Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতির অন্তরাত্মার ক্ষত সারানোর দায় সকলের

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

অনেক ব্যর্থতা, অবক্ষয়, অবনমন এবং অস্বচ্ছতা সত্বেও মার্কিন গণতন্ত্র অভ‚তপূর্ব এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মার্কিন গণতন্ত্রের এই উত্তরণ পশ্চিমা গণতন্ত্রের এক নবযাত্রার সূচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। চার বছর আগে ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে নতুন এক প্রেক্ষাপট দেখা গিয়েছিল। সেবারই প্রথম প্রায় সব গণমাধ্যম ও জরিপ সংস্থা জনমত জরিপ, পরিসংখ্যান ও ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমান করে প্রায় তিন মিলিয়ন পপুলার ভোটে হিলারি ক্লিন্টন থেকে পিছিয়ে থেকেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে সম্ভাব্য কারচুপি ও বিদেশি হস্তক্ষেপসহ নানা অসঙ্গতি সামনে রেখে আমেরিকার প্রায় প্রতিটি রাজ্যের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারছিলনা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে সাধারণ মানুষের এমন সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্ভবত এটাই ছিল প্রথম। এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ান গোয়েন্দাহস্তক্ষেপসহ নানা অভিযোগ নিয়ে জল্পনা-আলোচনা গত চার বছর ধরেই অব্যাহত ছিল। আর ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান সামনে রেখে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চারবছরের কর্মকান্ড শুধু মার্কিন রাজনীতি, অর্থনীতি, ক‚টনীতি এবং ভ‚-রাজনৈতিক সত্তা ও সম্ভাবনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, এর ফলে পুরো বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতি-অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতাও ঝুঁকিতে পড়েছে। একটি একদেশদর্শী ও বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে ইউনিপোলার বিশ্বের অপ্রতিদ্ব›দ্বী পরাশক্তি আমেরিকাকে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অপরিনামদর্শিতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বনেতৃবৃন্দ যখন উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কাজ করতে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে চেয়েছেন, ডোনাল্ড তখন জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কাকে একটি হোক্স বা ভুয়া প্রচারনা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুৃক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার একমাসের মধ্যেই বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষনা দিয়ে যে বিচ্ছিন্নতার সূচনা করেছিলেন চলমান করোনা ভাইরাস মহামারী পর্যন্ত তা অব্যাহত রেখেছিলেন। তার ভ‚মিকা ছিল বরাবরই একমুখী, গোয়ার্তুমি ও বিচ্ছিন্নতাপূর্ণ। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো অঙ্গিকার ও ভ‚মিকা থেকে সরে গিয়ে ফিলিস্তিন সমস্যা এবং ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তির লঙ্ঘন ও প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে ইরানের সাথে সরাসরি সামরিক-ক‚টনৈতিক দ্ব›েদ্ব অবতীর্ন হয়ে গত দুই বছরে পশ্চিমামিত্রদের সাথে আমেরিকার দ্ব›দ্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ইরানের উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও দেশগুলোর উপর আমেরিকার ক‚টনৈতিক প্রভাব চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জায়নবাদি ও বর্ণবাদী ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী সামনে রেখে আমেরিকাকে গ্রেট করার বদলে বিশ্বের কাছে হেয়-অপাঙতেয় করে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন ট্রাম্প।

গ্রীক, রোমান, পারস্য, অটোমান, চৈনিক সভ্যতার মত বিশ্বের পুরনো সভ্যতা, সা¤্রাজ্য বা এম্পায়ারগুলোর একেকটা একেকভাবে ঐতিহাসিক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বিশ্ব দরবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান নিশ্চিত করার পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার চাইতেও বড় শক্তি হচ্ছে তার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন, যা দেশে দেশে মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। ঊনবিংশ শতকে আমেরিকান রেভ্যুলেশনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র তথা ধর্ম-বর্ণ, জাতিগত পার্থক্য নির্মূলকারী রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছিল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেই ভিত্তির উপর বার বার আঘাত করেছেন। ৩ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ভোটকেন্দ্রে গড়ানোর অনেক আগে থেকেই একটি জল্পনা সক্রিয় ছিল, গণমাধ্যমের জরিপ সত্য হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভোটে পরাজিত হবেন, তবে তিনি হোয়াইট হাউজের দখল ছাড়বেন কিনা সেটাই ছিল বড় জল্পনার বিষয়। অবশেষে আমরা সেই আশঙ্কাকে সত্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখছি। ডেমোক্রেট প্রতিদ্ব›দ্বী জো বাইডেন পপুলার এবং ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এগিয়ে থাকার বাস্তবতার মধ্যেও ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে কোনো তথ্যপ্রমান ছাড়াই নিজের নিয়োগকৃত প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভোটে কারচুপি, গণনায় অনিয়ম-অস্বচ্ছতার অভিযোগ তোলার পাশাপাশি ভোট গণনা স্থগিত রাখতে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। একে একে প্রায় সব রাজ্যেই ট্রাম্পের নির্বাচন পরিচালনাকারীদের দায়ের করা অভিযোগ আদালত খারিজ করে না দিলে এই নির্বাচনের ফলাফল মাসের পর মাস ধরে ঝুলে থাকার আশঙ্কা ছিল। ইতিমধ্যে জো বাইডেনের বিজয় নিশ্চিত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ফলাফল মেনে না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। আমেরিকায় এবারের নির্বাচনটি ছিল বর্ণবাদী প্রতিহিংসা এবং আমেরিকান এক্সেপশনালিজম ও বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মার্কিন জনগণের রায়। এমনকি নির্বাচনে গণরায় নিশ্চিত হওয়ার পরও তা না মানার যে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তা যেন আমেরিকার সুর্দীঘ ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর চপেটাঘাত।

