যায়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ এক বছরে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ, যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ১০ জন নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২৫৮ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছে। আবার যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু গবেষণায় আর কতটুকু আসে, বাস্তবে আমরা এই সংখ্যা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে হিসাব করলেও বোধকরি কম হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে। বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতাও। ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড। অবশেষে এর সঙ্গে মৃত্যুদন্ডের বিধানও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু শুধু ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হলেই কি ধর্ষণ বন্ধ হবে? ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার জন্য জরুরি ধর্ষকদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা ও পৃষ্টপোষকদের ফাঁসি দেয়া।
একজন নারী যখন ধর্ষণের মতো বর্বরতম অন্যায়ের শিকার হয় তখন হতাশা আর ভয় তার নিঃশ্বাসকে আটকে দেয়। মুহূর্তে গোটা পৃথিবী তার কাছে ওলট-পালট হয়ে যায়। সে তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে এর থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য। সে জানে তার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে, কিন্তু বাঁচার জন্য তাদের কাছ থেকেই ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পেতে চায়। একজন ব্যক্তি কতটা অসহায় হলে তার সাথে অন্যায় হচ্ছে জানা সত্তে¡ও ঠিক তাদের কাছেই ক্ষমা চায়, যারা তার সাথে অন্যায় করছে, তাদের হাতে পায়ে ধরেই মিনতী করে, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। একজন নারীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্ন সব মুহূর্তে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সব সময় ভয়ে গুটিয়ে রাখে নিজেকে। স্বাভাবিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। সব সময় সে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে থাকে। ভুক্তভোগী অনেক সময় আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিতে দ্বিধা করে না। এছাড়াও ধর্ষণের ফলে অনেকে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করে কিংবা যৌনাচরণের মাধ্যমে আক্রান্ত হয় এইডস, ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগে। সমাজের বাঁকা দৃষ্টির সামনে তাকে পড়তে হয় বারং বার, ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে। এ ধরনের ঘটনা একজন নারীর পরবর্তী জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। সমাজ শুধু ধর্ষিতার দিকেই আঙ্গুল তোলে, আর ধর্ষণ যে করেছে সে ঠিকই বুক ফুলিয়ে মুক্ত বাতাস নিয়ে সবার সামনে ঘুরে বেড়ায়। ধর্ষককে আমরাতো শাস্তি দিইই না উল্টো ঘৃণা করতেও ভুলে গেছি। যেন শ্লীলতাহানী শুধু নারীদেরই হয়, পুরুষদের হয় না। যেন সব অন্যায় ঐ ধর্ষিতার, সমাজ তাকে কোণঠাসা করে দেয়। পরিবারের সদস্যরা যদি তাকে বোঝায় যে সে অপরাধী নয়, সাহস দেয়, স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সহযোগিতা করে তাহলে একজন নারীর পক্ষে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা লোক লজ্জার ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, মেয়েকে ঘরবন্দি করে রাখে। ফলে ঐ নারীর জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
ধর্ষণের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ কাজ করে না। তারা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ, মাদকাশক্ত, নারীদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ কিংবা কর্তৃত্ব প্রয়াসী। রাগ, ক্ষোভ, একাকিত্ব, ব্যক্তি জীবনে কষ্ট, হতাশা, অতীতের কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, পর্নোগ্রাফি, নগ্নতা, অশ্লীল পোস্টার, অতৃপ্ত যৌন আকাক্সক্ষা প্রভৃতি একজনকে ধর্ষকামী করে তুলতে পারে। সর্বোপরি বিচারহীনতা, ক্ষমতার প্রশ্রয় ইত্যাদিও ধর্ষণে প্ররোচনা সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত আমরা নৈতিক বিপর্যয়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এর লাগাম এখনি না টানলে জাতি হিসেবে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। যে দেশে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, বাবার সামনে মেয়েকে, সন্তানদের সামনে চার সন্তানের জননীকে সম্ভ্রম হারাতে হয় সে দেশে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গেছে তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। যুব সমাজ আজ ধ্বংসের দারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের উপর। অভিভাবকরা শুধু অর্থ উপার্জন আর সন্তানের জিপিএ-৫ নিয়ে ব্যস্ত। সন্তান কতটুকু নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছে সেদিকে তারা দৃষ্টিপাত করেন না। অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে আমরা তুলে দিচ্ছি মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি যাতে করে ভালোর পরিবর্তে খারাপ প্রভাবই বেশি পড়ছে। এসব প্রভাব থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সচেতনতা। যেন প্রত্যেকটা ব্যক্তি ছোট থেকেই নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
লেখিকা: স্বত্ত্বাধিকারী, প্রয়াসী ডিজাইন অ্যান্ড আইটি পয়েন্ট, মিরপুর-১০
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।