পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় ভারতেও দিবসটি পালিত হয়। বর্তমান দুনিয়ায় গণতন্ত্র একটি সর্বজনীন মতাদর্শ হলেও দিবসটির প্রচলন হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হতো। তবে, ২০০৭ সালে জাতিসংঘের গৃহীত একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে গণতন্ত্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দিবসটির উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক আদর্শ-নীতির বিকাশ ও সম্প্রসারণ। দিনটিতে জাতিসংঘ তার সকল সদস্য রাষ্ট্রকে নিজ নিজ জনগণের মাঝে গণতন্ত্রের গুরুত্ব, তাৎপর্য, নীতি ও আচরণসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানায়। গণতন্ত্র সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র চর্চা করার জন্য উৎসাহিত করে থাকে।
সাধারণত গণতন্ত্র বলতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও ভোটাধিকারের প্রয়োগই বোঝায়, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাম্য, স্বাধীনতা ও আইনের শাসন। গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রেসের স্বাধীনতা, জননিরাপত্তা, জেন্ডার সমতা, সর্বোপরি গণতন্ত্রিক চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ থাকবে। গণতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান ভোটাধিকার আছে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। যে সমাজে এইগুলি পূর্ণ মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় না সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি না।
গণতন্ত্রের মাপকাঠিগুলি অনেকটা এ রকম: প্রথম: সাধারণ জনগণ কি মুক্তভাবে কথা বলতে পারে? অর্থাৎ জনগণের বাকস্বাধীনতা কতটুকু দেওয়া হয়েছে? সরকারের যে কোনও পরিকল্পনার প্রকাশ্য সমালোচনা করতে পারে কি না? দ্বিতীয়: জনগণ কি নির্বাচিত প্রতিনিধিকে তাদের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত বা প্রভাবিত করতে পারে? তৃতীয়: সরকার জনগণের চাহিদা ও ইচ্ছাকে সামনে রেখেই কি নীতি নির্ধারণ করে নাকি সরকার তার ইচ্ছাকে জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়? চতুর্থ: কোনো বিষয়ে সরকার যদি জনগণের দাবিদাওয়া পূর্ণ না করে তবে শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত করে ক্ষোভ দেখানোর সুযোগ আছে কি না? পঞ্চম: জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে সরকারবিরোধী মতামত প্রকাশ করতে পারে কি না? লন্ডনের বিখ্যাত ইকনমিস্ট গ্রুপ ‘ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ Economist Intelligence Unit (BAvBBD) প্রতি বছর পাঁচটি মাপকাঠির নিরিখে বিশ্ব জুড়ে ১৬৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং দু’টি অঞ্চলের গণতন্ত্রের অবস্থান তুলে ধরে একটি রিপোর্ট তৈরি করে, যাকে ‘গ্লােবাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স’ বা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সূচক বলা হয়। এই সূচক তৈরি করতে যে পাঁচটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় তা হলো- নির্বাচন প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কাজকর্ম, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ ও স্বাধীনতা, রাজনৈতিক মনস্কতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা।
ভারতে ড. মনমোহন সিং সরকারের শেষ বছর তথা ২০১৩-তে ‘ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (ইআইইউ)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত দশের মধ্যে ৭.৯ সামগ্রিক নম্বর পেয়ে বিশ্বে ২৭ নম্বর স্থান অর্জন করেছিল। রিপোর্টটি প্রকাশ হয় ২০১৪-এর জানুয়ারিতে। তবে ২০১৯-এর গণতন্ত্র সূচকে ভারত গড়িয়ে পড়ল ৫১ নম্বর স্থানে। রিপোর্টটি প্রকাশ হয় ২০২০-এর জানুয়ারিতে। ২০১৮-তে ভারতের সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.২৩। যা এ বছর নেমে হয়েছে ৬.