এবারের মার্কিন নির্বাচনে বেশ কিছু নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে পাস করতে ব্যর্থ হলেন। মূলত: তার একগুয়েমীপূর্ণ শাসন ও সিদ্ধান্তে নতুন প্রজন্মের মার্কিন নাগরিক সমাজ অতীষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তরুণ মার্কিন ভোটারদের অনেকেরই মন্তব্য ছিল, আরো ৪ বছরের জন্য ট্রাম্পের শাসন ভাবাও যায় না। ট্রাম্প যেনতেন প্রকারে নির্বাচন প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দৃঢ়সংকল্প হয়েছিলেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনের দলনিরপেক্ষ ভ‚মিকা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। প্রশাসনের পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা না থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়তে বাধ্য। এর অন্তরালে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণের স্বৈরতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যদিও মার্কিন গণতন্ত্র নিস্কলুষ বা নিñিদ্র নয়, তথাপি পশ্চিমা গণতন্ত্রের অগ্রদূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় গণতান্ত্রিক বিশ্বের অবশিষ্ট অংশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অবনমন ও ব্যর্থতা সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গণবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যায়। গত চার বছরে মার্কিন গণতন্ত্র ও সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরাত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এটি যে ট্রাম্পের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তা নয়, কর্পোরেট আমেরিকার জায়নবাদি ইহুদিদের নিবিড় যোগসুত্র অনেক পুরনো। ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের নতুন প্রতিপক্ষ বানিয়ে অস্ত্রবাণিজ্য ও নতুন ওয়ার থিয়েটার চালুর মধ্য দিয়ে তার নবযাত্রা যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমেরিকা ফার্স্ট ও বণবাদী দিগদর্শনের মোড়কে ট্রাম্পের শাসনে আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদারদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পদদলিত হয়। বিগত ২০১৬ সালের নির্বাচনে বার্নি সেন্ডার্স সে কথা তুলে ধরেছিলেন, এবার জো-বাইডেন সে কথা আরো জোর দিয়ে বলেছেন। ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে জো বাইডেন আমেরিকার ক্ষত-বিক্ষত অন্তরাত্মাকে সারিয়ে তোলার কথা বলেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প গত চার বছরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ এবং বহুত্ববাদী মার্কিন সমাজের বৈষম্যহীন মূল্যবোধের উপর যে বিভক্তির দেয়াল তুলেছিলেন, জো-বাইডেন এখন তা অপসারণ করে পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও লিগ্যাসিকে পুন:প্রতিষ্ঠার সংকল্প তুলে ধরেছেন। এটা সত্যিই কঠিন কাজ। এ কাজে তিনি কতটা সফল হবেন তা জোর দিয়ে বলা না গেলেও আমেরিকার তথাকথিত গ্রেটনেস পুনরুদ্ধারে এটাই হতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ভোটে ট্রাম্পের বিদায় নিশ্চিত হওয়ার পর জো বাইডেন মার্কিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার প্রথম বক্তৃতায় মার্কিন সমাজের ক্ষত সারিয়ে তোলার কথা বলেছেন। মার্কিন ফ্উান্ডিং ফাদাররা মার্কিন সংবিধানে যে সব বিষয় সন্নিবেশিত করে বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে বিষয়গুলো ধসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। জাতির মধ্যে বৈষম্য ও বিভক্তির দেয়াল তুলে দেয়ার চেয়ে বড় আত্মঘাতী রাজনৈতিক প্রবণতা আর নেই। ঊনবিংশ শতকে রেভ্যুলেশন এবং বিংশ শতকের মধ্যভাগে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে বর্ণবাদী বৈষম্য বাহ্যিকভাবে তিরোহিত হলেও এটা কখনোই বিলোপ হয়নি। জর্জ বুশ বা ডোনাল্ড ট্রাম্পদের মত ক্ষীণদৃষ্টির ব্যক্তিরা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তা উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা বেসরকারি ব্যাংকের কর্তৃত্ব এবং কারেন্সি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জনগণের হাতে সংরক্ষিত রাখার কথা বলেছিলেন। অন্যথায় মার্কিন গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সম্পদের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। তা এখন বাস্তবে পরিনত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে সম্পদ ও ক্ষমতার পুরোটাই গুটি কয়েক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বাস্তবতা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদের পুঞ্জিভবন এবং অবক্ষয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার্কিন জনগণকে এখন রাস্তায় নেমে বলতে হয়, উই আর দ্য নাইনটি নাইন পার্সেন্ট। অর্থাৎ শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষকে বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যে ঠেলে দিয়ে একভাগ মানুষের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের সব সম্পদ এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে আছে। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই চটকদার রাজনৈতিক শ্লোগান ও বিজ্ঞাপণের মোড়কে বিচ্ছিন্নতা ও বর্ণবাদের মুখোশ পরিয়ে সমাজে আতঙ্ক ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। গণতন্ত্রের মোড়কে এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। এডলফ হিটলারের জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্বের শ্লোগান তুলে বিশ্ব দখলের পায়ঁতারা বিশ্বযুদ্ধে কোটি মানুষের রক্তের বিনিময়ে রুখে দেয়া হয়েছিল। পারমানবিক বোমা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে যুদ্ধে বিজয়ের অনুঘটকের ভ‚‘মিকা পালন করলেও আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তি দেশগুলো হিটলারের সেই রাজনৈতিক দর্শনকেই নিজেদের মত করে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। আমেরিকা থেকে ভারত, চীন, রাশিয়া এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও মাত্রাভেদে বিভক্তির বিরূপ প্রভাব রাষ্ট্রদেহে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে।

