পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা, সাম্য ছাড়া বন্ধুত্ব হয় না। হলেও তা টেকে না। এগুলো ছাড়া স্বার্থগত মিত্রতা হতে পারে। তা মোটেই বন্ধুত্ব নয়। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় বা প্রয়োজনে। মিত্রদেশ বা মিত্রশক্তি নামে তারা একাত্তরে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছিল। সেই থেকেই ভারতকে আমরা বলি বন্ধুরাষ্ট্র। দেশে এর বিপক্ষ মতাবলম্বীরা কেবল দুর্বলই নয়, হারিয়ে যেতে বসেছে। এখানে ভারতবিরোধীতা বা বিপক্ষ মানসিকতা চর্চা করলে অবস্থা কী হতে পারে,সেটা বেশি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর দরকার হয় না।
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৯ কোটিরও বেশি। যা সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ। তাই অনেকেই ভারতকে দেশ না বলে মহাদেশ বলেন। আমাদের দেশর তিন দিকের সীমানা ভারতীয় সীমানার সাথে। আমরাও ভারতসহ বিশ্বের সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বের স¤পর্ক রেখে একটি স্বাধীন সার্বভৌম উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলছি।
বাংলাদেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা জন্ম থেকেই, আবার ক্ষমতার রাজনীতিতে দুই পক্ষের কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। বিএনপি মুখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বললেও মূলত এই দলটি প্রায়োগিক অর্থে বিকশিত হয়েছে একটি ইসলামী জাতীয়তাবাদের আবরণে আর সেই রাজনীতি তারা প্রায়োগিকভাবেই করে চলেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মুখে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বললেও প্রয়োজন হলে ধর্ম নিয়েও রাজনীতি করে। দল দুটি ভারত নিয়েও এ ধরনের রাজনীতি করছে। এ কৌশলে অবশ্য বিরতিহীনভাবে এগিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার। যেমন আমাদের দেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স¤পর্কের ধরন বোঝাতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই নানা উপমা ব্যবহার করেন। স¤প্রতি বলেছেন, রক্তের স¤পর্ক।
সরকার থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘এখনটা’ কখন? বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও এই ‹এখন› এর কথা বলেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেতো টানা বলেই যাচ্ছে। সব উপমার সাথেই ‘এখন’ শব্দটা যোগ করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক স¤প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত তথা শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি সরকারের স¤পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। একাত্তরের রক্তের রাখি বন্ধনে আবদ্ধ এ বন্ধুত্ব বর্তমানে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে,বারবার কেন বলতে হচ্ছে, বন্ধুত্বের কথা? সুস¤পর্কের কথা? গোলমালটা কোথায়?
কোন কোন সময় আমাদের সাথে সীমান্ত হত্যাসহ নানা ব্যাঙ্গ-বিদ্রæপ, তাচ্ছিল্য, বৈষম্য, সাম্যহীনতার পরও ভারত আমাদের বন্ধু। বলা বাহুল্য, অসম হলেও প্রতিবেশীর মর্যাদা থাকতে হয়। স¤পর্ক বন্ধুত্বের এবং এই স¤পর্ক সম্মানজনক হতে হয়। তাই এখন আমরা প্রতিবেশী হিসাবে ভারতের সাথে বন্ধুত্বের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নিজেরাই যেন কিছু নীতিমালা তৈরি করে নিয়েছি। দেশের গণমাধ্যমগুলোও তা খুব মানে। তারপরও প্রকাশ্যে স্বীকার করা না হলেও মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশ-ভারত স¤পর্কে কিছুটা টানাপড়েন দেখা দেয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর একে একে এসব সমস্যার বেশ কয়েকটির সমাধান হয়েছে, যা শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হতো না বলে বিশ্বাস, অনেকেরই। বাণিজ্য ঘাটতি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যাকাÐসহ কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত আছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে স¤পর্কে সংকট তৈরি হবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলেন এবং মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিএনপি মহলে কিছুটা উল্লাসও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির পার¯পরিক স¤পর্ক অনেক জোরালো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে আবার তা কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুস¤পর্ককে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াতসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জন ও বিরোধিতার মুখে যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা দেশে-বিদেশে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। সেসময় ভারতে কংগ্রেস দলের সরকার ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। মনমোহন সিংয়ের সরকারের বলিষ্ঠ সমর্থন শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি বড় সহায়ক শক্তি হয়েছিল। মোদী ভারতের ক্ষমতায় আসায় দিল্লিকে আরো বেশি পাশে পেয়েছে শেখ হাসিনা সরকার।
এদিকে ভারতে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও পদক্ষেপেও বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্ব অব্যাহত রেখেছেন। ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন করার পরও। যদিও ভারতের কোন কোন রাজনৈতিক নেতা সে সময় বাংলাদেশ স¤পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন।চীনের সঙ্গে ভারতের সা¤প্রতিক বিরোধ ও যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থা আরো সুবিধাজনক হয়েছে। ভারতের পাশাপাশি চীনের কাছেও বাংলাদেশের কদর বেড়েছে। এ অবস্থায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব রক্তের। আর চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন হচ্ছে, চীন ভারতকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে। সমুদ্রে মুক্তার মালার মতো করে ভারতকে চারদিক থেকে বেঁধে ফেলতে চায়। পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে হর্ন অব আফ্রিকা পর্যন্ত আরব সাগর, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা হয়ে ভারত মহাসাগর, এরপর বঙ্গোপসাগরের কিনারে বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত নৌপথের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মধ্য দিয়ে চীন তা করবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
স্থলপথে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করে ভারতকে ঘিরে ফেলতে চায় দেশটি। এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই নিজেদের মধ্যে উষ্ণ বন্ধুত্ব থাকার জানান দিচ্ছে বারবার। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে এ ধরনের বন্ধুত্বকে বিরল বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ করতে পারছে না। সেই কবে থেকে ভারতের কাছে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করে আসছি আমরা অথচ সেটাকে সার্বক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দিব-দিচ্ছির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের অজুহাতের শেষ নেই। কখনও মমতার দোহাই, কখনও কথার মারপ্যাঁচে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের ক্ষুদ্ধতার সুযোগ চীন নিতেই পারে। ইতোমধ্যে চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে সামনের সারিতে রয়েছে। করোনাকালে তার ব্যাপক সহায়তা দেশের মানুষকে আশ্বস্থ করেছে। কারণ যে প্রকৃত বন্ধুত্বসুলভ আচরণ নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেবে, তাকেই মানুষ গ্রহণ করবে। বাংলাদেশকে চীনের ব্যাপক সহায়তার বিষয়টি ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হওয়া স্বাভাবিক। তবে ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে, একতরফা সম্পর্ক দিয়ে কখনো ভাল সম্পর্ক গড়া যায় না। এজন্য পারস্পরিক ভারসাম্যমূলক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।