৯। বিগত পাঁচ-ছয় বছরের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সূচকে যে তথ্য উঠে আসছে তা থেকে দেখা যায় যে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের হাল হকিকত নিম্নমুখী। (ইআইইউ)-এর রিপোর্টে ২০১৪-তে ভারতের সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.৯২, স্থান ছিল ২৭। ২০১৫-তে ভারতের সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.৭৪, স্থান ছিল ৩৫। ২০১৬-তে সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.৮১, স্থান ছিল ৩২। ২০১৭-তে সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.২৩, দশ ধাপ পিছিয়ে স্থান ছিল ৪২। ২০১৮-তে সামগ্রিক নম্বর ছিল ৭.২৩, স্থান ছিল ৪১। আর ২০১৯-এ এক ধাক্কায় দশ ধাপ পিছিয়ে ৫১ নম্বর স্থানে নেমে এল ভারত। অর্থাৎ ২০১৪’র ২৭ নম্বর স্থান থেকে গড়িয়ে বর্তমান সরকারের আমলে ২৪ ধাপ পিছিয়ে ভারত নেমে এল ৫১ নম্বর স্থানে। ২০০৬ থেকে (ইআইইউ) প্রতি বছর এই আন্তর্জাতিক তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। ২০০৬ সালের পর থেকে ভারত কখনও এত নীচে নামেনি।
প্রকাশ থাকে যে, ‘ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ Economist Intelligence Unit (BAvBBD)-এর রিপোর্টে কোনো দেশের সামগ্রিক নম্বর আটের উপর থাকলে সেই দেশটিতে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ আছে বলে গণ্য করা হয়। আর ছয় থেকে আটের মধ্যে নম্বর থাকলে সেটি ‘ত্রু টিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে গণ্য করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে এই দ্বিতীয় তালিকাতেই আছে ভারত।
গণতন্ত্রের হাল হকিকত নিম্নমুখী কেন? এ ব্যাপারে ইআইইউ’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের অধিকার খর্ব হয়েছে। এই কারণ দেখিয়েই ভারতের গ্রেড কমিয়ে দিয়েছে সূচক প্রস্তুতকারী সংস্থা ইকনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট। যেমন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ এবং সে সময়ে সেখানে ইন্টারনেট শাটডাউন, সাধারণ নাগরিকদের ধড়পাকড়, স্থানীয় নেতাদের আঁটক এবং অসমে এনআরসির পরে ১৯ লক্ষ মানুষকে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। এভাবেই জনসাধারণের অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে যেমন বহু নিরিহ মুসলিমকে গোরক্ষকরা পিটিয়ে হত্যা করেছে অর্থাৎ মব-লিঞ্চিংয়ের শিকার শুধু মুসলিম সমাজই। উনা এলাকায় গো হত্যার অভিযোগে প্রকাশ্য রাস্তার উপর চার যুবককে রড দিয়ে পেটানো হয়। কিছুদিন আগে রাজধানী দিল্লিতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় পঞ্চাশজনের মতো প্রাণহানি ও আড়াইশ’রও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) এর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে দেওয়া হয়নি। হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে দলিতদের। ২০১৮ সালে গুজরাতে এক দলিত দম্পতিকে বেঁধে গণপ্রহার করা হয়। মহিলাটি কোনক্রমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেও তার স্বামী মণীশ বানিয়াকে বাঁচানো যায়নি। জাতপাতের ইস্যুই হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দলিত গবেষক রোহিত ভেমুলাকে ঠেলে দিয়েছে আত্মহত্যার পথে। মুসলিম ও দলিতদের উপর এসব নির্যাতন কিছু নতুন নয়, হামেশাই হতে থাকে। কখনও কখন ঘটানগুলি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে তোলপাড় হয়ে আবার যেই সেই। এটি একটি ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের পরিচয় হতে পারে না।
তাই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে সমগ্র বিশ্বের গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা এ ব্যাপারে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করছেন। ইআইইউ’র রিপোর্টে ২০২০-এর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সূচকেও ভারতের স্থান নিম্নমুখী থাকতে পরে বলে ধারণা করা হয়েছে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে এটাই আশা করব যে গোটা বিশ্বে বিশেষ করে ভারতে গণতন্ত্রের মান উন্নত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।