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে মার্কিন কবি, দার্শনিক, সুবক্তা, রাজনীতিবিদ ও সমাজচিন্তক রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসন নতুন প্রজন্মের লেখক, রাজনীতিবিদ ও সমাজচিন্তকদের মার্কিন মানসচেতনার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে মার্কিন জাতির আত্মার সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা যে কারণে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেই, ঠিক একই কারণে এমারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি হওয়ার দাবী রাখেন। মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যে সব বিষয়গুলো সামনে রেখে মার্কিন জাতির ভবিষ্যত নির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, এটা হবে এমন এক রাষ্ট্র যা সমগ্র বিশ্বে আধুনিক, মননশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে সব মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রবণতা এবং কর্পোরেট অর্থনীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের স্বরূপ ও বিপদ সম্পর্কেও তারা সচেতন ছিলেন। তাদের সেই আশঙ্কার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে এক সময় বেসরকারি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক মার্কিন অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠা এবং ডিপ স্টেটের মূল অনুঘটক হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিনত হওয়ার মধ্য দিয়ে আজকের বিশ্বব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনের প্রান্তে পতিত হয়েছে। নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন মার্কিন অন্তরাত্মার ক্ষত সারিয়ে তোলার কথা বলেছেন। এই ক্ষত ও রক্তক্ষরণ বাস্তবে দেখা যায় না। নানা ঘটনাপ্রবাবে সংক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে এটা শুধু উপলব্ধি করা যায়। ক্ষমতাদর্পী শাসকদের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থে জাতিকে স্পষ্টত বিভাজিত করে ফেলা এবং সংখ্যালঘিষ্ট গোষ্ঠিগুলোকে টার্গেট বানিয়ে জাতীয়তাবাদের ফ্যাসিবাদী চারিত্র্যলক্ষণ দেশে দেশে রাষ্ট্রের আত্মার রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। জার্মানীর এডলফ হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী পপুলারিজমের রাজনীতিকে ধারণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদির মত শাসককরা গণতন্ত্রকে প্রায় ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। বিশ্বের এক নম্বর গণতান্ত্রিক পরাশক্তি আমেরিকা এবং শতকোটি মানুষের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে শাসকদের বিভেদের রাজনীতি প্রতিবেশী ও প্রভাব বলয়ে থাকা দেশগুলোকেও ভিন্নভাবে স্পর্শ করেছে।

মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের মত স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসে এখনো এখানে নির্মূলের রাজনীতি চলতে দেখা যাচ্ছে। এন্টাগনিজমের বিভাজন সৃষ্টি করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিত করা অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার পূর্বসূরিরা বর্ণবাদী বিভাজন ও ইসলামোফোবিক প্রতিহিংসার এজেন্ডা নিয়ে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকানদেরই উৎপীড়ন করেননি, হোম সিকিউরিটি আইনের নামে সমগ্র মার্কিন জনগোষ্ঠী এক অপ্রত্যাশিত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের যাতাকলে নিস্পিষ্ট হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী ইসলামবিদ্বেষ ও জাতিগত বিভাজনে ভারতে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ। ভারতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় সমান। ভারতীয় ইউনিয়নের অস্তিত্বের সাথে হিন্দু-মুসলমানের মেলবন্ধন এক অনিবার্য বাস্তবতা। হিন্দুত্ববাদী শাসনে সেই জাতীয় আত্মার রক্তক্ষরণ চলছে। মার্কিন জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিদায় দেয়ার পর জো বাইডেন মার্কিনীদের বিভাজন ও রক্তক্ষরণ সারিয়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। গণতন্ত্রে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, সব ক্ষমতা জনগণের হাতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবারের নির্বাচন সেই অভিব্যক্তির বহি:প্রকাশ ঘটেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এখন সব অপ্রত্যাশিত বিভেদ ও বৈষম্য ঘুচিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সূচনা করতে চান। মার্কিন গণতন্ত্রের এই সুবাতাস আমাদের উপমহাদেশেও লাগুক, এই প্রত্যাশা আমাদের।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন