পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার জন্য ভারত যে ‘অনুতপ্ত’ একথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে কে বললো? তিনি বলেছেন যে, তিনি শুনেছেন, রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আগে ভাগে না জানানোয় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অনুতপ্ত। রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও আগে জানতে পারেনি। তাই তারা সেই সিদ্ধান্ত আগে বাংলাদেশকে জানাতে পারেনি। একটি ইংরেজি দৈনিকের রিপোর্ট মোতাবেক তুরস্ক থেকে ঢাকায় ফিরেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের একথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের যে নিষেধাজ্ঞা ভারত জারি করেছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশ শীঘ্রই একটি ইতিবাচক ফলাফল আশা করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন যে, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আগে ভাগে জানতো না বলে বাংলাদেশকে সেটা অগ্রিম জানানো সম্ভব হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অগ্রিম জানতে পারেনি তাতে কী হয়েছে? সিদ্ধান্তের সুপারিশ করেছে তার বাণিজ্যমন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বা প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর সেটি ভারতের সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ততে পরিণত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়েরই যে জানাতে হবে, তার তো কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রণালয় বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রণালয়কে সেই কথা জানাতে পারতো এবং সেটাই হলো প্রপার চ্যানেল।
আসল কথাতো সেটা নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন তুরস্কে ছিলেন তখন অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁরই প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী জানিয়েছেন যে, ২০১৯ সালের এই সেপ্টেম্বর মাসে ঠিক এখনকার মতোই ভারত অকস্মাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে। ফলে বাংলাদেশে ৩০ টাকার পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় ওঠে। তখন বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি ভারত সরকারের নিকট উত্থাপন করে। তখন দুই দেশের মধ্যে এই মর্মে অলিখিত সমঝোতা হয় যে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি রপ্তানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না। যদি বিশেষ কোনো কারণে সেটি করতেই হয় তাহলে প্রতিপক্ষকে আগে ভাগেই সেটি জানিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া চলতি বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দুই দেশের বাণিজ্য সচিবের বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বন্ধ না করার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। যদি কোনো কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেই হয়, তবে তা যেন বাংলাদেশকে আগে ভাগে জানানো হয়।
গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুষ গয়াল। হিন্দিতে প্রদত্ত ঐ ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমর বাবুর্চিকে আমার বলতে হয়েছে যে, পেঁয়াজ ছাড়া তরকারী রান্না করার কোনো বিকল্প নাই। আমি ভারতকে অনুরোধ করবো যে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মেহেরবাণী করে আমাদেরকে আগে ভাগে জানাবেন। হাজার হলেও আমরা তো প্রতিবেশী।’
ওপরে বর্ণিত পটভ‚মিতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পেঁয়াজ রপ্তানিবন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে। এ ছাড়া ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনও ভারতীয় সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে। বাংলাদেশের তরফ থেকে নাকি আরও বলা হয়েছে যে, পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাংলাদেশের আমদানিকারকরা ইতোমধ্যেই যেসব এলসি খুলেছেন সেই সব এলসির মাল যেন বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পায়।
দুই
ওপরের এই আলোচনার পর এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারত ২০১৯ এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের সমঝোতা বা ওয়াদার কোনো মূল্যই দেয়নি। এটি শুধু আমাদের কথা নয়। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছে সেই চিঠির এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে গত ২০১৯ এবং ২০২০ সালে যে কথা এবং সমঝোতা হয়েছিল, ভারত সরকারের ১৪ সেপ্টেম্বরের ঘোষণা সেই কথা এবং সমঝোতার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেনি। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে সোনালি অধ্যায় বিরাজ করছে, বাংলাদেশ সেই সম্পর্কের খাতিরে হাই কমিশনের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশে আবার পেঁয়াজ রপ্তানি চালুর অনুরোধ জানাচ্ছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সরল মনে আশা করেছেন যে, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ যে আবেদন করেছে, তার হয়তো একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিকে যতখানি সহজ সরল ভেবেছেন, বিষয়টি ততখানি সহজ সরল নয়। এর সাথে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জড়িত। আর সে কথা ভারতের প্রায় সমস্ত মিডিয়াই প্রকাশ করেছে। যেমন কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ রিপোর্ট করেছে যে, গত ৬ মাসে পাইকারী বাজারের পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সামনেই বিহারের বিধাননগর ভোট এবং মধ্যপ্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচন। তার আগে পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের খেসারত দিতে নারাজ বিহারের বিজেপি নেতৃত্ব। সে কারণেই কোনোরূপ ঝুঁকি না নিয়ে সোমবার রাত্রে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
