পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। নানা প্রতিক‚লতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। এদেশের নারীদের এগিয়ে চলা খুব একটা মসৃণ নয়। তাদের অগ্রযাত্রায় শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ইভটিজিং ও ধর্ষণ বিশাল প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা পালন করছে। নারী নির্যাতনের সংখ্যা দ্রæত হারে বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিকভাবে নারীরা নিরপত্তাহীনতায় ভুগছে। আগামীতে সেই নির্যাতনের সংখ্যা কোথায় দিয়ে দাঁড়াতে পারে তা সচেতন মহল একটু ভাববেন বলে আশা করি। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায় এসে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। সাধারণত আমাদের দেশে প্রত্যেক নারী পুরুষের স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। নারী শিক্ষার বিষয়টি আমাদের সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে অপরিহার্য বিষয় হিসেবে জড়িত। আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। এমতাবস্থায় ‘ইভটিজিং, নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার’ হওয়ার বাস্তবতা বড়ই দুর্ভাগ্যজনক।
চলমান বাসে যারা ইভটিজিং কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। সম্প্রতি দুই নারীকে প্রকাশ্যে নির্যাতনের সংবাদ ছাপা হয়েছে। এ অমানবিক বিষয়টি মানুষকে অবমূল্যায়ন করছে। বাড়ছে সামাজিক সমস্যা ও সমাজ জীবনে অনাকাক্সিক্ষত দুঃখ-দুর্দশা। আবার কখনো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা গ্রহণে যাওয়া ছাত্রী ধর্ষিতা হয়ে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ফিরে আসছে। অথচ এদের কাছ থেকে পরিবার যেমন অনেক কিছু আশা করে তেমনি জাতিও অনেক কিছু আশা করে থাকে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, সর্বোপরি প্রত্যেক ধর্মের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো সঠিকভাবে পালন না করার জন্য এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। যথার্থ উদ্দেশ্য থেকে মানবমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধ ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। এগুলোর জন্য দায়ী সঠিক মনুষ্যত্ববোধের অভাব। যখন তাদের চরিত্র থেকে মহৎ গুণ বিদূরিত হয়ে অন্যায় অনাচার আশ্রয় নেয়। জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্য থাকে না তখন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। দেশে আইন আছে, সমাজে ঘৃণাও আছে। তবুও দুষ্ট ক্ষতের মতো এই বিষয়টি সমাজ জীবনে নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে আছে। কত নিরপরাধ কিশোরী-তরুণীর জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আজ আমাদের সমাজটা অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোন আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব।
সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘শরিক রাষ্টগুলো নারীকে সব ধরণের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ দেশীয় আইনেও এমন অনৈতিক ও মানবতাবিরোধী কাজের বিচার করা আবশ্য কর্তব্য। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়। ইভটিজিং দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫০৯ ধারায় দন্ডনীয় অপরাধ। তাছাড়া স¤প্রতি সরকার সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর কারাদÐ এবং ৫০,০০০ টাকা জরিমানার বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করেছেন এমনকি ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমেও সর্বনিম্ন ১ বছর কারাদÐ ও ৫,০০০ টাকা জরিমানার বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারী করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ১০ ধারায় যৌনপীড়ন এর শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদÐের বিধান রয়েছে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থ দÐও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অন্যূন ২ বছর সশ্রম কারাদÐ এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদÐ। উক্ত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদÐেরও বিধান রয়েছে।
শিশু হত্যা ও শিশুদের শারীরিক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় দেখতে পাই। আইনে উল্লেখ আছে, বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আইন অনুযায়ী অন‚র্ধ্ব ১৮ (আঠার) বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হবে। যে কোনো ঘটনার শিকার হলে ভিমটিম নিকটবর্তী থানায় এজাহার দায়ের করতে পারেন। অন্যথায় সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। পারিবারিক আইন, পারিবারিক আদালত এগুলো সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে জানতে হবে। পরিবারিক আইন হচ্ছে বিয়ে সংক্রান্ত, দেনমোহর, বিয়ে-বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ ইত্যাদি নিয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশকে সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের দিক নির্দেশনার অনুকরণে আইন প্রণয়ন করা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিচার দ্রæত সম্পন্ন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও পাড়ায় পাড়ায় কমিটি গঠন করে তাদের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের মেধা, দক্ষতা, প্রতিভার অর্ধেক ভান্ডার সঞ্চিত রয়েছে নারীর কাছে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব তাদের কর্মক্ষেত্র কিংবা তাদের শিক্ষার পথে যেন বাধা না হয়। নারী সমাজ যাতে শিক্ষার আলোতে উদ্ভাসিত হতে পারে সে লক্ষে প্রয়োজন প্রচলিত ধারার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা। আর কোন নারী কোন শিশু যেন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার না হয়। স্কুল-গামী ছাত্রী যেন কোনোভাবে ইভটিজিংয়ের শিকার না হয়। বাসের ভিতরে বাসের নাম্বার সহ সিসি ক্যামেরা দেওয়া থাকা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নির্বিঘেœ যাতায়াতের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারী ও শিশু নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো অপরাধের দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রচারণা দরকার।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।