Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্রহীন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

দেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গত ১০ বছরের মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে প্রথম দু’চারশর মধ্যে স্থান পায়নি। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু আগেই সুনাম হারিয়েছে। দেশের মেধাবী সন্তানরা এখনো এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীড় করলেও মেধার বিকাশ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার চেয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা এখন কার্যত সন্ত্রাসী ও ক্ষমতার পদলেহি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে জিম্মি। দর্বৃত্তায়নের কবলে দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি যখন ক্ষমতাসীনদের লোলুপ ইচ্ছার যুপকাষ্ঠে বলি হয়ে দশক ধরে পদদলিত হতে থাকে, তখন রাষ্ট্রের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিই আর অটল থাকে না। একই সাথে ভেঙ্গে পড়ে মানুষের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সব ভিত্তিভূমি। একেকটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের পর জনগণের কাছে বলা হল, গণতন্ত্রের চেয়ে তথাকথিত উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন ইত্যাদি। পদ্মাসেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, ঢাকায় নতুন নতুন উড়ালসেতু নির্মিত হয়েছে, মেট্টোরেল-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে- উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ, আর কি চাই? ডিজিটাল বাংলাদেশ চৌদ্দ রকাটি মানুষের হাতে হাতে মোবাইলফোন, সাধারণ মানুষের পকেট থেকে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা বিদেশি মোবাইলফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো নিয়ে যাচ্ছে। এরা যেন দেশে নব্য ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি রূপে আর্বিভুত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিলেও আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যেন এদের কাছে অসহায়। প্রশাসনের একশ্রেণীর আমলা এসব কোম্পানির সাথে গোপণ যোগসাজশের মাধ্যমে জনগণের হাজার কোটি টাকার ভাগাভাগি করে নিচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। ডিজিটাল বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তারা পড়ালেখার চেয়ে টিকটক, লাইকি, ইউটিউভ, ফেইসবুকেই বেশি সময় দিচ্ছে। কেউ কেউ মাদকাসক্তির পাশাপাশি পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কিশোর-তরুণদের হাল ফ্যাশনে, কথনে-চলনে, চুলের কাটিংয়ে, আচরণের ঢংয়ে ডিজিটালাইজেশন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়ণের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শহরের মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গ্যাং সদস্যর মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ হয় এবং নতুন নতুন গ্যাং গড়ে তোলার মাধ্যমে গ্যাং কালচার বিস্তৃত করে চলেছে। করোনাভাইরাসের এই দু:সময়ে ঘরে বসে থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এই গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। আগামী কয়েক মাস পর স্কুল-কলেজ খোলার পর এসব গ্যাং মেম্বাররা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে গ্যাং কালচারের মহড়া দেখাতে নতুন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কে দেশের দ্বিতীয় সংসদের মত মর্যাদা দেয়া হত। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত দেশের প্রতিটি গণআন্দোলন ও ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ডাকসুর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাজপথে রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর থেকে প্রায় তিন দশক ধরে ডাকসু সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে সব ভোটকেন্দ্র দখলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একই প্রক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনকে নিজেদের মতো করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে অবশেষে প্রায় তিন দশক পর গত বছর মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনে কোটা বিরোধী সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের অশুভ পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। হল সংসদগুলোতে ন্যাক্কারজনক ভোট জালিয়াতি ও দখলবাজির পরও ডাকসু ভিপি হিসেবে ছাত্রলীগকে পরাজিত করে কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূরের বিজয় ঠেকানো যায়নি। এরপর থেকে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরের উপর একের পর এক হামলা-মামলা ও প্রাননাশের হুমকি বন্ধ হয়নি। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুসারে এর নির্বাচিত কমিটির কার্যকালের মেয়াদ এক বছর। ইতিমধ্যেই নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ মার্চ মাসে শেষ হয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনের ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূরের উপর বার বার হামলা করেও তার প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করা যায়নি। অবশেষে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে একটি নারী নির্যাতন মামলা করে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও ভাব-মর্যাদার প্রতীক ডাকসুকে কার্যত অকার্যকর, মর্যাদাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এই ভাটিবাংলায় প্রথম উচ্চশিক্ষার আলোকবর্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষ উৎযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠের শতবর্ষের আয়োজনে নি:সন্দেহে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকার এর প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেক আলোকিত, প্রথিতযশা ও খ্যাতিমান মানুষদের বিশেষ আগ্রহ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সন্ধিক্ষণে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বশীল কোনো সংসদ না থাকা, অথবা নির্বাচিত ডাকসু ভিপির বিরুদ্ধে প্রশাসনের মদতে একের পর এক হামলা, মামলা এবং ছাত্রী ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ তোলার ঘটনাগুলো কি আমাদের সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের লজ্জিত ও বিব্রত করবে না? তবে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ ও সামাজিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, অপরাধ-অপকর্ম যতই গুরুতর হোক না কেন, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান কাউকে আর বিব্রত বা লজ্জিত হতে দেখা যায় না। এই করোনার সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এবং মানহীন সুরক্ষা সামগ্রীর কারণে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ সামনের সারির শত শত করোনা যোদ্ধা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও রাঘব বোয়ালদের ধরার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্য বিভাগের ডিজিকে বরখাস্ত করার পর এখন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের একজন ড্রাইভারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে গণমাধ্যমকে খুব মাতামাতি করতে দেখা যাচ্ছে। এই ড্রাইভারকে যারা কোটি কোটি টাকা ভাগ দিল তাদের নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই বললেই চলে। কিভাবে রূপপুরের সরকারি আবাসিক ভবনে ৮ হাজার টাকায় একেকটি বালিশ কেনা হয়, কিভাবে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ৩৫ লাখ টাকায় একেকটি পর্দা কেনা হয়, চট্টগ্রামের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ১০-১২ হাজার টাকা দামের অটোস্কোপ মেশিন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায়, ১৫ হাজার টাকা দামের ব্লাডপ্রেশার মেশিন ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায়, ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দামের এমআরআই মেশিন কোটি ৯৫লাখ ৫০ হাজার টাকায় ক্রয় করার খবর অনেক পুরনো। দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে এই বাস্তবতা বিদ্যমান। এরচেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কোনো যন্ত্রপাতি না কিনে ভুয়া বিল ভাউচার ব্যবহার করে একেকটি টেন্ডারে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্যও উঠে এসেছে। আর প্রকৃত মূল্য থেকে ১০ গুণ বেশি মূল্য দিয়ে কেনা একেকটি যন্ত্র অকেজো করে দিয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্মকর্তা-কর্মচারিরা কিভাবে বেসরকারি হাসপাতালের সাথে কমিশন বাণিজ্য করছে এ বিবরণ আরো অনেক বিস্তৃত ও বিস্ময়কর।

ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, অস্বচ্ছতা, অবিচারের এমন সব খন্ডচিত্র দেখতে দেখতে যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয়করণ, দুর্বৃত্তায়ণ, দুর্নীতি-অবক্ষয় ও অবমূল্যায়নের গরল দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, স্কুল-কলেজ থেকে কিন্ডারগার্টেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। একটি জাতিকে চিরতরে পিছিয়ে দিতে হলে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেতর থেকে বিশৃঙ্খল ও কলুষিত করে ফেলাই যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা নেই, ভিন্নমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নেই, নেতৃত্ব, জ্ঞানচর্চা ও উদ্ভাবনী প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রগুলো ক্রমে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে, তখন হঠাৎ একদিন কে যেন বলল, দেশের সব স্কুলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে, আর অমনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কিছু কিছু স্কুলেও ছাত্রলীগ গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা গেল। সেসব আত্মপ্রকাশের চিত্র প্রকাশ্যে ততটা প্রকটভাবে দেখা না গেলেও শিশু-কিশোরদের ভাবাবেগের সাথে ক্ষমতার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করার ভুল পদক্ষেপ ঢাকা শহরে গজিয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং কালচার বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে কিনা তা সমাজচিন্তক ও অপরাধ বিজ্ঞানীরাই সঠিক বলতে পারবেন। আমরা এখন শহরের নানা প্রান্তে কিশোর গ্যাং, তরুণ গ্যাং, যুবক গ্যাং থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বল্গাহীন আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি। একসময় যেখানে সভ্যতার ফুল ফোটানো হতো, জ্ঞানের আলো জ্বালানো হতো, সেসব প্রাচীন-ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠগুলো এখন ধর্ষক-হন্তারকের চারণভূমিতে পরিণত হল কেন, এই প্রশ্নের যুৎসই উত্তর ও প্রতিবিধান ছাড়া জাতির মুক্তি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ছাত্রসংসদ নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাদর্পী কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে।