এই বিষয়টি বাংলাদেশও বুঝেছে ভালোভাবেই। ভারত যে গতবারের মতো এবারেও রপ্তানি বন্ধের মতো একটি ঝামেলা পাকাবে তেমন একটি আশঙ্কা এবারেও ছিল। তাই আগস্টের শেষে এবং সেপ্টেম্বরের প্রথমে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেছিলেন। ঐ সব এলসির বিপরীতে ভোমরা, হিলি এবং বেনাপোল স্থল বন্দরে প্রায় ৮০০ টন পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক আটকে পড়েছিল। এসব ট্রাকে আনুমানিক ১৬ হাজার টন পেঁয়াজ রয়েছে। ১৯ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে এসব ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করেছে। ফলে পেঁয়াজের বাজার, যেটি হঠাৎ করে ১০০ টাকায় উঠেছিল, সেটি ২০ সেপ্টেম্বর ৭০ টাকায় নেমে এসেছে। বিশেষ বিবেচনায় ভারত ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। ঐ ২৫ হাজার টন ঐ ১৬ হাজার টনের অন্তর্ভুক্ত কিনা সেটি পরিষ্কার নয়। আমদানি চাহিদা যেখানে ১০ লক্ষ টন সেখানে ২৫ হাজার টন সেই প্রবাদ প্রবচনের মতো। সেই প্রবাদে বলে, ‘ভিক্ষার চাল কাড়া আর নাকাড়া।’ ২০ সেপ্টম্বরের মধ্যেই প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে ৬০ টন পেঁয়াজ ট্রলার যোগে এসে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখান থেকে ১ লক্ষ টন পেঁয়াজ এসে পৌঁছবে। এসব কারণে ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশের বাজারে গতবারের মতো পেঁয়াজ কেনার হিড়িক নাই। এছাড়া মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি দেশ থেকেও পেঁয়াজ আসবে। গতবারের সঙ্কট এবার হবে না।
১৪ সেপ্টেম্বর যেদিন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে, বাংলাদেশ ভারতকে যে ১৪৫০ টন ইলিশ রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রথম চালান সেদিনই কলকাতায় পৌঁছে। আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে বাকী ইলিশ রপ্তানি সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ ছিল। প্রতি কেজি ইলিশ ৮০০ টাকা দরে। কোনো ক্ষেত্রে ইলিশের ওজন যদি ১২০০ গ্রাম হয়ে যায় তাহলেও দর থাকবে ঐ ৮০০ টাকাই। ওরা যখন পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করে এবং ফলে বাংলাদেশে ৩০ টাকার পেঁয়াজ ৩০০ টাকা ওঠে তখন আমরা জেনে শুনে তাদেরকে ইলিশ পাঠাই কেন? এটি নাকি হিন্দুদের শারদীয় দূর্গা পূজা উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের শুভেচ্ছা’। আমাদের কাছে যদি শুভেচ্ছার এত ঢালি থাকে তাহলে ওদের কাছে শুভেচ্ছার কোনো ঢালি নাই কেন? পাঠকদের মনে আছে যে, বছর দুয়েক আগে একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি ভারত সেটা চিরদিন মনে রাখবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো ভারতের কাছে বিশাল উদার্য্যরে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু ভারত তার বিনিময়ে বাংলাদেশকে কী দিয়েছে? শুধুমাত্র শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ আমরা ইলিশ দেবো? ইলিশ কি আমাদের কোনো বার্গেনিং কাউন্টার হতে পারে না? সাম্প্রতিককালে আমি দু’বার ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। আমার গন্তব্য ছিল হায়াদারাবাদ। যাওয়া এবং আসার পথে মোট ৪ বার কলকাতার স্টপ ওভার ছিল। দেখেছি, ইলিশের জন্য তাদের কী হা পিত্যেস। টেলিফোনে বলতো, ‘দাদা, আসার সময় দু’ চারটা ইলিশ আনতে পারেন না, পদ্মার ইলিশ।’ আমার উত্তর ছিল, ‘ইলিশ নিয়ে তো অ্যারোপ্লেনে উঠতে দেবে না।’ বুঝে দেখুন, ওদের ওখানে পদ্মার ইলিশের ডিমান্ড কেমন। শুভেচ্ছা কি ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক?
তিন
এ ব্যাপারে আইনের একটি প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লায়লাফুর ইয়াসমিন। তিনি বলেন, যে সব রপ্তানি পণ্যের রপ্তানি আকস্মিক বন্ধ করলে আমদানি কারক দেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এবং যদি দুই দেশের মধ্যে একে অন্যকে জানানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি থাকে তাহলে সেই দেশ, আইন মোতাবেক সেই প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে বাধ্য। যদি সেটা মানা না হয় তাহলে বন্ধুত্ব কোন পর্যায়ে আছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অধ্যাপিকা ইয়াসমিন বলেন, বলা হয় যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু ভারতের আচরণে সেটির প্রতিফলিত হয় না।
একটি বিষয় বাণিজ্যমন্ত্রণালয় কেন আগে বুঝতে পারেননি সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। গত বছর যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে, তখন তাদের সামনে ছিল মহারাষ্ট্রের নির্বাচন। এবার বিজয়া দশমীর পর বিহারের নির্বাচন। গত বছর মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের পূর্বাহ্নে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দর হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিলো। তাই তখন রপ্তানি বন্ধ করা হয়। এবারও তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে ২৫ রুপির পেঁয়াজ ৭০ রুপিতে ওঠে। সুতরাং রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে বাজার অস্থিরতা বন্ধ করার জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি যে এবারেও বন্ধ করা হবে, সেটি পূর্বাহ্নে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় আঁচ করতে পারেনি কেন?
সবশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। এভাবে আর কতদিন বিদেশিদের মুখাপেক্ষী থাকবো? বাংলাদেশের প্রয়োজন ৩৬ লক্ষ টন। উৎপাদন ২৬ লক্ষ টন। ঘাটতি ১০ লক্ষ টন। উন্নতমানের বীজ দিয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এই মতামত কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের। আগামী বছরে ফলন বাড়ানোর টার্গেট নিয়ে এখন থেকেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর কাজ শুরু করতে পারেন না?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।