পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নৌপথ খুব স্বাভাবিক কারণেই যোগাযোগ ও পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে আসা যান্ত্রিক পরিবহনের সূচনা হয়েছিল এই রুটে। কিন্তু আধুনিক কালে এসে বিশ্বের আর সব জনগোষ্ঠি যখন তাদের নৌপথকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, তখন আমাদের নৌপথ যেন পড়ে আছে অবহেলিতভাবে। স্থল ও আকাশপথের তুলনায় নৌপথ যদিও অনেক বেশি সাশ্রয়ী। আমাদের নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যেভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করে, সেটা সভ্যতার জন্য পরিহাসই বলতে হবে। স¤প্রতি রাজধানীর সদরঘাটের শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ৩৪ জন প্রাণ হারায়। শ্যামবাজার পয়েন্টে ময়ূর-২ নামের লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি। ওই ঘটনায় সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মামলায় বেপরোয়া লঞ্চ চালিয়ে মানুষ হত্যা ও ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দন্ডবিধির ২৮০, ৩০৪(ক), ৪৩৭ ও ৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৭০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ৫১৬ জন আহত ও ৪৮৯ জন নিখোঁজ হন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা ২৩৬টি। ২০১৯ সালে ২৬টি নৌদুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। ৩৩ জন আহত ও ২০ জন নিখোঁজ হন। ২০১৭ সালে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৫০ বছরে দেশে নৌদুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২০ হাজার ৫০৮ জন। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে সংঘটিত নৌদুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে নৌযানের ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন, ডিজাইন না মেনে নৌযান নির্মাণ, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মালপত্র এবং যাত্রী বহন, মাস্টার-সারেংদের অদক্ষতা ও অসতর্কতা, সংঘর্ষ, নদীর নাব্য সংকট, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, নৌযান মালিকদের দায়িত্বহীনতা এবং নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে চিহ্নিত করা হয়।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, দুর্ঘটনার এই কারণগুলো কিন্তু এখনো দৃশ্যমান। বিআইডব্লিউটির আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবে আইনগুলো সময়োপযোগী করে নেওয়া দরকার। ‘দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬’ অধ্যাদেশের পঞ্চম অধ্যায়ের ৫৮ (এ) ধারায় যাত্রী ও ক্রুদের জন্য জীবন বীমার কথা বলা থাকলেও, প্রয়োজনীয় আর্থিক কাভারেজের পরিমাণ উল্লেখ নেই। এছাড়াও বিদ্যমান আইনে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া যাত্রী পরিবহন করা, প্রশিক্ষিত চালক বা ইঞ্জিনিয়ার ব্যতীত জাহাজ চালানো অথবা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করার জন্য যে ধরনের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে তা অপর্যাপ্ত। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার শাস্তি হিসেবে (‘দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬’ ধারা ৬৬-৬৭ অনুযায়ী) দুই থেকে তিন বছর জেল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে, তা অপ্রতুল। পরিবহন মালিকদের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আবহাওয়া মাঝে মাঝেই বৈরী হয়ে উঠে। এদিকে নৌপথের সিগনালিং বা সংকেত ব্যবস্থা নাজুক। এর ওপর ফিটনেসবিহীন অসংখ্য নৌযান চলাচল করছে। ঈদের সময় পুরনো ও চলাচলের বৈধতা নেই এমন নৌযানগুলো পালিশ করে যাত্রী পরিবহন করে, ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এটা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। নৌনিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। ত্রুটিপূর্ণ, সার্ভেবিহীন ও অনিবন্ধিত লঞ্চসহ সব ধরনের অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, দুর্যোগ মৌসুম বিবেচনায় ঈদের আগে অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপথে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রাখার বিকল্প নেই। লঞ্চের চালক এবং স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্স প্রাপ্ত হতে হবে। তাদের শারীরিকভাবেও উপযুক্ত থাকতে হবে, যাতে বিপদকালীন সময়ে তারা যাত্রীদের সাহায্য ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কারিগরি ও ব্যবহারিক জ্ঞান এবং শারীরিক উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করতে হবে।
সীমিতসংখ্যক যাত্রীবাহী লঞ্চের কারণে প্রতিনিয়ত লঞ্চে ওভারলোডিং হয়ে থাকে। এই ওভারলোডিং থেকে যাত্রীদেরকে বিরত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এ ক্ষেত্রে আইন রয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চ চলাচল না করলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে আবহাওয়া বার্তা মেনে চললে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমবে। যাত্রীবাহী বৈধ লঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নততর লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে হবে। নৌপরিবহনের উন্নয়নের জন্য এই খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করতে হবে। নৌপথে ট্রাফিক সিস্টেমের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কেননা বড় লঞ্চগুলোর দয়ার উপর ছোট লঞ্চগুলো টিকে থাকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক করতে হবে। বিআইডবিøটিএর উপকূলীয় দ্বীপসমূহে সার্ভিসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা মনে করি, নৌযানের বিজ্ঞানসম্মত নকশা ও ধারণক্ষমতাসম্মত যাত্রী উত্তোলন নিশ্চিত করা গেলে নৌদুর্ঘটনা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে। এ ব্যাপারে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই সার্ভেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সি-সার্ভে সনদ ছাড়া যাতে কোনো নৌযান চলাচল করতে না পারে, সে জন্য নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। যাত্রীদের নির্বিঘ্ন ও যাত্রাপথ সুন্দর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, লঞ্চ মালিক সমিতি, বিআইডব্লিউটিএ সহ সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।