পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে এ দেশের মানুষের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক। প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ নৌপথে যাতায়াত করে। একটা সময় নদী দিয়েই মানুষ যাতায়াত করতো। এখনও করে। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে করে। কারণ, যাতায়াতের নিরাপদ রুট সড়কের মতো অনিরাপদ হয়ে উঠছে। একের পর এক মারাত্মক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কের সাথে পাল্লা দিয়ে নৌপথেও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। কিছুতেই তা থামছে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ না থাকায় দুর্ঘটনার হাত থেকে মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না। একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি দুর্ঘটনা আগেরটিকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। এক পরিসংখ্যান দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে তিন হাজারের বেশি মানুষ নৌপথে মৃত্যুবরণ করেছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে বালুবাহী একটি ট্রলারের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা বিলে ডুবে গেলে ২২ জন মৃত্যুবরণ করে। এ দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশ দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেশুমার। লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব অকালমৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড? সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা আগুনে পুড়ার দুর্ঘটনার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। প্রতিবছর নৌপথে বহু মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার মিলছে না। ক্ষমতার পালাবদল হয়। সরকার যায়, সরকার আসে। কিন্তু নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। কিছু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও কমিটির সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নের নজির নেই। তদন্তে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির শূন্যের কোঠায়। এমনটি হওয়ার কথা ছিল। আইনের শাসন থাকলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে হতো। অথচ, জবাবদিহি চাওয়া তো দূরের কথা, একটু টুশব্দ পর্যন্ত করা যায় না।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজারের মতো নৌপথ রয়েছে। এদের বেশিরভাগই অরক্ষিত। এসব নৌপথে বৈধভাবে প্রায় ৩ হাজার ছোট-বড় লঞ্চ, জাহাজ চললেও অনুমোদনহীনভাবে কয়েকগুণ বেশি নৌযান চলাচল করছে। এসব দেখার কেউ নেই। সরকার যদি সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা নৌকা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতো তাহলে এভাবে নদীতে মৃত্যুর মিছিল আমাদেরকে দেখতে হতো না। সরকার নৌপথ উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। কিন্তু দুর্ঘটনা কমে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ছোট বড় মিলে প্রায় ৭০০টির মতো লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৬ হাজার পাঁচশত মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছে ২ হাজারের বেশি মানুষ। ভয়াবহ যেসব নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে কয়েকটি হলো: ১. ৪ এপ্রিল ২০২১ শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাবিত আল হাসান নামের একটি লঞ্চ অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে নদীতে ডুবে যায়। ৩৫ জন মারা যায়। ২. ৩০ জুন ২০২০ ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড নামক একটি লঞ্চকে ময়ূর-২ নামের অপর একটি লঞ্চ ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি নদীতে ডুবে যায়। ৩২ জন মারা যায়। ৩. ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলবে এমভি জলকপোত ও এমভি রাজহংসীর মধ্যে সংঘর্ষে ৩০২ জন যাত্রী মারা যায়। ৪. ২০০১ সালের মে মাসে এমভি সালাউদ্দিন-২ ও এমভি সুবাহ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৪০০ জন মারা যায়। ৫. ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ চাঁদপুরের মেঘনায় ডুবে গেলে ৮০০ জন মারা যায়। ৬. ২০০৪ সালে পাগলায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এমভি মিতালী ডুবে ৪০০ জন মারা যায়। ৭. ২০০৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এমভি মহারাজ দুর্ঘটনার মারা যায় ১৫০ জন। ৮. ২০০৮ সালের ২৩ মে চাঁদপুরে এমভি লাইটিং সান দুর্ঘটনায় ৩০০ জন মারা যায়। ৯. ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর এমভি কোকো-৪ ডুবে প্রায় ১০০ জন মারা যায়। ১০. ২০১২ সালের ১৩ মার্চ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনায় শরীয়তপুর-১ নামের দোতলা লঞ্চ ডুবে ১৪৮ জন মারা যায়। উপরোক্ত ঘটনাগুলো থেকে বুঝা যায় বাংলাদেশের নৌপথ কতটা অনিরাপদ।
নৌদুর্ঘটনা নতুন কোনো বিষয় না। এর আগেও নদী পথে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা কমেনি। উল্টো বেড়েই চলছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ডুবে যাওয়া ট্রলারটিও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলছিল। আমরা মনে করি, নৌ-দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। যেমন: চালকের সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে দেয়া। অনুমোদনহীন সব ধরনের নৌযান অপসারণ করা। নৌদুর্ঘটনার কবলে পড়লে যাত্রীদের করণীয় কী হবে তা আগ থেকেই অবহিত করা। জীবনরক্ষাকারী উপকরণ সংরক্ষিত আছে কি না, তা নিশ্চত করা। নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটির সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। নৌচালক ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রাখা। ক্রুটিপূর্ণ ও অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল বন্ধে বিআইডব্লিউটির উচিৎ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা। বিআইডব্লিউটির আইন ও নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কার্যকর থাকলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? এ নিয়ে বির্তক কিংবা সমালোচনা করা অন্যায় কিছু না। কিন্তু আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা দায় স্বীকার করা তো দূরের কথা উল্টো সবদোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে চার শতাধিক যাত্রী নিয়ে সাত হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফেরি সেউল ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় প্রায় তিন শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী চুংহং-ওন পদত্যাগ করেছিলেন। শুধু কি তাই! উদ্ধার তৎপরতায় নিজের সরকারের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। চুং হং-ওন বলেছিলেন, স্বজনহারা পরিবারগুলোর কান্নায় আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ ঘটনার দায় আমি এড়াতে পারি না। তাই আমি পদত্যাগ করছি। অথচ, বাংলাদেশে নৌদুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, কারখানা দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষ মরছে। অথচ, এর দায় পর্যন্ত কেউ স্বীকার করতে চায় না। আমরা আমাদের মন্ত্রীদের পদত্যাগ চাই না, অন্তত তারা দুর্ঘটনা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন, এটুকু তো আশা করতেই পারি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।