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সিলেটের এমসি কলেজ (মুরারি চাঁদ কলেজ) ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে আবারো কলঙ্কিত হয়েছে। অনেকের মনে থাকার কথা, ২০১২ সালে এমসি কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এমসি কলেজের দৃষ্টি নন্দন ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসের ৬টি ব্লকের ৫টিই পেট্টোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। শুধুমাত্র হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য একমাত্র ব্লক শ্রীকান্ত হাউজে আগুন দেয়নি তারা। শত বছরের এমসি কলেজ থেকে দেশের অনেক স্বনামধণ্য ব্যক্তিত্ব উঠে এসেছেন। সেই অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকেও সেখানে গিয়ে রুমালে চোখ মুছতে দেখা গেছে। এমন অনেকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও গত আট বছরেও অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। অনেক বড় নৃশংস, পৈশাচিক ঘটনা না ঘটলে ছোটখাট কোনো কিছুতে আমাদের গণমাধ্যমের চোখ পড়েনা। ঘটনা পর্যায়ক্রমে ঘটেই চলেছে। সিলেট সরকারি কলেজে ছাত্রলীগকর্মী বদরুল যখন প্রকাশ্য চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খাদিজা নামের মেয়েটির রক্তে সবুজপ্রান্তরকে রক্তরঞ্জিত করল তখনি তা চাঞ্চল্যকর খবরে পরিণত হয়েছিল। এই করোনায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকলেও ছাত্রলীগের কিছু ছেলে যেন ঘরে থাকতে পারেনা। তারা ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের ভাব-মর্যাদার উপর কালিমালিপ্ত করতে জঘন্য কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি দৃষ্টিনন্দন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সময় সুযোগ পেলে সেখানে তারা বার বার ফিরে যেতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনি এক নবদম্পতি এমসি কলেজে গিয়েছিল। এরপরের পৈশাচিক ঘটনা এখন সবারই জানা। স্বামীকে বেঁধে রেখে মারধর করে স্ত্রীকে ৯ জনে মিলে ধর্ষণ করে এমসি কলেজে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে নরপশুরা।

অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এদেরকে নিজেদের লোক বলে বিচারের হাত থেকে রক্ষায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এভাবেই দেশে গড়ে উঠেছে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের সাথে যারা জড়িত তারা প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই করেছে। এদের কারোই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কেউ কেউ এখন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করে ক্ষমতার তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদের দেখেই উৎসাহী হয়ে নতুন গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসী-ধর্ষকরা ছাত্রলীগের পদ বাগিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শত বছর আগে বৃটিশ ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রচিন্তক লর্ড অ্যাকটন বলেছিলেন, পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি। ক্ষমতার ধর্র্মই হচ্ছে দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা করা। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতাকেও নিরঙ্কুশ ও বেপরোয়া করে তোলে। শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বহুমতের রাজনৈতিক সহবস্থান এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই ক্ষমতার একচেটিয়া অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার পর এক সময় সচেতন সাধারণ মানুষকেই ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের কর্মীরা, বুয়েটে আবরার ফাহাদের মত মেধাবী শিক্ষার্থী, এমসি কলেজে নবদম্পতির সম্ভ্রম হারানো অথবা বগুড়া শহরে মেয়েকে ধর্ষণের পর বিচার চাওয়ার অপরাধে মা মেয়েকে ন্যাড়া করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার-এরা সবাই ক্ষমতাসীনদলের ছত্রছায়ায় এমন সব অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। চাঞ্চল্যকর ঘটনার মামলায় এরা অনেকেই অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হলেও কারোই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। মেজর (অব:) রাশেদ খানসহ দুই বছরে দুইশতাধিক মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যার মূল আসামী সাবেক ওসি প্রদীপকুমার নাকি জেলখানা-হাসপাতালে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন! আমরা চাই না, এমন সব অপরাধিকেও ক্রসফায়ার দেয়া হোক। দেশের মানুষ চায়, এসব অপরাধিদের দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। দেশের আর কোথাও, আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউই যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির চিন্তা করারও সাহস না পায়, তেমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করাই হচ্ছে জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন। গণতন্ত্র, জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন ছাড়া অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।
[email protected]



 

Show all comments
  • Jack Ali ২ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৪ পিএম says : 0
    No body talk about root cause about all these crime.. We are muslim and our country must be ruled by the Law of Allah then all the crime will stop.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন